সুজয় চৌধুরী
করোনাকাল ও সাইবার ক্রাইম
ক্রিমিনোলজি ও হিইউমেন সাইকোলোজি বলে- মানুষ মন্দের দিকেই ধাবিত হয় বেশি। বেশ কিছু ক্ষেত্রে আমাদেরও অবস্থা হয়ে তাই, আমরাও মন্দের দিকেই ধাবিত হচ্ছি, রিসেন্ট একটা উদাহরণ দিলেই বুঝবেন, আমাদের দেশের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যু, ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর মৃত্যু, সিলেটের মেয়র বদরউদ্দিন কামরান সাহেবের মৃত্যু সংবাদে কিছু শ্রেণী সমাজের মানুষ খুবই উচ্ছসিত এবং কোন কোন ক্ষেত্রে আনন্দও প্রকাশ করছে।আমি আশ্চর্যানিত যখন প্রথমআলো, বিবিসি বাংলা, রোয়ার বাংলা বা অনান্য মিডিয়ার ফেইসবুক পেইজে লোকজনের কমেন্ট দেখি, কেউ কেউ তো মৃত্যু সংবাদে হাসির রিএ্যাক্টও দেন। এইসব মর্মান্তিক সংবাদে ফেইসবুক ইউজারদের কমেন্ট ও রিএ্যাক্ট খুবই দুঃখজ্জনক, এর কারণ হিসাবে তথ্য প্রযুক্তির উন্নতি সাধনকে দায়ি করতেই হয়।
২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাতে আমরা সকলেই ২০২০ সালকে হ্যাপি নিউইয়ার বলে উদযাপন করেছি ঠিকই। কিন্তু ঠিক ৬ মাস পরে আমরা সকলেই বলছি ২০২০ যেমন বিষ নিয়ে আসল।
এই বছরই পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নিলেন বহু জ্ঞানী গুনী মানুষ। সাথে সাথেই আমরা প্রত্যক্ষ করছি করোনা নামক একটি অণুজীবের যা পুরো পৃথিবী জুড়ে মহামারি হিসাবে দেখা দিয়েছে, নিয়ে গেছে বহু মানুষের স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্খা। এখনো নিয়ে যাচ্ছে আর কতদিন এমন অবস্থা চলবে কেউই কিছু বলতে পারে না।
বহু রাষ্ট্র জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। সরকার নামিয়েছে সশস্ত্র বাহিনী। ঘোষণা করেছে সাধারণ ছুটির।শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে অনির্দিষ্টকালের জন্য, হয়েছে লক ডাউন, রেড জোন, গ্রিন জোন। কর্মক্ষেত্রের ব্যস্ততা চলে এসেছে শুন্যের কোঠায়। শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিক পড়াশোনা থেকে পেয়েছে দীর্ঘ ছুটি। যদিও কোন কোন ক্ষেত্রে অনলাইনে কাজ চলছে। এই সাধারণ ছুটি, লকডাউনের মধ্যে মানুষ সময় দিচ্ছে স্বীয় পরিবারকে। পাশাপাশি মানুষের একমাত্র সঙ্গী হয়েছে ইলেকট্রিক মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম; যেমন ফেইসবুক, ইউটিউব, গুগল, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি।
ভাবতেই আশ্চর্য লাগে, আগে যেরকম মানুষ টিভি দেখার জন্য একসাথে বসে থাকতো। এখন টিভি দেখার জন্য একত্রে বসে ঠিকই, কিন্তু সবার হাতে থাকে স্মার্ট ফোন, ট্যাব। বিষয়টি ভাবনার। এখন সবাই স্মার্ট ফোনে ব্যস্ত তারমানে এই হতে পারে যে আমরা একে অপরের "সাথে" আছি ঠিকই, কিন্তু "সঙ্গী" হতে পারি নি।। এমনকি ছোট ছোট শিশুরাও বিভিন্ন গেমইস্ ও কার্টুন নিয়ে ব্যাস্ত আর ব্যস্ত হবেই না বা কেন! এখনতো এই পৃথিবী এই স্মার্ট ফোনেই আটক বা বন্দী। পাশাপাশি স্মার্ট ফোনও আমাদেরকে বন্দি করে রেখেছে। আসলে এই বিষয়গুলো আমাদেরকে এগিয়ে দিচ্ছে না পিছিয়ে দিচ্ছে, তা অননুমেয়। একটা মজার বিষয় বলি- আমেরিকানরা মোবাইল ফোনকে নাম দিয়েছে সেল ফোন। হয়তো আমার ধারণা কাল্পনিক হবে। তবুও বলছি- এই সেল ফোন এখন মানুষের শরীরে অত্যাবশ্যকীয় সেলে-ই রুপান্ত হয়েছে। সেল ফোন ছাড়া আমরা একটি মুহূর্তও ভাবতে পারি না। ঠিক কিনা সকলেই অবগত আছেন।
আচ্ছা আগের কথায় ফিরে আসি। আমরা সবাই এখন স্মার্ট ফোনে আটক কথিত আছে এই করোনাকালে স্মার্ট ফোনের বিক্রি অন্যান সময় থেকে বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে কারণ, আমাদের মোলায়েম স্পর্শ আমাদেরকে নিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। একেক প্রান্তের বিভিন্ন ও ব্যাতিক্রম সংবাদ বা তথ্য নিয়ে আসা হয় আমাদের সামনে, এমন হতে হতে আমরাও অধীর আগ্রহে বসে থাকি আর তথ্যগুলোও আমাদের সামনে চলে আসে। বিপুল তথ্যের সমারোহে আমরা দিগ্বিদিগ হারিয়ে যাচাই বাছাই ছাড়াই লাইক কমেন্ট শেয়ার করি। এতে আমাদের দেশের ও পৃথিবীর কি অপূরণীয় ক্ষতি হয়ছে তা সকলেই অবগত আছেন। আবার এর দ্বারা যে ভাল কিছু হচ্ছে না তা নয়।
কিন্তু ক্রিমিনোলজি ও হিইউমেন সাইকোলোজি বলে- মানুষ মন্দের দিকেই ধাবিত হয় বেশি। বেশ কিছু ক্ষেত্রে আমাদেরও অবস্থা হয়ে তাই, আমরাও মন্দের দিকেই ধাবিত হচ্ছি, রিসেন্ট একটা উদাহরণ দিলেই বুঝবেন, আমাদের দেশের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যু, ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর মৃত্যু, সিলেটের মেয়র বদরউদ্দিন কামরান সাহেবের মৃত্যু সংবাদে কিছু শ্রেণী সমাজের মানুষ খুবই উচ্ছসিত এবং কোন কোন ক্ষেত্রে আনন্দও প্রকাশ করছে।আমি আশ্চর্যানিত যখন প্রথমআলো, বিবিসি বাংলা, রোয়ার বাংলা বা অনান্য মিডিয়ার ফেইসবুক পেইজে লোকজনের কমেন্ট দেখি, কেউ কেউ তো মৃত্যু সংবাদে হাসির রিএ্যাক্টও দেন। এইসব মর্মান্তিক সংবাদে ফেইসবুক ইউজারদের কমেন্ট ও রিএ্যাক্ট খুবই দুঃখজ্জনক, এর কারণ হিসাবে তথ্য প্রযুক্তির উন্নতি সাধনকে দায়ি করতেই হয়।
রাজনৈতিক বিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিক Christian Lous Lange ভাষ্য মতে, "Technology is useful servant but a dangerous master". বর্তমান সময়ের জন্য একটি যথাযথ উক্তি। সমসাময়িক কিছু ঘটনা যেমন এই উক্তিরই প্রতিফলন (আমরা প্রযুক্তিগত ভাবে যত এগিয়ে যাচ্ছি, পাশাপাশি অপরাধী মনমানসিকতাও আমরা এগিয়েছি। বিগত এক দশকে তথ্য প্রযুক্তির যেরূপ উন্নতি সাধন হয়েছে তাতে আমরা প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও বিশ্বকে দেখছি, শুনছি মতামত প্রদান করছি। এতে নিঃসন্দেহে আমদের আত্মবিশ্বাস বাড়ছে পাশাপাশি আমরা অপরাধীও হয়ে উঠছি কারণ তথ্য প্রযুক্তি সম্পর্কিত আইনকানুন ও বিধিমালার অজ্ঞতার অভাবে আমরা এমন কিছু কাজ করছি যা কোন ব্যক্তির চরম সম্মানহানি ও মানসিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।শুধু যে করোনাকালে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা নয় আগেও হয়েছে এখনোও হচ্ছে তবে আমি বর্তমান করোনাকালকেই বেছে নিয়েছি। তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে এইসব অনাকাঙ্খিত বিষয় বিশদাকারে সাইবার ক্রাইমের অন্তর্ভূক্ত।
সাইবার ক্রাইম বর্তমান বিশ্বে একটি বহুল আলোচিত বিষয়। সাইবার অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করলে বলা যায়, আধুনিক টেলিযোগাযোগ বা তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে কোন অপরাধ সংঘটন যা কোন ব্যাক্তি বা রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্মানহানি ঘটায় তাকে সাইবার অপরাধ বলে। যেমন : সোস্যাল যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যাচার, অপপ্রচার, সম্মানহানিকর উক্তি, হ্যাকিং ইত্যাদি।
এই ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমরা সবচেয়ে বেশি ফেইসবুক, ইউটিউব, টুইটারে মনের আবেগ অনুভূতি প্রকাশ করি। এই অনুভূতি প্রকাশে এমন কিছু লিখে ফেলি যা ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করে আবার অন্য কোন ফেইসবুক ইউজারের লেখা বা কোন ছবি শেয়ারও করি কিন্তু তথ্য প্রযুক্তির আইন ও বিধিমালার অজ্ঞতা হেতু আমরা জানতেই পারি না, কি কি বিষয় আমাদের শেয়ার করা প্রাসঙ্গিক আর কোন কোন বিষয় অপ্রাসঙ্গিক। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধানের ৩৯ (১) নং অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে কিন্তু ৩৯(২) নং অনুচ্ছেদে, কিছু বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তি সংগত বাঁধা নিষেধ সাপেক্ষে- (ক) প্রত্যেক নাগরিকের ভব ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতা ও (খ) সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দান করা হয়েছে।
এই অনুচ্ছেদে "আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তি সংগত বাঁধা নিষেধ সাপেক্ষে" বাক্যটি বিশেষ প্রাণিধানযোগ্য। আমাদের দন্ড বিধি ও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে সেই সকল যুক্তি সংগত বাঁধা নিষেধ উল্লেখ আছে। যদিও এই আইনের স্পষ্টতা অস্পষ্টতা নিয়ে তমুল বিতর্ক বিদ্যমান।
তা যাই হোক, আমার ভাষ্য হল, এই করোনা মহামারি সময়ে যেহেতু আমরা সামগ্রিক ভাবে ইন্টারনেটে বুঁদ হয়ে আছি আমাদেরকে অবশ্যই চোখ কান খোলা রাখতে হবে। যেকোন অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়িয়ে চলতে হবে যা আইনের চোখে দন্ডনীয়। এখন ইনফরমেশন টেকনোলজির যুগ, আপনারা ইচ্ছা করলেই বাংলাদেশ দন্ডবিধি ও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত, ২০১৩) পড়ে নিতে পারেন। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি এতে আপনার ক্ষতি হবে না বরং লাভই হবে, এতে সামাজিক দায়, কর্তব্য বাড়বে সাথে সমসাময়িক নতুন একটি আইনও জেনে নেওয়া যাবে।
আমাদেরকে অবশ্যই ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের যেমন আছে পারিবারিক দায়-দায়িত্ব ঠিক তেমনি আছে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়-দায়িত্ব। আসুন এই করোনা মহামারির সময়ে আমরা নিজের পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রকে সচেতনতার মাধ্যমে নিরাপদ রাখি ও নিজেও নিরাপদ থাকি পাশাপাশি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির গড্ডলিকা প্রবাহে ভেসে না গিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের, রাষ্ট্রের ও সমাজের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করি। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, দুটো ক্ষেত্রেই কিন্তু আমাদের সামাজিক সচেতনতার প্রয়োজন।
সর্বশেষে, আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে চাই পুলিশ ও স্বশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের, স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসকবৃন্দ ও স্বাস্থ্য কর্মীদের, ব্যাংক কর্মকর্তা কর্মচারীদের ও পরিছন্নতা কর্মীদেরকে, যাদের নিঃস্বার্থ সহায়তা ছাড়া আমরা আরোও কঠিন বিপদের সম্মুখীন হতাম এবং যারা দেশের মানুষকে রক্ষা করতে করোনা আক্রান্ত হয়ে জীবন উৎসর্গ করেছেন এবং এখনো উক্ত সেবায় নিয়োজিত আছেন। আরোও শ্রদ্ধার সহিত স্মরণ করতে চাই আমাদের আইনজীবীদের যারা এই করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুকে বরণ করেছেন।
সুজয় চৌধুরী, আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট, ঢাকা
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ