মাসকাওয়াথ আহসান
প্রকাশিত: ১৭:৪১, ১৬ জুন ২০২০
"থ্রি ইডিয়েটস" এর "অল ইজ ওয়েল" দর্শন
থ্রি ইডিয়টস মুভিটি নানাকারণে আমাদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। দক্ষিণ এশীয় ছেলেদের জোর করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পাঠালে ছেলেরা যে কষ্ট পায়; নিজের পছন্দের বিষয়ে পড়তে না পেরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নামের অচলায়তনে যেভাবে মাথা কুটে মরে; তার স্পষ্ট চিত্র আঁকা হয়েছে থ্রি ইডিয়টস ছবিতে। এ আমাদের সবার জীবনের গল্প; এর আনন্দ-বেদনায়-রম্যে-বন্ধুত্বে- প্রেমে-ছাত্র আত্মহত্যায়-নিজের পছন্দের জীবন খুঁজে নেয়ায়; আমরা সবাই মিশে আছি।
থ্রি ইডিয়টস মুভির এই তিন বন্ধুর গল্প; গোটা পৃথিবীর তিন বন্ধুর গল্প। যাদের জীবনে ভাইরাস অভিভাবক-শিক্ষক নিজস্ব প্রত্যাশার চাপে; কাউকে কাউকে আত্মহত্যার মুখেও ঠেলে দেন। জীবনানন্দের শত্রু এই হিসেবি জীবনের ভাইরাস। যে ভাইরাস ট্রাম লাইনে মাথা দিতে বাধ্য করে মানুষকে; এই ভাইরাস সমাজ তাকে কিছুতেই বুঝতে না পারায়; নিজের মতো করতে বাঁচতে না দেয়ায় কত প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ জীবনের বৃক্ষের শাখা থেকে ঝরে গেছে। যাবার সময় লিখেছে, "আপনাদের বৃক্ষের শাখায় আমি ফুল ফোটাতে পারবো না; আমি লাস্ট বেঞ্চি।"
থ্রি ইডিয়টস ছবির ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ভাইরাস; আমাদের সমাজের সীমাবদ্ধ আর অতিরিক্ত কড়া চিন্তার শিক্ষক-অভিভাবক আর রাষ্ট্রশাসকের প্রতিভূ ও প্রতীকী চরিত্র যেন।
এই ভাইরাস হচ্ছে; নিজের তামাদি চিন্তাভাবনা জোর করে তরুণদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার ভাইরাস। নিজে যতটুকু বুঝি তার বাইরে নতুন বোঝা পড়ায় যেতে না চাওয়া; স্বকল্পিত লক্ষ্মণরেখা এঁকে নিয়ে বসে থাকা স্বকালের জগদ্দলের ভাইরাস।
এই ভাইরাস চরিত্রটি কলেজ জীবনের প্রেমিকার বাবার মতো প্রেমের শত্রু এক মানুষ। নিজের রুটিন জীবনে "ভালো ছাত্রে"র ক্লিশে সংজ্ঞা মেনে চলা সেই সাদাকালো ফিল্মের বাবা দারাশিকো; যে রাজ্জাককে ডেকে ব্ল্যাংক চেক ছুঁড়ে দিয়ে তার মেয়ে শাবানার জীবন থেকে সরে যেতে বলে। এই ভাইরাস বাবা ক্লাস না করা ইডিয়ট ছাত্রটির কোন ফিউচার ক্যারিয়ার নেই ভেবে; ছেলেটিকে তার মেয়ের ঘরে বসে বিজ্ঞানের প্র্যাক্টিক্যাল খাতা আঁকতে দেখে ঈষত ভ্রু কুঞ্চিত করেন। মেয়ের মাকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, এই ইডিয়টটা এখানে কী করছে! যে ছেলে বুয়েটে না পড়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার তাল তুলছে; তার সঙ্গে তোমার মেয়ের কীসের কথা!
এই ভাইরাস বাবা কাজ থেকে ফিরে কোনদিন ইডিয়টকে তার ডাইনিং টেবিলে বসে মুরগীর ঝোল আর আচার দিয়ে ভাত খেতে দেখে বিরক্ত হয়ে ব্যালকনিতে বসে জুতা-মোজা খুলতে থাকেন।
থ্রি ইডিয়টস মুভির এই তিন বন্ধুর গল্প; গোটা পৃথিবীর তিন বন্ধুর গল্প। যাদের জীবনে ভাইরাস অভিভাবক-শিক্ষক নিজস্ব প্রত্যাশার চাপে; কাউকে কাউকে আত্মহত্যার মুখেও ঠেলে দেন। জীবনানন্দের শত্রু এই হিসেবি জীবনের ভাইরাস। যে ভাইরাস ট্রাম লাইনে মাথা দিতে বাধ্য করে মানুষকে; এই ভাইরাস সমাজ তাকে কিছুতেই বুঝতে না পারায়; নিজের মতো করতে বাঁচতে না দেয়ায় কত প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ জীবনের বৃক্ষের শাখা থেকে ঝরে গেছে। যাবার সময় লিখেছে, "আপনাদের বৃক্ষের শাখায় আমি ফুল ফোটাতে পারবো না; আমি লাস্ট বেঞ্চি।"
ভাইরাস সমাজের সাফল্যের সংজ্ঞা অনুযায়ী গ্রন্থকীট আর সিক্স ডিজিটের মোহে বড় হওয়া কথিত ভালো ছেলেটিও থ্রি ইডিয়টস ছবিতে রয়েছে। যে অডিটোরিয়ামের ভাষণে নিজের বক্তৃতার মানে নিজেই না বুঝে "চমৎকার" শব্দটিকে "বলাতকার" বলে। এই ভাবে সৃজনশীলতাহীন সীমাবদ্ধ চিন্তার ভালো নম্বর পাওয়া ভালো ছাত্রেরা দক্ষিণ এশিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থাকে বলাতকার করে চলেছে।
ভাইরাসের পছন্দ তার অচল চিন্তার প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের দাস ছাত্র-ছাত্রী। যে তার বাজার করে দেবে; যে সব বিষয়ে সহমত হবে, ইরানি কালচারাল সেন্টারে ভাইরাসের নির্দেশে ভলান্টিয়ার হবে; কারণ শিক্ষক হতে গেলে এই লালসালুর ভাইরাস শিক্ষকের লালসালুর মাজারে খাদেম হতে হয়। তারপর শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে ঘোঁত ঘোঁত শব্দে জেগে জেগে ঘুমিয়ে ক্লাস নিয়ে
নতুন ভাইরাস ছা-ছপ-ছমুছা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম দেয়। কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়কে হত্যা করে।
ইডিয়ট ছাত্রটিকে ভাইরাস অনেক কষ্টে সহ্য করে; কিন্তু ঠিকই ভাইভায় আপত্তিকর প্রশ্ন করে অপমান করে; ৫০-এ ১৯ দেয়। ইনকোর্সের নম্বর না বসিয়ে শূণ্য দিয়ে দেয়। কারণ ইডিয়ট যেন এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢুকে অচলায়তনের সুরুচি বিনষ্ট না করে তার নানারকম ডিজরাপটিভ চিন্তায়।
ভাইরাস কিন্তু খবরও পায়নি; ইডিয়ট ঠিকই ছাত্র পড়ায়; ছাত্রদের ভাইরাস হীন সকাল-দুপুর-বিকেল ফ্যাসিলিটেট করে। ইডিয়টের কাছে ক্লাসরুম হচ্ছে অক্সিজেন চেম্বার। যেখানে আনন্দের মাঝ দিয়ে শিখবে ছাত্ররা; যেহেতু ওরাই আগামির দুরন্ত সহিস।
"সুজাতাই আজ নাকি সবচেয়ে সুখে আছে"-এই গান শুনে বড় হওয়া ভাইরাস অভিভাবকেরা যখন বিদেশ ফেরত "প্রাইস ট্যাগ" মার্কা জামাই খুঁজে মেয়েটিকে সেই সফল-বলদের হাতে তুলে দেবার জন্য সব আয়োজন প্রায় সম্পন্ন করেছে; তখন ইডিয়ট নিজেই এসে "ভাইরাসের অসুখ কতো খারাপ অসুখ"-এই প্রস্তাবের পক্ষে বিতর্ক করে সবুজ লনের বেতের চেয়ারে বসে। বাড়ি নয়-গাড়ি নয়-দাড়ি নয়-সেকেন্ড হোম নয়-মিলিয়ন ডলার নয়; সিম্পল লিভিং আর হাই থিং কিং-ই যে সুখ; তা "এই পথ যদি না শেষ হয়; তবে কেমন হতো তুমি বলোতো?"-র অন্তহীন আনন্দ যাত্রা।
থ্রি ইডিয়টস সেই রাশিয়ান পুতুলের রূপকথা যেন; যার মধ্যে অসংখ্য পুতুল আর তার গল্প লুকিয়ে থাকে; সে গল্প আপনার-ওর-আমার-আমাদের।
মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতা শিক্ষক
আরও পড়ুন
খোলা জানালা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ
সর্বশেষ
জনপ্রিয়