জসীম উদ্দীন মাসুদ
আপডেট: ১৫:২৫, ১৩ আগস্ট ২০২০
বঙ্গবন্ধুর যুব ভাবনা
যিনি জীবনের ৪০ শতাংশ সময় কাটিয়েছেন জেলে, ৪৮ শতাংশ সময় ব্যয় করেছেন আন্দোলন-সংগ্রামে, ঘুমিয়েছেন মাত্র ১২ শতাংশ অর্থাৎ দৈনিক তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বাধীন স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে আর বেঁচেছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর, দিনের হিসেবে ১৩১৪ দিন। এই অদীর্ঘ জীবনে কাজের মধ্য দিয়ে, ত্যাগের মধ্য দিয়ে, দেশপ্রেমের মধ্যদিয়ে, সাহস ও সততার মধ্যদিয়ে নিজেকে অমর ও অজেয় করে তুলেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁর যুব বয়সে ১৯৪৭ সালে। ব্রিটিশরা বিদায় নেয়ার পর পরই তাঁর মাথায় স্বাধীনতার স্বপ্নের এই বীজ রোপিত হয়েছিল। তিনি তখন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের শিক্ষার্থী। যুবক শেখ মুজিব তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ছাত্র কর্মীদের ডেকে বললেন, “স্বাধীনতা সংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি। এবার আমাদের যেতে হবে বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে। এই স্বাধীনতা স্বাধীনতাই নয়।” বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশের জন্ম হতো না- এই কথাটি সত্য প্রমাণ করার জন্য তাই আজ কোন বাঙালিকে আর প্রমাণ খুঁজতে হয়না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আদায়ের জন্য, বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন, বার বার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন, কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের মূল্যবান ৪৬৮২টি দিন।
বঙ্গবন্ধুর সংক্ষিপ্ত জীবন
খুব সংক্ষিপ্ত ছিলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন। ১৯২০ থেকে ১৯৭৫, সময়ের হিসাবে ৫৫ বছর ৪ মাস ২৯ দিন। ৩৭ বছরের সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনের ৩৩ বছর কেটে গেছে দেশটা স্বাধীন করতে করতে। যিনি জীবনের ৪০ শতাংশ সময় কাটিয়েছেন জেলে, ৪৮ শতাংশ সময় ব্যয় করেছেন আন্দোলন-সংগ্রামে, ঘুমিয়েছেন মাত্র ১২ শতাংশ অর্থাৎ দৈনিক তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বাধীন স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে আর বেঁচেছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর, দিনের হিসেবে ১৩১৪ দিন। এই অদীর্ঘ জীবনে কাজের মধ্য দিয়ে, ত্যাগের মধ্য দিয়ে, দেশপ্রেমের মধ্যদিয়ে, সাহস ও সততার মধ্যদিয়ে নিজেকে অমর ও অজেয় করে তুলেছিলেন। কখনও কখনও অপেক্ষাকৃত ছোট জীবনও যে দীর্ঘ জীবনকে ছাড়িয়ে যেতে পারে তার অনন্য উদাহরণ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যতকাল বাংলাদেশ থাকবে, বিজয়ী বাঙালির লাল-সবুজ পতাকা থাকবে, মধুমতি-ধানসিঁড়ি, পদ্মা-মেঘনা, গড়াই-কর্ণফুলি-সুরমা-কুশিয়ারা থাকবে, ততদিন থাকবেন বঙ্গবন্ধু।
যুবনীতি-২০১৭ এর ৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সের বাংলাদেশের যে কোন নাগরিক যুব বলে গণ্য হবে। এই অর্থে ১৯৩৮ সাল থেকে ১৯৫৫ পর্যন্ত সময়কাল ছিল বঙ্গবন্ধুর যুব জীবন। যৌবনের শুরুতেই ১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ আমলে তিনি প্রথম কারাভোগ করেছিলেন। গোপালগঞ্জ মিশনারী স্কুলে পড়াকালীন সময়ে তাঁর সহপাঠী বন্ধু আবদুল মালেককে সুরেন ব্যানার্জীর বাড়িতে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করার জন্য এলাকার নেতৃবৃন্দ অনুরোধ করলে তিনি ছুটে যান সেখানে এবং দরজা ভেঙ্গে জোর করে বন্ধুকে নিয়ে আসেন। বন্ধুকে বিপদে ফেলে তিনি একা বসে থাকতে পারেননি। সারাজীবন বন্ধুবৎসল শেখ মুজিবুর রহমান জীবনে প্রথবারের মতো বন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে মারামারিতে লিপ্ত হয়ে। শিক্ষাজীবনে সেই যে কারাগার জীবনের শুরু পুরো যৌবনে ওটা তাঁর নিজের হয়ে গিয়েছিল পরের কারণে।
ভালবাসতেন খেলাধুলা
লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলাকেও ভালবাসতেন বঙ্গবন্ধু। তিনি ছিলেন ভালো খেলোয়াড়ও। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পড়ার সময় ফুটবল মাঠ দাপিয়ে বেড়াতেন তিনি। এই স্কুলের হয়ে বাবা লুৎফর রহমানের অফিসার্স ক্লাবের বিপক্ষে খেলেছেন বেশ কিছু ফুটবল ম্যাচ, যা উপভোগ করতেন উৎসুক জনতা। নিজের স্কুলের ফুটবল দলে করেছেন অধিনায়কত্ব। বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তে বলেছেন, “আমি খেলাধুলাও করতাম। ফুটবল, ভলিবল ও হকি খেলতাম। খুব ভালো খেলোয়াড় ছিলাম না, তবুও স্কুলের টিমের মধ্যে ভাল অবস্থান ছিল।” ‘হাডুডু’র ভাল খেলোয়াড় শেখ মুজিব’ এই নামে টুঙ্গিপাড়ায় তাঁর খুব পরিচিতি ছিল। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশকে নতুনভাবে সাজাতে গিয়ে তাই ক্রীড়াঙ্গনের কথাও ভেবেছেন তিনি। তরুণদের বিপথগামী থেকে বাঁচাতে জোর দেন খেলাধুলার উপর। হাডুডু বা কাবাডিকে দেন জাতীয় মর্যাদা। গঠন করেছিলেন ‘বাংলাদেশ ক্রীড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থা (বর্তমানে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ), বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনসহ সকল ক্রীড়ার জন্য ভিন্ন ভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা। বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার বাফুফের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন সেই সময়ের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বলেন, “বিদেশে খেলতে গেলে বঙ্গবন্ধু সবসময় উৎসাহ দিতেন। তিনি বলতেন খেলায় ভাল করতে পারলে নতুন স্বাধীনতা পাওয়া বাংলাদেশকে সবাই সমীহ করবে। সবসময় বলতেন খেলা আর রাজনীতিকে আলাদা রাখতে।” এ জন্যই শেখ কামাল যখন আবাহনী ক্লাব গড়ে তুলছিলেন তখন বঙ্গবন্ধুর কড়া নির্দেশ ছিল, ‘রাজনীতিবিদদের ক্লাবের সংগে জড়িত রাখবে না।’
একজন সামাজিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ
জীবনের প্রথম থেকেই একজন সামাজিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাঙালির আর্থ-সামাজিক মুক্তির জন্যে তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। একেবারে ছাত্র জীবন থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এদেশের গরিব-দুঃখী মানুষের জন্যে তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। দরিদ্র বন্ধু আর অসহায় মানুষের মধ্যে নিজের ছাতা-চাদর-পরিধেয় বস্ত্র বিলিয়ে বেড়ানো বঙ্গবন্ধুর ছেলেবেলাতেই তাঁর ভেতর রোপিত হয়েছিল জনতার নীতি। তিনি ‘যুগান্তরের রাজনীতি’ করেছিলেন। তিনি শৈশব, কৈশোর, যৌবন থেকে বেড়ে উঠেছিলেন ইতিহাস বদলে দেয়ার জন্য। ১৯৩৮ সালে গোপালগঞ্জ পরিদর্শনে আসা তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং শিল্প মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পথ রুখে দিয়ে কিশোর মুজিব স্কুলের ভাঙা ছাদ মেরামতের দাবী তুলেছিলেন। এর ১০ বছর পর তিনি যখন গোপালগঞ্জ মুসলিম সেবা সমিতির সম্পাদক ছিলেন তখন তাঁর নেতৃত্বে ‘মুষ্টিভিক্ষা’র মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করে গরিব ছাত্রদের আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে লঙ্গরখানা খুলে দিনরাত পরিশ্রম করে মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। জীবনের প্রতিটি কাজেই মানুষের সুখে-দুঃখে এমনিভাবে তিনি জড়িয়ে পড়তেন।
ভেবেছেন উন্নয়নের কথা
বঙ্গবন্ধু হলেন সেই মানুষ যিনি সারাজীবন দেশ ও মানুষের পরিবর্তনের কথা ভেবেছেন, উন্নয়নের কথা ভেবেছেন। তাঁর উন্নয়নের মূলমন্ত্র ছিলো ধনী-দরিদ্র বৈষম্য কমিয়ে আনা, কর্মসংস্থান ও কর্মমুখী মানুষ তৈরি করা। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “বাংলার মানুষের জন্য আমার জীবনের যৌবন আমি কারাগারে কাটিয়ে দিয়েছি। মানুষের দুঃখ দেখলে আমি পাগল হয়ে যাই।” ১৯৭২ সালের ৯ মে রাজশাহীতে এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমার বাংলার বেকার যুবকেরা কাজ পাক। ...আমার সোনার বাংলার মানুষ প্রাণ ভরে হাসুক।”
আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ নয়, অর্জন যোগ্যতাবলে
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার বলেছিলেন, “এ জগতে কেউ কেউ জন্মগতভাবে মহান, কেউ মহত্তোর লক্ষণ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন, আবার কেউ স্বীয় প্রচেষ্টায় মহানুভবতা অর্জন করেন।” নিজের যোগ্যতাবলে যৌবনের শুরুতেই শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও সোহরাওয়ার্দীর মতো নেতার নজরে পড়েছিলেন তিনি। যৌবনে যা কিছু তিনি অর্জন করেছিলেন আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো কেউ তা তাকে দেয়নি, তিনি হাজারো ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে নিজের যোগ্যতাবলে তা অর্জন করেছেন। ১৯৪৫ সালে যখন শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, হেসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর আবুল হাশিমের মতো বাঘা বাঘা নেতাদের কর্মীদেরকে পেছনে ফেলে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বচিত হয়েছিলেন।
একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ
বঙ্গবন্ধু ছিলেন আগাগোড়া একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে মৌলনীতির ক্ষেত্রে অসাম্প্রদায়িক চেতনার পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় শান্তি স্থাপনে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নেতা হিসাবে তিনি যে অসম সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন তা তাবৎ নেতার দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছিল এবং পরবর্তী জীবনের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ভিত তৈরি করেছিল। বেরিবেরি বা গ্লুকোমা তার শিক্ষাজীবনকে থামিয়ে দিতে পারেনি, কিন্তু চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবীর প্রতি সহমর্মিতা জানাতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা জীবন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কতৃপক্ষের রোষানলে পড়ে।
১৯৪৯ সালের মার্চে এই ঘটনাটা বঙ্গবন্ধুর সাথে থেকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন কবি শামসুর রাহমান। এই অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে কবি শামসুর রাহমান বলেন, “দীর্ঘকায় কান্তিমান শেখ মুজিব তাঁর কথা এবং জ্বলজ্বলে দৃষ্টি দিয়ে আমাদের অনুপ্রাণিত করছিলেন, যোগাচ্ছিলেন সাহস। সেদিন ঘোড়ার পায়ের নিচে পড়ে থেঁতলে গেলেও হযতো কোনো খেদ থাকতো না। প্রকৃত নেতার প্রেরণার শক্তি বোধহয় এইরকমই হয়।” শুধু একটি নয়, এমন অসংখ্য ঘটনার মধ্য দিয়েই যুবক শেখ মুজিব ধাপে ধাপে হয়ে উঠে এসেছেন বাঙালির হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু হয়ে, জাতির পিতা হয়ে। ৬১ বছর পর সেই সিদ্ধান্তকে অনৈতিক ও অগণতান্ত্রিক বলে আখ্যায়িত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দিয়েছে ২০১০ সালের ১৪ আগস্ট। কিন্তু তখন তার সেই উচ্ছল যৌবন নেই, তিনিও বেঁচে নেই এই ধরাধমে।
ছিলেন দৃঢ়চেতা ও সিদ্ধান্তে অটল
বঙ্গবন্ধু ছিলেন দৃঢ়চেতা ও সিদ্ধান্তে অটল। জেল-জুলুমকে পরোয়া করতেন না তিনি। সরকারি গোয়েন্দারা বিভিন্ন সময়ে তাঁর কাছ থেকে মুচলেকা আদায়ের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু জানতেন মুচলেকা দেয়া মানেই নিজের নীতি ও চিন্তাভাবনা বিসর্জন দিয়ে বিরুদ্ধবাদীর সাথে আপোষ করা। দীর্ঘ দিন কারাগারে রেখেও তাই এই মানুষটিকে তাঁর নীতি থেকে বিন্দুমাত্র টলানো যায়নি। ১৯৫১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জনৈক গোয়েন্দা বঙ্গবন্ধুর সাথে খুলনা কারাগারে দেখা করে ২৬ ফেব্রুয়ারি যে রিপোর্ট দেন তাতে লিখেন, “হি ওয়াজ নট উইলিং টু এক্সিকিউট এনি বন্ড ফর রিলিজ ইভেন ইফ দ্য ডিটেনশন উড কজ হিম টু ফেস ডেথ (যদি তাঁর অন্তরীণ থাকাটা তাঁর মৃত্যুও ডেকে আনে, তবু তিনি কোন মুচলেকায় স্বাক্ষর করবেন না)।
নবগঠিত পাকিস্তানে তিনি প্রথম গ্রেফতার হয়েছিলেন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে ধর্মঘট করতে গিয়ে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। বঙ্গবন্ধুর নেতা সোহরাওয়ার্দী উর্দুর পক্ষে ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে এক চিঠিতে অনুরোধ করেছিলেন, বাংলাকে আঞ্চলিক ভাষা হিসাবে মেনে নিতে এবং রাষ্ট্রভাষা হিসাবে উর্দুকে মেনে নিতে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তা মেনে নেননি। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে তিনি ছিলেন অনড়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ পাঁচজন শিক্ষার্থী বহিষ্কৃত হন এবং কতৃপক্ষ থেকে বলা হয় ১৭ এপ্রিলের মধ্যে মুচলেকা দিলে তাদের বহিষ্কারাদেশ বাতিল করা হবে। চারজন শিক্ষার্থী কল্যাণ চন্দ্র দাশ গুপ্ত, নাঈম উদ্দিন আহমেদ, নাদেরা বেগম ও মুহাম্মদ আবদুল ওয়াদুদ মুচলেকা দিয়ে তাদের ছাত্রত্ব ফিরিয়ে নিলেও বঙ্গবন্ধু তাঁর নীতিতে ছিলেন অবিচল।
একজন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চেতনার মানুষ
বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চেতনার মানুষ। নিয়ম করে প্রতিটি পত্রিকা পড়তেন তিনি। বঙ্গবন্ধু ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তে বলেছেন, “আমার আব্বা খবরের কাগজ রাখতেন। আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত। ছোটকাল থেকেই আমি সকল কাগজই পড়তাম।” এই পড়ার নেশা থেকেই বঙ্গবন্ধুর সবকিছু জানা হয়ে যেত। বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকতাও করেছেন দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকায়। বঙ্গবন্ধু সবসময় সত্য কথা বলতেন এবং সোজাসুজি কথা বলতে পছন্দ করতেন। ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষ ড. আই এইচ জুবেরি এবং অন্যান্য শিক্ষকরা এজন্যে তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। আব্বাসউদ্দিন আহমেদ, সোহরাব হোসেন, বেদার উদ্দিনের গান মুগ্ধ হয়ে শুনতেন বঙ্গবন্ধু। নিজেও মাঝে মাঝে গাইতেন। রবীন্দ্র সংগীত এবং রবীন্দ্র সাহিত্য ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’-কে জাতীয় সংগীতের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। যৌবনের কবি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলকে তিনি ভালোবাসতেন এবং বিভিন্ন আসরে তাঁর গানও শুনতেন। বিদ্রোহী কবিকে নিজ উদ্যোগে অনেক ঝুঁকি নিয়ে ১৯৭২ সালের ২৪ মে কলকাতা থেকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিলেন এবং তাঁকে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়েছিলেন। ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু এমন এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন যার কারণে বিশ্বব্যাপী নিজেই রাজনীতির কবি হয়ে গিয়েছিলেন।
ডিজিটাল প্রযুক্তি বিকাশের বীজ বপণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু
আমাদের জন্য আশা জাগানিয়া একটি সংবাদ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে আউটসোর্সিংয়ে বাংলাদেশ এখন দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। প্রথম অবস্থানে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে। আমাদের যুবসমাজই কিন্তু এই অর্জনে শতভাগ কৃতিত্বের দাবীদার। এই করোনাকালে দাপ্তরিক কার্যক্রম, অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম, টেলিমেডিসিন, দৈনন্দিন সভা ও নানা যোগাযোগ কার্যক্রমের কারণে ডিজিটাল প্রযুক্তি আমাদের কাছে এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর পেছনেও কিন্তু বঙ্গবন্ধুর রয়েছে অসামান্য অবদান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন্স ইউনিয়নের সদস্যপদ অর্জন এবং ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বেতবুনিয়ায় উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ডিজিটাল প্রযুক্তি বিকাশের যে বীজ বপণ করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প ২০২১ এর মাধ্যমে তা আজ এক মহীরুহে নিয়ে গেছেন।
মহাকাশে আজ বাংলাদেশের পতাকা উড়াচ্ছে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট। ২০২১ সালে ফাইভ-জি যুগে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ। ৩৮০০ ইউনিয়নে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পৌঁছে দেয়া হয়েছে। ৭৭৭টি ইউনিয়নে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পৌঁছে দেয়ার কাজ চলছে। দেশের হাওর, দ্বীপ, চরাঞ্চল ও অন্যান্য দূর্গম এলাকায় বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে উচ্চগতির ইন্টারনেট পৌঁছানোর কাজ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ ২০২১ সাল নাগাদ আইসিটি সেক্টরে ১০ লাখ তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থান এবং ৫ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে যুবশক্তির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে
আজ আন্তর্জাতিক যুব দিবস। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ যুবক। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় Youth Engagement for Global Action যার বাংলা ভাবানুবাদ করা হয়েছে ‘বৈশ্বিক কর্মে যুব শক্তি’। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে আমাদের সকল সংগ্রামে-সাফল্যে ছিল যুবশক্তির অভূতপূর্ব অংশগ্রহণ। এবার বিশ্ব জয়ের স্বপ্নপূরণে এগিয়ে যাক বাংলাদেশের তারুণ্য। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে আমাদের বিশাল যুবশক্তির খ্যাতি নিজের দেশের গন্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে।
শেষ কথা
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ এবং ‘আমার দেখা নয়াচীন’ তিনটি বইতেই বঙ্গবন্ধু তাঁর যৌবনের দিনগুলোর স্মৃতি রোমন্থন করেছেন। কবি হেলাল হাফিজ লিখেছিলেন, “এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, মিছিলের সব হাত কণ্ঠ পা এক নয়।” বঙ্গবন্ধুর সারাটা জীবন ছিল যৌবনের, মিছিল আর যুদ্ধের। কিন্তু সেই শৈশব-কৈশোর থেকেই বঙ্গবন্ধু বেড়ে উঠেছিলেন অন্যরকম এক মানুষ হয়ে। তাইতো যৌবনের মিছিলে যৌবনের যুদ্ধে তাঁর হাত উত্তোলিত হতো সবার আগে আলাদা হয়ে। সবকিছু ছাড়িয়ে সর্বক্ষণ তাঁর মন কাঁদতো বাংলার মানুষের জন্যে। বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবেন, সোনার বাংলা গড়বেন- এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের একমাত্র ব্রত। আজকের যুবকদের মনে সেই ভাবনাটা এলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা এবং তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০৪১ সালে সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা সময়ের ব্যাপার মাত্র। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, ন্যায়-নীতি, চিন্তা ও কর্ম থেকে যদি আমরা শিক্ষা নিতে পারি তবে এই সোনার মানুষেরা সোনার বাংলা গড়ে তুলবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
জসীম উদ্দীন মাসুদ, কলাম লেখক, আইনিউজ
খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ