আহমদ সিরাজ
সময়ের কথা
করোনা বাংলাদেশে উদয়ের পর থেকে যাতায়াতের স্বাভাবিকতা অনেকখানি নষ্ট হয়ে গেলে, অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ আর স্বাভাবিক থাকে নি। যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে ওঠে মোবাইল ফোন।
দৃশ্যত যে বিষয়গুলো এতদিন আমাদের চোখে পড়ে নি, অনেকটা বিভোর হয়ে ঘোরেই যখন তখন করোনা পরিস্থিতি মূল হিসাবে ধরে আমাদের দূর্বলতাগুলো উম্মোচিত করে দিয়েছে। আমাদের বড়াই করা মানবিকতার জমিনে যেমন, তেমনি কৃতিত্বের জমিনেও। এরকম কথামালার ভেতর দিয়ে আমাদের আলাপ শেষ হয়ে যায়।
কিন্তু এ সময়ে নানাজনের সঙ্গে আলাপ যোগাযোগ মোবাইল ফোনে হয়ে উঠলে কি এক অস্পষ্ট কারণে যেন মোবাইলে কথা সাহিত্যিক আকমল হোসেন নিপু ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলা হয়ে উঠে নি বা তিনিও কথা বলেন নি। অনেকটা হৃদয়ের সহোদরের মতো আমাদের অবস্থান তৈরী হয়ে আছে-করোনাকালীন সময়ে যে দূরত্ব তৈরী হয়েছে, তাতে আমাদের এ ক’মাস কথা না বলাতে এক ধরনের অভিমান কি না যুক্ত হয়ে গিয়েছিল তা স্পষ্ট হয়নি। কেউ কথা না বলাতে যেন কার অপেক্ষায় কে থেকেছে, এভাবে সময় অতিবাহিত হতে থাকে। মাঝে মাঝে এমন অদ্ভুত সময় পার হতে হয়।
এর মধ্যে হঠাৎ ০৪.০৭.২০২০ খ্রিস্টাব্দে বিকাল ৬.১৫টায় নিপু ভাইয়ের ফোন আসে। দীর্ঘদিন পর ফোনে আমাদের কথাগুলো কোন অভিযোগ নয়, স্বাভাবিক উচ্চারণে দীর্ঘ সময় পার করে আমাদের নিজেদের অবস্থান জানাতে গিয়ে অনেক কথা হয়ে গেল। এভাবে ৩২মিনিটের মতো আলাপে আমাদের কথায় উঠেছিল করোনা পরিস্থিতিতে আমাদের বর্তমান ও অনাগত ভবিষ্যত জীবন।
নিপু ভাই করোনার সর্বগ্রাসীতায় বাংলাদেশের মানুষের জীবন ও জীবিকা যে পরিস্থিতিতে পড়েছে, তাতে মানুষ মানুষের জন্য মানবিকতার যে উদ্যোগ সর্বত্র পরিলক্ষিত হয়ে উঠতে দেখা গেছে তা করোনা পরিস্থিতিতে দেখা যায় নি। নিপু ভাইয়ের কথার মধ্যে দিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথাও ছিল আমরা অনেক খারাপ অবস্থার মধ্যে চলে গেছি। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এমন নাজুক পরিস্থিতিতে যারা সর্দিকাশি হলে সিঙ্গাপুর, হংকং চলে যেতেন, তারা কিন্তু এ যাত্রা দৌড়াতে পারেন নি কিংবা যাদের বেগম পাড়া, আরাম পাড়ার মতো তৈরী করে রেখেছেন, তাতেও দৌড়াতে পারেন নি এবং তাতে যে এই শ্রেণীর ব্যক্তিদের মানবিকতার উতরে উঠেছে স্বদেশের মানুষের জন্য তার কোন আলামত খোঁজে পাওয়া যায় নি।
এই মহা দুঃসময়ে মানবিকতার জমিনে খরা, কোন চাষাবাদ হয়নি বলে মনে হয়েছে। মানুষের জন্য একটা আতংকের বিষয় আমাদের কথায় উঠে এসেছিল, ঐ শ্রেণীর বিত্তবানরা চাইলে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্গতি গোচাতে দেশের আনাচে কানাচে সহযোগিতার হাত পৌঁছে দিতে পারতেন আর তাতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ঘাটতি অনেকখানি পূরণ হয়ে যেত, বরং তাদের নির্লিপ্ত অবস্থান প্রকট থেকেছে। এই অর্থে করোনা পরিস্থিতিতে করোন দুর্যোগে মানুষের বোধদয় তেমন ঘটছে বলে মনে হয় না।
দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে উপরে ও তলে একটা আস্থাহীনতা, বিশ্বাসহীনতার রাজত্বই যেন তৈরী হয়েছে। এই সময়ে দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীন দম্ভোক্তি বিস্ময়বিমূঢ় করেছে। তখন আমাদের মনে হয়েছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলেও এই মহলের লুটেরা মনোবৃত্তি কমবে না, তাদের আগ্রাসী তৎপরতা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে।
করোনার কারণে দুনিয়াব্যাপী এই সত্যের উৎসারন ঘটেছে-পরিবেশ জীবনের জন্য অপরিহার্য কিন্তু এই উপলব্দি হয়েছে বলে মনে হয় না। একটু সুযোগ হয়ে উঠলে আগের মতোই পাহাড়টিলা বনভূমি উজাড় বা সাবাড় করতে দ্বিধা থাকবে না। তাই আমাদের বুঝে নিতে হচ্ছে করোনা গেলেও আমাদের দুর্দশা যাবে না। প্রতিনিয়ত করোনায় আক্রান্ত, মৃত্যু ও হতাশায় সমস্ত পৃথিবী একটা অচল অবস্থার মধ্যে তবুও আমরা আমাদের কৃতিত্ব ও কর্তৃত্বের জায়গায় কেউ হাত দিচ্ছে কি না, প্রশ্ন তুলছে কি না, তাতে আমরা যতটুকু মনোযোগী থাকছি, স্বদেশ স্বজাতির জন্য মনোযোগী হচ্ছি কী-এই প্রশ্নও তোলা যাবে না-সর্বত্রই যেন কৃতিত্ব ও কর্তৃত্ব তাড়া করে যাচ্ছে-তেমনি ভীতি ভাবনা যখন আমাদের আলোড়িত করছে তখন করোনা পরিস্থিতি মানুষজনের কর্মহীনতার বিশালতায় ‘শ্রমমানুষ’ অনেক খানি দিশেহারা, তখন বাসাবাড়িতে তরুণ প্রজাতন্ত্রের একটা বড় একটা অংশে মোবাইল আসক্তে বাঁধা পড়ে আছে। তারা মোবাইলে ডুবে আছে।
টিপটিপ মোবাইলে দিন রাত তারা যন্ত্রমানব হয়ে উঠছে। এর মধ্যে সময়ের অনাসৃষ্টি সাধিত হচ্ছে কি না যার হাত থেকে নিস্তার নেই। মোবাইলে নিয়মিত এমন পরিস্থিতিতে তারাই মোবাইলের দাসত্বে আছে এমন শংকা আশংকা থেকে মুক্ত থাকা যাচ্ছে না। পরিস্থিতি জটিল ও উদ্বেগজনক পর্যায়ে বলা চলে। মোবাইলের অদ্ভুদ ব্যবহার আমাদের বড় একটা অংশ মহামারীর মতো কিনা গুরুতর জিজ্ঞাসা। আমাদের ফোনালাপে এই বিষয়টিও গুরুত্ব পেয়ে উঠে আসে, করোনা পরিস্থিতিতে এর মাত্রাও কম নয়।
মোবাইলের কোষে কোষে এমনভাবে জায়গা করে নিচ্ছে কাছে থেকে পুত্র কন্যাকে ডাক ছাড়লে সহজে শুনতে পায় না, কিংবা এসব ডাকাডাকির জন্য বিরক্তির কারণ হয়ে উঠে অথবা কখনও ক্ষেপে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরী হয়ে উঠে। ভাইরাসের মতো মোবাইল দুর্যোগ কি পরিস্থিতি তৈরী করেছে, তা তলিয়ে দেখা হচ্ছে না। সমাজবিজ্ঞানী, মনস্তত্ত¡বিদদের জন্য এটি ভাবনারও কোন শুভ বার্তা নয়। বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতিতে এটি একটি বাড়তি ঝামেলার মতো বড় বিপদ হতে পারে। মোবাইলের সকলের ব্যবহার ভেতর দিয়ে একটি বড় অংশের বিশেষত তরুণদের জন্য আসক্তি আক্রান্তের কারণ হয়ে উঠছে। আমাদের এতসব কথায় জড়িয়ে নানা মাত্রা পেয়েছিল।
দৃশ্যত যে বিষয়গুলো এতদিন আমাদের চোখে পড়ে নি, অনেকটা বিভোর হয়ে ঘোরেই যখন তখন করোনা পরিস্থিতি মূল হিসাবে ধরে আমাদের দূর্বলতাগুলো উম্মোচিত করে দিয়েছে। আমাদের বড়াই করা মানবিকতার জমিনে যেমন, তেমনি কৃতিত্বের জমিনেও। এরকম কথামালার ভেতর দিয়ে আমাদের আলাপ শেষ হয়ে যায়।
আহমদ সিরাজ, লেখক ও লোক-গবেষক
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ