স্বপন নাথ
আপডেট: ২২:০৭, ১৬ আগস্ট ২০২০
বঙ্গবন্ধু: লেখক ও মানবসত্তা
‘‘আমার মনে আছে খুবই গরিব এক বৃদ্ধ মহিলা কয়েক ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। শুনেছে এই পথেই আমি যাব, আমাকে দেখে আমার হাত ধরে বলল, ‘বাবা আমার এই কুঁড়েঘরে তোমায় একটু বসতে হবে।’ আমি তার হাত ধরেই তার বাড়িতে যাই। অনেক লোক আমার সাথে, আমাকে মাটিতে একটা পাটি বিছিয়ে বসতে দিয়ে এক বাটি দুধ, একটা পান ও চার আনা পয়সা এনে আমার সামনে ধরে বলল, ‘ খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছুই নাই।’ আমার চোখে পানি এল। আমি দুধ একটু মুখে নিয়ে, সেই পয়সার সাথে আরও কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে বললাম, ‘তোমার দোয়া আমার জন্য যথেষ্ট, তোমার দোয়ার মূল্য টাকা দিয়ে শোধ করা যায় না।’
‘যেখানে ঘুমিয়ে আছ, শুয়ে থাকো
বাঙালির মহান জনক
তোমার সৌরভ দাও, দাও শুধু প্রিয়কণ্ঠ
শৌর্য আর অমিত সাহস
টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে আমাদের গ্রামগুলো
তোমার সাহস নেবে।
নেবে ফের বিপ্লবের দুরন্ত প্রেরণা।’
[কামাল চৌধুরী: টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে]
বাংলাদেশ, বাঙালি ও বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের সাথে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নাম অবিচ্ছিন্ন। গৌরবের ১৯৭১ তৈরি হতো না বঙ্গবন্ধু ছাড়া, তা বলাই বাহুল্য। তাঁর পরিচিতি বিশেষায়নে আমরা উচ্চারণ করি,- ‘বঙ্গবন্ধু’ এবং ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’। কখনও নামের বিকল্পেও বলি। এসবের তাৎপর্য কী। বস্তুত, এ-শব্দ ও বাক্যের মধ্যে নিহিত রয়েছে বাঙালির জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, দ্রোহ, গ্রহণ-বর্জনের ধারাবাহিক কালক্রম। ধাপে ধাপে, ইতিহাসের একটি সন্ধিক্ষণে, একজন শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু ও শ্রেষ্ঠ বাঙালি। এ বিষয় বুঝে নিলে অংশত শেখ মুজিবুর রহমানকে জানা হয়ে যায়। মূলত, তিনি লড়াই সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বাঙালির ইতিহাসকে পুনর্গঠন করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিসত্তা, লেখকসত্তা ও মানবসত্তা জানা-বোঝা এবং ইতিহাস-ধারণা স্পষ্টকরণে শেখ মুজিবুর রহমান রচিত অমূল্য তিনটি গ্রন্থ বাঙালি পাঠকের জন্য আবশ্যিক পাঠ্য।
১. অসমাপ্ত আত্মজীবনী (দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লি, ২০১২);
২. কারাগারের রোজনামচা (বাংলা একাডেমি, ২০১৭);
৩. আমার দেখা নয়াচীন (বাংলা একাডেমি, ২০২০)।
বাংলাদেশের ইতিহাস, বাঙালিত্বের তাৎপর্য জানতে গ্রন্থগুলো স্বীকৃত আকর। ফলে, এ তিনটি বই বারবার পাঠ করতে হয়। ভাবতে থাকি, এসব পাণ্ডুলিপি যদি উদ্ধার বা প্রকাশ না হতো তা হলে কি হতো? এমন প্রশ্নের উত্তর মূল বই তিনটি থেকে উদ্ধার করা যে কোনও পাঠকের জন্য সমীচীন বলে মনে করি। এ পরিসরে গ্রন্থ তিনটির আলোকে বঙ্গবন্ধুর কৃতি ও মানবসত্তাকে অবলোকনের চেষ্টা করা হয়েছে। সংগত কারণে এ-আলোচনা থেকে গেলো অসম্পূর্ণ। লেখকসত্তা নির্মিত হয় অপরাপর সত্তার অভিঘাতে। তা হলে এ-সত্তার মাধ্যমে খুঁজবো অপর সত্তাগুলো। আর উল্লিখিত অস্তিত্বে খুঁজে নেবো অনুচ্চারিত উপাদানসমূহ।
লক্ষণীয়, তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে নেতৃত্ব, সংগঠন, রাজনীতি, আন্দোলন ও সংগ্রামে। অবশিষ্টাংশ কারাগারে। ফলত, তাঁর অভিজ্ঞতার পরিধি বিস্ময়কর, যা অতুলনীয়।
এ তিনটি বই পড়ে মনে হয়, একজন মহত লেখকের বৈশিষ্ট্য ছড়িয়ে আছে সবখানে। এর কারণ দু-টো: প্রথমত: মৌলিক চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা। দ্বিতীয়ত: জটিল বিষয়ের সরল উপস্থাপন। এ ছাড়াও উপর্যুক্ত গ্রন্থসমূহে সাক্ষাত ঘটে একজন তুলনারহিত হৃদয়বান ব্যক্তির সাথে। যাঁর দেশপ্রেম, ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়, বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও মনুষ্যত্বে আর কারও তুলনা হয় না।
২.
জীবনের অনেকান্তে কেবলই দ্রোহ। এর মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিকামী বাঙালির আপনজন। তা কি শুধু রাজনীতি বা তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতার জন্য? মূলত, এ-সবই আছে। তবে, জন্মমাটির সাথে নিষ্ঠার সম্পর্ক ও গভীর সম্পর্ক না থাকলে তা সম্ভব নয়। বাংলার পলিমাটির গন্ধ তাঁর দেহে ও মনে। এ-দেশের প্রকৃতি, নদী, জলের তরঙ্গ কণায় তাঁর জীবনের আখ্যান। বিদ্রোহ, ভালোবাসায় এ-রূপসী বাংলা আর বঙ্গবন্ধু একাকার। লোকবাংলার গীতল আবহাওয়ায় তাঁর বড় হয়ে ওঠা। একই সাথে তাঁর চিন্তনে বৈশ্বিক সংস্থানও আমাদের বিস্মিত করে। এ-সূত্রে তাঁর মননও অভিব্যক্তির প্রকাশ আমরা পর্যবেক্ষণ করি। সংগ্রাম, লেখা, কথা ও ভাষণে। স্মরণীয়, করাচি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। প্রকৃতির ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে নির্ণিত হয় প্রতিটি এলাকার মানুষের আচরণগত ভূগোল। ঐতিহাসিক সত্য হলো- বাঙালি নিসর্গ-স্নাত জনগোষ্ঠী। তিনি এ-লোকবাংলার উপকরণের আলো ও আবহে নিজেকে নির্মাণ করেছেন। চমৎকার প্রকৃতি ও জলবায়ু প্রভাবান্বিত পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের মানস প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্যের বিভাজন রেখা চিরসত্য। তিনি খুব সহজ ভাষায়তা উপস্থাপন করেছেন। নিত্য-কারাগারে অন্তরীণ, বা দেশের বাইরে গেলে তাঁর মানব সঙ্গী ছিলো এ-ই গ্রাম, ও বাংলার সাধারণ মানুষ। বঙ্গবন্ধু ব্যাখ্যা করেছেন মানুষের প্রবৃত্তি গঠনে প্রকৃতির আবেদন ও প্রভাব :
(ক) ‘আমি এই প্রথম করাচি দেখলাম; ভাবলাম এই আমাদের রাজধানী! বাঙালিরা কয়জন তাদের রাজধানী দেখতে সুযোগ পাবে! আমরা জন্মগ্রহণ করেছি সবুজের দেশে, যেদিকে তাকানো যায় সবুজের মেলা। মরুভূমির এই পাষাণ বালু আমাদের পছন্দ হবে কেন? প্রকৃতির সাথে মানুষের মনেরও একটা সম্বন্ধ আছে। বালুর দেশের মানুষের মনও বালুর মত উড়ে বেড়ায়। আর পলিমাটির বাংলার মানুষের মন ঐ রকমই নরম, ঐ রকমই সবুজ। প্রকৃতির অকৃপণ সৌন্দর্যে আমাদের জন্ম, সৌন্দর্যই আমরা ভালবাসি।’ [অসমাপ্ত আত্মজীবনী: ২১৪-২১৫]
(খ) ‘গ্রামে গ্রামে আনন্দ ছিল, গান বাজনা ছিল,জেয়াফত হতো, লাঠি খেলা হতো, মিলাদ মাহফিল হতো। আজ আর গ্রামের কিছু নাই। মনে হয় যেন মৃত্যুর করাল ছায়া আস্তে আস্তে গ্রামগুলিকে প্রায় গ্রাস করে নিয়ে চলেছে। অভাবের তাড়নায়, দুঃখের জ্বালায় আদম সন্তান গ্রাম ছেড়ে চলেছে শহরের দিকে। অনেকক্ষণ শুয়ে শুয়ে ছোটবেলার কত কাহিনীই না মনে পড়ল। কারণ, আমি তো গ্রামেরই ছেলে। গ্রামকে আমি ভালোবাসি।’ [কারাগারের রোজনামচা :১৫৩]
দিনের পর দিন কারাগারের ভেতর। সুযোগ পেলে এ-ক্ষুদ্রত্বে ফুল বাগানে হাঁটতেন; বিভিন্ন ধরনের পাখির কলকাকলি শুনে আনন্দ পেতেন। কখনও তিনি উপভোগ করতেন কারাগারের উদ্যানে পাখি দলের এলোমেলো ভ্রমণ। কারাবাসের দিনগুলোতে একজোড়া হলুদ পাখির সাথে তিনি কথাও বলতেন। বুঝে নেই, তিনি একজন নিসর্গ বান্ধব ব্যক্তি। তাঁর কথায় : ‘গাছপালা, হলদে পাখি, চড়ুই পাখি আর কাকই তো আমার বন্ধু এই নির্জন প্রকোষ্ঠে। যে কয়টা কবুতর আমার বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছে তারা এখানে বাচ্চা দেয়। কাউকেও আমি ওদের ধরতে দেই না।… আমি অবাক হয়ে ওদের কীর্তিকলাপ দেখি। …কাকের কাছে আমি পরাজিত হয়েছি।… লোহার তার কি সুন্দরভাবে পেঁচাইয়া ওরা বাসা করে। মনে হয় ওরা এক এক জন দক্ষ কারিগর, কোথা হতে সব উপকরণ যোগাড় করে আনে আল্লাহ জানে।’ [কা রো: ২১৯] বাংলার মুক্ত আকাশ তাঁর খুব প্রিয়। কারাসেল থেকেও এ-খোলা আকাশ দেখতে চেয়েছেন। কিন্তু, সেখানে কারাগারের দেয়ালই কেবল বাধা।
তিনি মনে-প্রাণে-চিন্তা-অনুভবে একজন বাঙালি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হলেও তিনি পূর্বপাকিস্তান বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন নি। তিনি বলতেন পূর্ববাংলা। চেতনায় তাঁর বাঙালি জাতিত্ব ও সংস্কৃতির নির্যাস। লোকবাংলার বৈচিত্র্যের মধ্যেই ঐক্য- এ-চেতনার স্বয়ং প্রতিনিধি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। লক্ষ করি, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে বাঙালি সংস্কৃতির আবহে। এজন্য সব সময় তাঁর চেতনায় দোলা দিত বাঙালি সংস্কৃতির নান্দনিকতা। এ বিবেচনায় বঙ্গবন্ধু ১৯৫৫ সালে গণপরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে পূর্ব বাংলা নাম প্রস্তাব করেন। তাঁর অনুধাবন-পাকিস্তানের খোলসে থাকলে বাংলার কোনও কিছুরই অবশেষ থাকবে না।
তিনি শুধু যে রাজনৈতিক কর্মে সক্রিয় ছিলেন তা নয়। সুযোগ পেলেই গ্রন্থ পাঠে নিমগ্ন হতেন। আর গান শোনা তো আছেই। চীন ভ্রমণেও সেখানের প্রকৃতি ও মানুষ দেখে বাংলার প্রকৃতি তাঁর অন্তরে জেগে উঠেছে বারবার। তাঁর বর্ণনায়,- ‘আমি বাহিরের দিকে চেয়ে দেশটাকে ভালো করে দেখতে লাগলাম। মনে হলো এ তো আমার পূর্ব বাংলার মতো সকল কিছু। সবুজ ধানের ক্ষেত, চারদিকে বড় বড় গাছ। মাঝে মাঝে মাটির ঘরের গ্রাম, ছোট ছোট নদী, ট্রেনটা পার হয়ে যাচ্ছে। অনেকে আবার কোদাল দিয়া জমি ঠিক করছে। বেশ লাগছে দেশটা।’ [আমার দেখা নয়াচীন : ৩২]
এক্ষেত্রে এ-বইয়ের ভূমিকায় শেখ হাসিনা (মাননীয় প্রধানমন্ত্রী) যথার্থই বলেছেন- ‘এই ভ্রমণ কাহিনি যতবার পড়েছি আমার ততবারই মনে হয়েছে যে তিনি গভীর পর্যবেক্ষণ করেছেন প্রতিটি ক্ষেত্রে। তার কারণ হলো তাঁর ভেতরে যে সুপ্ত বাসনা ছিল বাংলার মানুষের মুক্তির আন্দোলন ও স্বাধীনতা অর্জন সেটাই বারবার ফুটে উঠেছে আমার মনে, এ-কথাটাও অনুভব করেছি।’ [প্রাগুক্ত: ১৫]
লোকায়ত ভাবের প্রতি তাঁর চির-আসক্তি। যে কারণে তিনি ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন চিরায়ত শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের ভক্ত। একবার নবীনগর থেকে ফেরার পথে আব্বাস উদ্দিনের গান শুনেছেন নৌকায় বসে। তাঁর বর্ণনাও তাৎপর্যময়: ‘নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তাঁর গান শুনছে।’ [ অ আ : ১১১]
সেদিন বাঙালি সংস্কৃতি ও বাংলা গান প্রসঙ্গে দু-জনার সংলাপও হয়েছিলো। আলাপচারিতায় আব্বাস উদ্দিন তাঁকে বলেছেন,- ‘মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালবাস, এর মাধুর্যও মর্যাদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।’ আমি কথা দিয়েছিলাম এবং কথা রাখতে চেষ্টা করেছিলাম।’’[অ আ : ১১১]
তাঁকে বারবার কারাগারে অন্তরীণ রাখা ছিলো পাকিস্তান সরকারের প্রকল্প। প্রসঙ্গত, তাঁর কনিষ্ঠ সন্তান শেখ রাসেল, কারাগারকে বলতেন- ‘আব্বার বাড়ি’। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন,-‘‘দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতোই ‘আব্বা আব্বা’ বলে চিৎকার করছে। জেল গেট দিয়ে একটা মালবোঝাই ট্রাক ঢুকেছিল। আমি তাই জানালায় দাঁড়াইয়া ওকে আদর করলাম। একটু পরেই ভিতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে ‘আব্বার বাড়ি’। এখন ওর ধারণা হয়েছে এটা ওর আব্বার বাড়ি।’ [কা রো : ৯৩]
কারাগারে বই পড়া ছাড়া বিভিন্ন সময় কয়েদিদের কাছে তিনি গান শুনতেন। তাদের সাথে গানের আসর বসাতেন। প্রসঙ্গত, তাঁকে যে সেলে রাখা হয়েছিলো এর পাশেই ছিলো অপ্রকৃতিস্থদের সেল। ফলে, তাঁর সেল থেকেই তিনি শুনতেন পাগল কয়েদিদের অসংলগ্ন সংলাপ ও গান। তাদের মাঝেই ফণী নামের একজনকে তিনি আবিষ্কার করেন। যে,‘দেহতত্ত্ব, মারফতী, কীর্তন মন্দ গায় না। দেশে দেশে গান গেয়ে বেড়াতো। যখন সে গান গায় মনে হয় কোথায় যেন চলে গিয়াছে আর এ দুনিয়ায় নাই। একটার পর একটা গান গেয়ে চলে। কত গান যে সে জানে তার কোনো ঠিক নাই। অফুরন্ত ভাণ্ডার।’ [কা রো : ৬৪] এ ছাড়াও ডাকাতি মামলার আসামি- নুরুদ্দিনের কণ্ঠে মাটিরগান শুনে তিনি আপ্লুত হয়েছেন।
চীনের শান্তি সম্মেলনেও পাকিস্তানের প্রতিনিধি দলের একজন হয়ে তিনি বাংলা ভাষাকে উচ্চকিত করেছেন। কারণ, মাতৃভাষা, জাতিসত্তা, অস্তিত্ব ও অধিকারের সাথে সম্পর্কিত। তাঁর ভাবনার কথা,- ‘কেন বাংলায় বক্তৃতা করব না? ভারত থেকে মনোজ বসু বাংলায় বক্তৃতা করেছেন। পূর্ব বাংলার ছাত্ররা জীবন দিয়েছে মাতৃভাষার জন্য। বাংলা পাকিস্তানের সংখ্যা গুরু লোকের ভাষা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন দুনিয়ায় অন্যান্য দেশেও আমি খুব কম দেখেছি। আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি। তবু আমার মাতৃভাষায় বলা কর্তব্য।’ [অ আ: ২২৮]
এত ভালোবাসা ও নিবিষ্টতার মাঝে তিনি ভুলেননি বাঙালির স্ববিরোধী চরিত্র। এমন সতর্কতা রাজনীতিতে খুব প্রয়োজন। এক্ষেত্রে তিনি চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন বাঙালির দ্বিধা। নির্ণয় করেছেন বাঙালির অধঃপতনের মূল বীজ কোথায় নিহিত। এ-প্রসঙ্গে তাঁর অন্তরদহন উল্লেখযোগ্য : ‘বাংলাদেশ শুধু কিছু বেঈমান ও বিশ্বাসঘাতকদের জন্যই সারাজীবন দুঃখ ভোগ করল। আমরা সাধারণত মীর জাফর আলি খাঁর কথাই বলে থাকি।… এরপরও বহু বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এই বাঙালি জাত। একে অন্যের সাথে গোলমাল করে বিদেশি প্রভুকে ডেকে এনেছে লোভের বশবর্তী হয়ে।… পাকিস্তান হওয়ার পর দালালি করার লোকের অভাব হলো না- যারা সব সময় সবকিছুই পশ্চিম পাকিস্তানে দিয়ে যাচ্ছে সামান্য লোভে। বাংলার স্বার্থ রক্ষার জন্য যারা সংগ্রাম করছে তাদের বুকে গুলি করতে বা কারাগারে বন্দি করতে এই দেশে সেই বিশ্বাসঘাতকদের অভাব হয় নাই। এই সুজলা-সুফলা বাংলাদেশ এত উর্বর; এখানে যেমন সোনার ফসল হয়, আবার পরগাছা আর আগাছাও বেশি জন্মে। জানি না বিশ্বাসঘাতকতার হাত থেকে এই সোনার দেশকে বাঁচানো যাবে কি না।’[কা রো:১১১-১১২]তাঁর ব্যাখ্যাসূত্রে প্রশ্ন জাগে- বিশ্বাসঘাকতার বৈশিষ্ট্য কি এ-বাঙালির জাতির পরম্পরা?তবে সমূহ নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য থেকে উত্তরণে তিনি চেয়েছেন বাঙালির পুনরুজ্জীবন। উল্লেখযোগ্য যে, বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান থাকা সত্ত্বেও বিশ্বাসঘাতকদের কাছে তাঁকে সপরিবারে জীবন দিতে হলো। এর চেয়ে বড় ট্রাজেডি আর কী হতে পারে।
৩.
লক্ষণীয়, শুরু থেকেই পাকিস্তান হয়ে ওঠে অস্বাভাবিক ও ভারসাম্যহীন রাষ্ট্র। এবং সে ক্ষয়রোগ থেকে এখনও মুক্ত হতে পারেনি। মূলত, ১৯৪৭ থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রাষ্ট্র ও সমাজনীতি ছিলো এলোমেলো। বাংলা ভাষা রুদ্ধ করে উর্দু ভাষা চাপানোর ষড়যন্ত্রও সাধারণ জনগণ বুঝে নিয়েছিলো। ফলে, সে সময়ই বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করেন যে, ঘুরে দাঁড়াতে হবে বাঙালিকে। বঙ্গবন্ধুর এ-উপলব্ধির সক্ষমতার সাথে অন্য কারও তুলনা চলে না। বস্তুত, সাধারণের মনের ভাষা পাঠ করেছেন বঙ্গবন্ধু। পরিণামে বাংলা ও বাঙালির মুক্তির লক্ষে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। এজন্য ইতিহাসের পূর্বাপর কিছু ঘটনা বিবেচনায় রাখতে হয়।
এক পর্যায়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের সমান্তরালে অযৌক্তিকভাবে পাকিস্তান আন্দোলন হয়নি। সারা ভারতবর্ষে গরিব, দলিত, মর্যাদাহীন হিন্দু ও মুসলিমরা বঞ্চনায় ছিলো নিমজ্জিত। তারা, সামন্ত, ক্ষমতাবান, ব্রাহ্মণ, ধনী ব্যবসায়ী, জমিদারদের কাছে ছিলেন শোষিত ও নির্যাতিত। এর ভেতর সাধারণ মানুষের মধ্যে বুদবুদ হলেও জাগরণ তৈরি হয়। তবে, হিন্দু, মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের শোষকগোষ্ঠীর শক্তি ও ক্ষমতার নিচে চাপা পড়ে যায় সাধারণ মানুষের মুক্তির আশ্বাস। ফলত, শ্রেণিশোষণ, সামাজিক অসমতাকে চাপা দেওয়া হলো সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত প্লাবনে। এর সাথে যুক্ত রয়েছে ভারতবর্ষের বহুস্তরীভূত সমাজ ব্যবস্থা। ফলে,মর্যাদা ও শোষণের প্রশ্নে গরিব ও শোষিত মানুষের সংগ্রাম সক্রিয় রইলো না। এর অপ্রিয় পরিণাম হলো দু-টো : একটি ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবর্ষের বিভক্তি, অন্যটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এ দু-টি ঘটনায় এ-উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক ভাবধারা ও চর্চাপ্রায়-স্থায়ী হয়ে গেলো। সে-সময়ের ক্ষত এখনও শোকায়নি। মানুষের মনোজগত হলো দ্বিধা-বিভক্ত ও সামজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো সাম্প্রদায়িকতা। এ-সমস্যার সাথে দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অপুষ্টি, দুর্নীতি, হিংসা, মারামারি, এবং বিভক্তি বিদায় করা যায়নি এখনও। বঙ্গবন্ধু এতসব নেতিবাচক পরিস্থিতির মধ্যেও নিজেকে দূরত্বে রেখেছিলেন। তিনি তাঁর মহাজীবনকে নিয়োজিত রেখেছেন এসব অমানবিক সমস্যাসমূহ সমাধানে। আন্দোলনের ধাপে ধাপে তিনি জেনে নিয়েছিলেন- বাঙালির মধ্যে অধিকাংশই তাঁকে ভালোবাসে, আবার তাঁকে অনেকেই ঈর্ষায় অপছন্দ করে। এক্ষেত্রে তাঁর জীবন উপলব্ধিও ভিন্ন। ‘কত মানুষ আমাকে ভালবেসেছে, কতজন আবার ঘৃণাও করেছে। একাকী বসে সে কথাও ভাবি। আমার যেমন নিঃস্বার্থ বন্ধু আছে, আমার জন্য হাসতে হাসতে জীবন দিতে পারে, তেমনই আমার শত্রু আছে, যারা হাসতে হাসতে জীবনটা নিয়ে নিতে পারে। আমাকে যারা দেখতে পারেন না, তাঁরা ঈর্ষার জন্যই দেখতে পারেন না। জীবনে আমার অনেক দুঃখ আছে সে আমি জানি, সেই জন্য আমি নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছি।’ [কা রো : ১৭২-১৭৩]
কৈশোর, তরুণ ও যৌবনে তিনি হিংসা, দাঙ্গা-ফ্যাসাদ বহু দেখেছেন। কিন্তু সচেতনভাবে নিজেকে এসব থেকে সরিয়ে রেখেছিলেন। এ কারণেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাঙালির কাছে সর্বজনীন নেতা, ত্রাতা। শ্রেণিদ্বন্দ্ব ও মর্যাদার প্রশ্নে তিনি শোষণ, বঞ্চনার বিপক্ষে আন্দোলন করেছেন এবং উপনিবেশথেকে মুক্তি কামনায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা চেয়েছেন। তাঁর ধারাবাহিক আন্দোলন সংশ্লিষ্টতার যৌক্তিকতাআবার প্রমাণিত হলো পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনে। শুধু বঙ্গবন্ধু নয়, যারাই এক সময় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় লড়াই করেছেন, তারাই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। লক্ষ একটাই - স্বাধীনতা ও মুক্তি।
অপ্রিয় সত্য যে, পাকিস্তান হওয়ার পর আর ক্ষমতা আন্দোলনকারীদের হাতে থাকলো না। ঔপনিবেশিক শাসনের সুবিধা ভোগকারী শ্রেণি ফিরে এল ক্ষমতায়। শুধুই ক্ষমতার হাত বদল। ফলে, সাধারণ মানুষ বুঝে নেয়যে, প্রতিসরণ ঘটেছে, এক উপনিবেশ থেকে অন্য উপনিবেশের কব্জায়। স্বাভাবিকভাবে তৈরি হলো-পাকিস্তানকে অস্বীকারের বাস্তবতা। বঙ্গবন্ধুর কথায় – ‘ইংরেজ আমলের সেই বাঁধাধরা নিয়মে দেশ শাসন চলল। স্বাধীন দেশ, জনগণ নতুন কিছু আশা করেছিল, ইংরেজ চলে গেলে তাদের অনেক উন্নতি হবে এবং শোষণ থাকবে না। আজ দেখছে ঠিক তার উল্টা। জনগণের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছিল।’ [অ আ : ১১৯]
এক্ষেত্রে সব সময়ই সাধারণ মানুষের আশাভঙের প্রতিক্রিয়া তিনি অবলোকন ও পর্যবেক্ষণ করেছেন। মানুষ বলতে শুরু করে,- ‘পাকিস্তান খারাপ না, পাকিস্তান তো আমাদেরই দেশ। যাদের হাতে ইংরেজ ক্ষমতা দিয়ে গেছে তারা জনগণের স্বার্থের চেয়ে নিজেদের স্বার্থই বেশি দেখছে। পাকিস্তান কি করে গড়তে হবে, জনগণের কি করে উন্নতি করা যাবে সেদিকে ক্ষমতাসীনদের খেয়াল নেই। ১৯৫২ সালে ঢাকায় গুলি হওয়ার পরে গ্রামে গ্রামে জনসাধারণ বুঝতে আরম্ভ করেছে যে, যারা শাসন করছে তারা জনগণের আপনজন নয়।… মানুষ বুঝতে আরম্ভ করেছে যে, বিশেষ একটা গোষ্ঠী (দল) বাঙালিদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়। [ অ আ : ২০৯]
আমরা সকলেই জানি, ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল মুসলিম লীগ সরকারের ষড়যন্ত্রে রাজশাহী কারাগারের খাপড়া ওয়ার্ডে অবস্থানরত রাজনৈতিক বন্দিদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। শহিদ হন দেলোয়ার হোসেন, হানিফ শেখ, আনোয়ার হোসেন, সুধীন ধর, বিজন সেন, সুখেন্দু ভট্টাচার্য ও কম্পরাম সিং। আহত হন প্রায় ৩২ জন বিপ্লবী, নিরস্ত্র কারাবন্দি। তাঁরা সকলেই ব্রিটিশ উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রামের অংশীজন। দেশ স্বাধীন হলেও তাদের বন্দি হিসেবে রাখা হয়। আবার তাদেরকেই হত্যা করা হলো। এ নিয়ে তিনি তীব্র নিন্দা জানান ও বিক্ষুব্ধ হন বঙ্গবন্ধু। তাছাড়াও ৬ দফার সমর্থনে যখন সারা পূর্ব বাংলা উত্থাল। তখন পাকিস্তানের পুলিশ বাহিনি তরুণ-কিশোরদের রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন চালায়। কারাগারে আনার আগেই প্রচুর অত্যাচার করা হয়। তা দেখে বঙ্গবন্ধু স্থির থাকতে পারেননি।- ‘মানুষ যখন অমানুষ হয় তখন হিংস্র জন্তুর চেয়ে হিংস্র হয়ে থাকে। রাত্রে আমি ঘুমাতে পারলাম না।’ [কা রো : ৭৪]
এমন পরিস্থিতির পটভূমি তা হলে কি? এসব নিয়ে ভাবা হচ্ছে এখনও। এক্ষেত্রে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিলো ভিন্নতর। কিন্তু এলিট ও সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা একবিন্দুতে মিলিত হতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু ওই সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে লড়াই করেছেন আজীবন। এলিট নেতৃত্বের পাকিস্তানবাদের সাথে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের দ্বন্দ্ব এখানেই। প্রসঙ্গত, স্মরণীয় সমাজকর্মী চন্দ্র ঘোষ এবং আরও বঞ্চিতজনের কথা। গোপালগঞ্জে যিনি কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছেন। ‘দেশের মুসলমান হিন্দু সকলেই ভালবাসত চন্দ্র ঘোষকে। তাঁর অনেক মুসলমান ভক্তও ছিল। তফসিলি সম্প্রদায়ের হিন্দুরাই তাঁর বেশি ভক্ত ছিল। গোপালগঞ্জের কিছু সংখ্যক তফসিলী সম্প্রদায়ের হিন্দু পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেছিল। এমনকি কিছু নমশুদ্র হিন্দু কর্মী আমাদের সাথে সিলেটে গণভোটে কাজ করেছিল।’ [অ আ : ১৮৮]
বস্তুত, সাধারণ মানুষের স্বপ্ন পদদলিত করতে ছড়িয়ে দেওয়া হলো সাম্প্রদায়িকতার বীজ। দেশ ভাগ ও নতুন রাষ্ট্র হলো। কিন্তু, হিংসার উন্মত্ততা, দরিদ্রতা, শোষণ কিছুই কমেনি। যে-শোষণের বিরোধিতা ও ধর্মেই দোহাই দিয়ে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা; সেই পশ্চিম পাকিস্তান রাষ্ট্রের কী হাল হয়েছে এখন। ক্রম-অন্ধকারে নিমজ্জমান, তা আর বলতে হয় না। বলার অপেক্ষা রাখে না, গভীরভাবে উপমহাদেশের রাজনীতি ও সমাজকে পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি যে-পাকিস্তানের সমূহ ক্ষতির কারণ হতে পারে; সে কথা বহুবার তিনি তাঁর দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে আলাপ করেছেন। পাকিস্তানের পরিণতি সম্পর্কে তাঁর আগাম মন্তব্য মিথ্যে হয়নি। ক্রমেই এর বাস্তব লক্ষণগুলো উদ্ভাসিত হতে থাকে। অস্থিরতা শুরু হয়। তিনি বলেছেন,- ‘প্রকাশ্য দিবালোকে জনসমাবেশে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।…যদিও তাঁরই হুকুমে এবং মেহেরবানিতে আমরা জেলে আছি, তবুও তাঁর মৃত্যুতে দুঃখ পেয়েছিলাম। কারণ ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে আমরা বিশ্বাস করি না। পাকিস্তানে যে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়ে গেছে, তাতেই আমাদের ভয় হল। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে গুলি করে হত্যা যে কত জঘন্য কাজ তা ভাষায় প্রকাশ করা কষ্টকর।’ [অ আ : ১৯৫]
এ বিষয়টি বঙ্গবন্ধু ছাড়া এত ভালোভাবে কেউ বুঝতে বা ব্যাখ্যা করতে পারেননি। এর ইতিবাচক পরিণাম হচ্ছে জনগণের ভালোবাসা এবং জনগণের প্রতি তাঁর দায়বোধ ও ভালোবাসা। মানুষেরঅধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামেতাঁর উপলব্ধি : ‘ক্ষমতার জন্য মানুষযে কোনো কাজ করতে পারে। আমাকে ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করতে কারো বিবেক দংশন করল না। আমি তো ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি নাই। জীবনভর প্রকাশ্যভাবে রাজনীতি করেছি। যাহা ভাল বুঝেছি তাই বলেছি।… যে পথে দেশের মঙ্গল হবে, যে পথে মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে তাহাই করেছি ও বলেছি। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যাতে তার ন্যায্য অধিকার আদায় করতে পারে তার জন্য আন্দোলন করেছি। বারবার জেলে যেতে হয়েছে আর মামলার আসামী হতে হয়েছে।’ [কা রো : ২৫৮]
সাম্প্রদায়িক দৃষ্টি ও শোষণের হাত বদল করতে যারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় উৎসাহী ছিলো;ওইদলভুক্ত ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু ছিলেন না। এ বিষয়টি পরিস্কার না-হলে ভুল বোঝার অবকাশ থেকে যায়। তাঁকে রাজনীতি করতে হয়েছে। স্মরণীয়, বাঙালির মুক্তির প্রশ্নে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষ বসুসহ অনেকেই আন্দোলন করেছেন। তাঁদের কর্মে তাঁরা অসফল- আমরা বলি না। কিন্তু দৃশ্যমান জাতিরাষ্ট্র নির্মাণে সফল হয়েছেন বঙ্গবন্ধু।
অন্যদিকে দলের প্রয়োজনে বিচিত্র ধরনের মানুষ রাজনীতি ও দলের সাথে যুক্ত হয়। এ জন্য একেবারে নিজের মতো দল চালানো সম্ভব হয় না। যেখানে তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে আন্দোলন-সংগ্রাম এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যক্তি শেখ মুজিবুর রহমান ও দলভুক্ত সঙ্গীদের ভাবাদর্শগত পার্থক্য। তাঁরবক্তব্য: ‘এই দিন থেকেই বাঙালিদের দুঃখের দিন শুরু হল। অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোনোদিন একসাথে হয়ে দেশের কোনো কাজে নামতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়।’ [অ আ :২৭৩-২৭৪]
তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সমাজচেতনা যে সকলের থেকে আলাদা, তা অত্যন্ত স্পষ্ট। যে কোনও কাজে তিনি সব সময় অনুভব করতেন তাঁর মানবিক দায় কী কী। যে ভালোবাসার শক্তিতে তিনি বাঙালি জাতির স্বপ্ন স্রষ্টা ও দ্রষ্টা হয়েছেন। তাঁর এ-সচেতন ব্যক্তিত্ব নির্মাণ সেই কৈশোরে। এক্ষেত্রে পূর্বাপর পরম্পরাও তিনি স্বীকার করেছেন।যেমন বলেছেন: ‘তখন স্বদেশী আন্দোলনের যুগ। মাদারীপুরের পূর্ণ দাস তখন ইংরেজদের আতঙ্ক। স্বদেশী আন্দোলন তখন মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের ঘরে ঘরে।… ইংরেজদের বিরুদ্ধেও আমার মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হল। ইংরেজদের এদেশে থাকার অধিকার নাই। স্বাধীনতা আনতে হবে। আমিও সুভাষ বসুর ভক্ত হতে শুরু করলাম। এই সভায় যোগদান করতে মাঝে মাঝে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর যাওয়া-আসা করতাম। আর স্বদেশী লোকদের সাথেই মেলামেশা করতাম।’[অ আ : ৯]
এমন স্বপ্ন-নকশা থেকেই তিনি রূপায়ণ করেছেন স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। তারপর দীর্ঘ সংগ্রামের পথ ধরে এল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। অনেকের মনে আসা স্বাভাবিক যে, সুভাষ বসু ছিলেন বিপ্লবী। তাহলে তিনি তো সুভাষ বসুর বিপ্লবী দল করার কথা। তিনি তা না করে কেন মুসলিম লীগ করতে গেলেন? সময় ও পরিসরের বাস্তবতা নিজের যুক্তির সাথে নাও মিলতে পারে। যাঁরা সুভাষ বসুর দল বা অন্য বামপন্থি দল করতেন, তাঁরা অনেকেই হুজুগে বামপন্থার অনুসারী ছিলেন। তারা মনে প্রাণে কেউই ওই আদর্শ পন্থায় নিজেকে গড়ে তোলেন নি। তাঁরা কেউ এদেশের মানুষের মন মেজাজ, সমাজের বাস্তবতা বুঝে উঠতে পারেননি। অবশেষে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নই থেকে গেছেন। এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে- সাধারণ মানুষ যখন স্বাধীনতার লড়াই করছে, তখন বামপন্থিরা করেছে ভুখাবিরোধী আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু এ-উপমহাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য, সাধারণ মানুষের মনোভঙ্গি, বিশ্বাস, চেতনার স্তর, সব জেনে-বুঝে রাজনৈতিক দল করেছেন। পরবর্তীতে তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিজস্ব চেতনা ও আদর্শের আদলে গড়েছেন সংগঠন। রাজনীতিতে কখনোই তিনি হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ গঠন প্রসঙ্গে বলেছেন, : ‘যে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখছিলাম, এখন দেখি তার উল্টা হয়েছে। এর একটা পরিবর্তন দরকার। জনগণ আমাদের জানত এবং আমাদের কাছেই প্রশ্ন করত। স্বাধীন হয়েছে দেশ, তবু মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর হবে না কেন? দুর্নীতি বেড়ে গেছে, খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। বিনা বিচারে রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের জেলে বন্ধ করে রাখা হচ্ছে।…সবকিছুই পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব বাংলায় কিছু নাই।’ [অ আ: ১২৫-১২৬]
৪.
এত ব্যস্ততা ও সংকটেও তিনি লেখাপড়া করতেন, খোঁজ-খবর রাখতেন সবকিছুর। আমরা বহু তত্ত্বকথার নিরিখে বুঝতে চেষ্টা করি ভারত উপমহাদেশের সংকটের রহস্য কোথায়। আর যে-কোনও বক্তব্যের আবার পক্ষ-বিপক্ষও রয়েছে। তবে,অতি অল্প সময়ে যে-কোনও সমস্যা অনুধাবনের সক্ষমতা বঙ্গবন্ধুর ছিলো। এমনকি এর সমাধানও তিনি বলতেন। সমস্যার আদ্যোপান্ত জেনে তিনি সহজেই বলেছেন যেসব কথা, ‘হিন্দু মহাজন ও জমিদারদের অত্যাচারেও বাংলার মুসলমানরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তাই মুসলমানরা ইংরেজদের সাথে অসহযোগ করেছিল। তাদের ভাষা শিখবে না, তাদের চাকরি নেবে না, এই সকল করেই মুসলমানরা পিছিয়ে পড়েছিল।… এই সময় যদি এই সকল নিঃস্বার্থ স্বাধীনতা সংগ্রামী ও ত্যাগী পুরুষরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সাথে সাথে হিন্দু মুসলমানদের মিলনের চেষ্টা করতেন এবং মুসলমানদের উপর যে অত্যাচার ও জুলুম হিন্দু জমিদার ও বেনিয়ারা করেছিল, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন, তাহলে তিক্ততা এত বাড়ত না।’ [অ আ : ২৩-২৪]বিশেষত, খানবাহাদুর, জোতদার, জমিদার শ্রেণির নেতৃত্বে পাকিস্তান যে সফল হবে না, তা তিনি আগেই আঁচ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর লক্ষ ছিলো : জনগণের মুক্তি ও স্বাধীনতা। ওই জটিল সমাজব্যবস্থায় মানুষ যে কত অসহায় তা উপলব্ধি করেছেন সাধারণ মানুষের জীবন থেকে। লক্ষ করেছেন, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও আমলারা খুব দ্রুত পূর্ব বাংলা থেকে সম্পদ সরিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গেলো। ওই অংশকে গড়ে তোলার জন্য। তাঁর স্পষ্ট ব্যাখ্যা হলো : ‘পাকিস্তান আন্দোলনের যারা বিরুদ্ধাচরণ করেছিল, এখন পাকিস্তানকে ইসলামিক রাষ্ট্র করার ধুয়া তুলে রাজনীতিকে তারাই বিষাক্ত করে তুলেছে।…পাকিস্তান আন্দোলনে শরীক হয়ে ত্যাগ স্বীকার করেছে তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির দিকে কোন নজর দেওয়াই তারা দরকার মনে করল না। জমিদার ও জায়গিরদাররা যাতে শোষণ করতে পারে, সে ব্যাপারেই সাহায্য দিতে লাগল। কারণ, এই শোষক লোকেরাই এখন মুসলিম লীগের নেতা এবং এরাই সরকার চালায়। অন্যদিকে পূর্ব বাংলার বৈদেশিক মুদ্রা থেকে প্ল্যান প্রোগাম করেই পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্প কারখানা গড়ে উঠতে সাহায্য করতে লাগল।’[অ আ : ২৪১]
রাজনীতিতে মুসলিম লীগের সীমাবদ্ধতা, সত্যিকারভাবে জনগণের প্রতিনিধিত্ব না-করা ইত্যাদি থেকে বঙ্গবন্ধু নতুন দল গঠনের চিন্তা করেন। পাকিস্তানমার্কা মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়াসেই আওয়ামী লীগের সৃষ্টি। রাষ্ট্র, সমাজ, উন্নয়ন, সর্বোপরি সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে পাকিস্তানি শাসকদের কোনও আগ্রহ ছিলো না। এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর দাবি ছিলো এবং তিনিলিখেছেন,-‘১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির কথা কেউই ভুলে নাই। আমরা তাড়াতাড়ি শাসনতন্ত্র করতে জনমত সৃষ্টি করতে লাগলাম। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি মেনে নেওয়া ছাড়া এবং বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা না মেনে নিলে আমরা কোনো শাসনতন্ত্র মানব না।’ [অ আ : ২৪৩]
স্মরণীয়, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন। অর্থাৎ, রাষ্ট্র পরিচালনায় সমূহ ব্যর্থতাসহ সবকিছু মিলিয়ে পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রীসহ মুসলিম লীগের বড় বড় নেতা ওই নির্বাচনে পরাজিত হন এবং নির্বাচনে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। জনগণের এমন প্রতিক্রিয়া রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে প্রেষণা জোগায়। উল্লিখিত নির্বাচনেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা হয়েছে। মানুষ নীরবে যুক্তফ্রন্ট প্রচারিত ২১ দফার পক্ষেই রায় প্রদান করে। অতএব ‘ধোঁকায় কাজ হল না’। এ ছাড়াও তারা প্রচার করেছে যে, আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতায় যায়, তাহলে অবাঙালিদের এদেশে থাকতে দেবে না। তবে জনগণের কাছে আওয়ামী লীগ বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলো যে, তাদের কাছে,- ‘মুসলমান, হিন্দু, বাঙালি, অবাঙালি সকলেই সমান’। ওই বছরমে মাসে আদমজি জুটমিলে বাঙালি-অবাঙালির মধ্যে বেদনাদায়ক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। সেখানেও বঙ্গবন্ধু দাঙ্গা প্রতিরোধ ও সম্প্রীতি স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এবং দাঙ্গা থামাতে সক্ষম হন।
৫.
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জনের প্রাক্কালে অর্থাৎ, ১৯৪৫-৪৬ সময় ছিলো খুবই বিপজ্জনক। একদিকে হিন্দু মুসলিমের মধ্যে বিরোধ, অন্যদিকে খাদ্যাভাব, অনিশ্চয়তা এবং নানাবিধ সংকট ছিলোই। প্রতিস্থাপনকাল হওয়ায় সাধারণ মানুষের সংকট ও সমস্যা নিয়ে ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী ছিলো উদাসীন। বরং, তারা স্থায়ী কিছু সমস্যা তৈরিতে সক্ষম হয়। তখন বঙ্গবন্ধু কলকাতায়। যেটুকু সামর্থ্য ছিলো, সব দিয়ে দাঙ্গা বন্ধের ব্যবস্থা করেছেন। দাঙ্গার ভয়াবহতা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন,-‘কলকাতা শহরে শুধু মরা মানুষের লাশ। বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে। মহল্লার পর মহল্লা আগুনে পুড়ে গিয়েছে। এক ভয়াবহ দৃশ্য। মানুষ মানুষকে এইভাবে হত্যা করতে পারে, চিন্তা করতেও ভয় হয়।… অনেক হিন্দু মুসলমানদের রক্ষা করতে যেয়ে বিপদে পড়েছে। জীবনও হারিয়েছে। আবার অনেক মুসলমান হিন্দু পাড়া পড়শীকে রক্ষা করতে যেয়ে জীবন দিয়েছে।’[অ আ: ৬৬-৬৭]
রাজনীতিতে তিনি কখনও সাম্প্রদায়িক চিন্তা, ভাবনা ও তৎপরতাকে গ্রহণ করেননি। পরবর্তীতে ঢাকা এসে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহযোগী মিলে অসাম্প্রদায়িক একটি যুব সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। তিনি ভেবেছেন রাজনৈতিক চেতনা উন্নত করতে সাংস্কৃতিক সংবেদনা প্রয়োজন। মূলত, এমন সংগঠন সৃষ্টির পেছনে উদ্দেশ্য ছিলো- সম্প্রীতির পক্ষে কাজ করা। তাঁর ভাষায়,- ‘‘এই প্রতিষ্ঠানকে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণ্য করতে হবে। এই প্রতিষ্ঠানের নাম হবে, ‘গণতান্ত্রিক যুবলীগ’। আমি বললাম, এর একমাত্র কর্মসূচি হবে সাম্প্রদায়িক মিলনের চেষ্টা, যাতে কোনো দাঙ্গা হাঙ্গামা না হয়, হিন্দুরা দেশত্যাগ না করে- যাকে ইংরেজিতে বলে ‘কমিউনাল হারমনি’, তার জন্য চেষ্টা করা।’ [অ আ : ৮৫]
প্রসঙ্গত, সাম্প্রদায়িকতা দমনে সাফল্যের বিপ্লবী অভিজ্ঞতা তিনি গ্রহণ করেছেন চীন ভ্রমণে। যে-আলোকে নিজ দেশের সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের চিন্তা করেছেন। চিয়াং কাইশেকের আমলে দাঙ্গা, হত্যা ও পীড়নের ঘটনাবলি সকলেই কমবেশি জানেন। বঙ্গবন্ধু যেসব ঘটনাবলির চিহ্ন নিজে দেখে এসেছেন। যেখানে মাও জে দুং-এর নেতৃত্বে নতুন চীন, নতুনভাবে পথ দেখালো। সেখানের কৃষি, শিক্ষা, শিল্প, খামার, গ্রাম, নদী শাসনসহ সবকিছু তিনি নিবিড়ভাবে অবলোকন করেছেন। এ যেনো- ‘নতুন দেশ, নতুন মানুষ, নতুন তাদের ব্যবহার’। এভাবে যদি নতুন করে সাজাতে হয় পূর্ব বাংলা। তা হলে- ‘নতুন করে সব কিছু ঢেলে সাজাতে হবে। ভাঙা দালানে চুনকাম করে কোনো লাভ হয় না-বেশি দিন টিকে না।’ [আ দে ন : ১০৭]
তিনি দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্রকে ভিন্ন আঙ্গিকে বিবেচনা করেছেন। যেখানে মানুষে মানুষে হিংসা থাকবে না। সৃজন হবে সমৃদ্ধ, মানবিক রাষ্ট্র ও সমাজ। এটাই তাঁর ‘সোনার বাংলা’ দর্শনের মূল প্রেষণা। এ আলোকেই তাঁর সত্তাও সক্রিয় ছিলো সব সময়। প্রসঙ্গত, কয়েকটি উদাহরণে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এমন মানবিক নেতৃত্ব পৃথিবীর ইতিহাসে খুব সুলভ নয়। লক্ষণীয়, বঙ্গবন্ধু শিক্ষকদের খুব সম্মান করতেন। স্বাধীনতা লাভের পর তিনি খ্যাতিমান শিক্ষকদের নানা পদে পদায়ন ও নিয়োগের চেষ্টা করেছেন। প্রয়োজনে তাঁদের পরামর্শ গ্রহণ করেছেন। তরুণ বয়সেও শিক্ষকদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাবোধ লক্ষ করি। তিনি উল্লেখ করেছেন ইসলামিয়া কলেজের নারায়ণ বাবুর কথা। তিনি ওই শিক্ষক সম্পর্কে বলেছেন- ‘এই রকম সহানুভূতিপরায়ণ শিক্ষক আমার চোখে খুব কমই পড়েছে’।[অ আ : ৩৮]
৬.
একবার মায়ের অসুস্থতা শোনে তিনি খুবই বিষণ্ন হয়ে পড়েন। তবে কারাগারে অন্তরীণ থাকায় মাকে দেখার কোনও সুযোগ পেলেন না। উল্লেখ করতেই হবে যে, পিতামাতার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও ভক্তি তুলনা রহিত। কৈশোরে তাঁর বাবা জীবনের লক্ষ ও মনুষ্যত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণাও দিয়েছেন। কারাগার থেকে মাকে দেখার জন্য ছটফট করেছেন। অসুস্থ বাবা-মা-র কথা চিন্তা করে অনেক রাত কেটেছে নির্ঘুম। ওই কষ্ট একজন ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না। তাঁর সে দহনের ভাষা আমরা পাঠ করি: ‘‘তাই ভাবি রাজনীতি মানুষকে কত নিষ্ঠুর করে! কয়েদিদেরও মায়া আছে, প্রাণ আছে, কিন্তু স্বার্থান্বেষীদের নাই। ভাবলাম রাতটা কাটাতেই কষ্ট হবে। কিন্তু কেটে গেল। জানালা দিয়ে অনেকক্ষণ বাইরে তাকাইয়া ছিলাম। দেখতে চেষ্টা করলাম ‘অন্ধকারের রূপ’. দেখতে পারলাম না। কারণ আমি শরৎচন্দ্র নই। আর তাঁর মতো দেখবার ক্ষমতা এবং চিন্তাশক্তিও আমার নাই।’ [কা রো: ৮০]
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে সমাজহিতৈষী চন্দ্র ঘোষের কথা। তাঁকে পাকিস্তান সরকার গ্রেফতার করে বিনা অপরাধে। চন্দ্র ঘোষের গ্রেফতারে সোহরাওয়ার্দীও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কারাগারে চন্দ্র ঘোষ অসুস্থাবস্থায় বঙ্গন্ধুকে দেখতে চেয়েছেন। কারণ, তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে খুব ভালোবাসতেন। সাক্ষাতের পর স্মৃতিচারণে লিখেছেন- ‘‘চন্দ্র ঘোষ স্ট্রেচারে শুয়ে আছেন। দেখে মনে হল, আর বাঁচবেন না, আমাকে দেখে কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, ‘ভাই, এরা আমাকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে বদনাম দিল; শুধু এই আমার দুঃখ মরার সময়। কোনোদিন হিন্দু মুসলমানকে দুই চোখে দেখি নাই। সকলকে আমায় ক্ষমা করে দিতে বোলো। আর তোমার কাছে আমার অনুরোধ রইল, মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখ। মানুষে মানুষে কোন পার্থক্য ভগবানও করেন নাই। আমার তো কেউই নাই, আপন ভেবে তোমাকেই শেষ দেখা দেখে নিলাম। ভাগবান তোমার মঙ্গল করুক।’…আমার চোখেও পানি এসে গিয়েছিল।বললাম, ‘চিন্তা করবেন না, আমি মানুষকে মানুষ হিসাবেই দেখি।’’ [অ আ :১৯১]
তাঁর কর্মতৎপরতা, দৃঢ়তা, নেতৃত্বের গুণাবলি এবং সাধারণ মানুষের আস্থা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গেছে চূড়ান্ত পথে। তাঁর ঘটনাবহুল জীবন ও কর্ম থেকে আমরা তা সহজেই বুঝে নিতে পারি। অভিজ্ঞতায় তিনি লিখেছেন,- ‘‘আমার মনে আছে খুবই গরিব এক বৃদ্ধ মহিলা কয়েক ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। শুনেছে এই পথেই আমি যাব, আমাকে দেখে আমার হাত ধরে বলল, ‘বাবা আমার এই কুঁড়েঘরে তোমায় একটু বসতে হবে।’ আমি তার হাত ধরেই তার বাড়িতে যাই। অনেক লোক আমার সাথে, আমাকে মাটিতে একটা পাটি বিছিয়ে বসতে দিয়ে এক বাটি দুধ, একটা পান ও চার আনা পয়সা এনে আমার সামনে ধরে বলল, ‘ খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছুই নাই।’ আমার চোখে পানি এল। আমি দুধ একটু মুখে নিয়ে, সেই পয়সার সাথে আরও কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে বললাম, ‘তোমার দোয়া আমার জন্য যথেষ্ট, তোমার দোয়ার মূল্য টাকা দিয়ে শোধ করা যায় না।’…এ দেশের লোক আমাকে কত ভালবাসে। আমার মনে একটা বিরাট পরিবর্তন এই সময়ে হয়েছিল।’ [অ আ : ২৫৫-২৫৬]
কারাগারে বসেও বঙ্গবন্ধু জানা-বোঝার চেষ্টা করেছেন মানুষের সমস্যা ও বেদনা। বারবার কারাগারে অবস্থানের কারণে তিনি কারাগারের ভাষা ও বৈশিষ্ট্যও পাঠ করেছেন। চমৎকৃত করেছেন এ-ই বলে,- ‘জেলের ভিতর অনেক ছোট ছোট জেল আছে’। তিনি লক্ষ করেছেন, যত বড় অপরাধী হোক না-কেন সবার ভেতরে মানবিক গুণের একটা অংশ থাকে। পাকিস্তানের শাসন নিয়ন্ত্রিত কারাগারে অযথাই কয়েদিদের অবজ্ঞা, নির্যাতনও শাস্তির প্রয়োগ দেখেছেন।প্রতিবাদে কিছু সমস্যার সমাধানও করেছেন। অনেক সময় বিভিন্ন কয়েদির সাথে ভাব বিনিময় করতেন। তাদের সমস্যা বুঝতে চেষ্টা করেছেন। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন চুরি-ডাকাতি মামলার আসামি। কয়েদির সাথে সাক্ষাত বা ভাব বিনিময়েতিনি কোনও চোর, ডাকাত বা অপরাধীকে দেখেননি; দেখেছেন মানুষকে।
মূলত, আর্থিকভাবে অসচ্ছল হলেও প্রতিটি মানুষ মর্যাদার সাথে জীবনযাপন করতে চায়। তবে এর অন্যতম অন্তরায় হলো দারিদ্র্য ও স্ব-ক্ষমতা না থাকা। যে জন্য তিনি আজীবন আন্দোলন করেছেন। একদিন কারাগারে তাঁর সাথে পরিচয় ঘটে লুদু নামের এক কয়েদির। যে চুরির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত আসামি এবং মেটের দায়িত্ব পালন করছিলো। একজন মেটের অধীনে কয়েকজন কয়েদি থাকে। মেটের দায়িত্ব খুব মর্যাদারভেবে লুদু চিঠি লিখেন স্ত্রীর কাছে। যাতে লুদু লিখেছিলেন,- ‘…আল্লাহ আমাকে খুব সম্মান দিয়েছে। এত বড় সম্মান সকলের কিসমতে হয় না। গ্রামের লোক আমাকে চোর বললে কি হবে, জেলে আমি একটা মাতুব্বার শ্রেণীর লোক। চুরি না করলে আর জেলে না আসলে এ সম্মান আমাকে কেউই দিত না। তুমি ভেবো না। এখানে খুব সম্মানের সাথে আছি।’ [কা রো : ৩০]
কিন্তু জেলের কোনও চিঠি কর্তৃপক্ষের নিরীক্ষা ছাড়া বাইরে বের হতে দেওয়া হয় না। ফলে,লুদুর সেই চিঠি আর প্রাপকের কাছে পৌঁছায়নি। একইসাথে জেলার চিঠি পড়ে তাকে আবার অবনমিত করেন সাধারণ কয়েদি হিসেবে। কারাগারে আইনসহ নানা দফা প্রচলিত ছিলো। কারাগারে মেজাজ দেখানো আসামিকে এ-দফায় ফেলা হতো। এ-দফায় ফরিদপুর জেলে অদ্ভুত ও অমানবিক শাস্তি তিনি লক্ষ করেন। ‘একটু মেজাজ দেখানো কয়েদি হলেই, সাজা দেওয়ার জন্য আইন দফা পাশ করা হতো। এদের গরুর মতো ঘানিতে ঘুরতে হতো। আর একটা পরিমাণ ছিলো, সেই পরিমাণ তেল ভেঙে বের করতে হতো। পিছনে আবার পাহারা থাকত, যদি আস্তে হাঁটতো অমনি পিটান।’ [কা রো: ৪২]
বঙ্গবন্ধুর প্রতিবাদ ও ক্ষোভের প্রেক্ষিতে ঘানি ঘুরানোর শাস্তি বন্ধ করা হয়। মানুষের বাস্তব জীবন ও উলটো দিক তিনি জানার চেষ্টা করেছেন গভীরভাবে। অপরাধের অভিযোগে কয়েদি হওয়ায় তাদের কখনও তিনি ঘৃণা করেননি। তাদের সাথে গল্প বলা ও জীবনের অভিজ্ঞতা বিনিময় করতেন। আন্তরিকতার সাথে জানতে চেয়েছেন তারা কীভাবে সংযুক্ত হয়েছে অপরাধের বিচিত্র কাজে। দেখেছেন, সাদা তলের বিপরীতে আঁধারে ডুবে থাকা করুণ কাহিনি। কয়েদিদের পীড়িত জীবনকে সূচক ধরে জেনে নিয়েছেন-রাষ্ট্র ও সমাজের চালচিত্র।
বারবার কারাগারে যাওয়া-আসাতে পুরনো অনেক কয়েদির সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেখানে লুদু, ছোটন, নুরুসহ অসংখ্য অঙারে পরিণত জীবনের গল্প, তিনি মনযোগে শুনেছেন, এবং লিখেছেন তাঁর রোজনামচায়। তিনি এসব জানতে গেলেন কেন? আমরা অনেকেই জানি না যে, ওখানেই জীবনের নিকষিত রূপ। তিনি দেখেছেন দেয়ালঘেরা পূর্ব বাংলা ও মানুষের কান্না। তিনি জানতে চেষ্টা করেছেন মানুষ কেন অপরাধের সাথে জড়িয়ে যায় ইত্যাদি। - ‘একটা সামান্য চোরের জীবন আমি কেন লিখছি- এ প্রশ্ন অনেকেই আমাকে করতে পারেন। আমি লিখছি এর জীবনের ঘটনা থেকে পাওয়া যাবে আমাদের সমাজব্যবস্থার চিত্র।…আল্লাহ কোনো মানুষকে চোর ডাকাত করে সৃষ্টি করে না।… এক একেকটা ব্যবস্থায় এক একজনের জীবন গড়ে ওঠে।’ [কা রো: ৪৮]
লুদু যা বলেছেন, তা এক দীর্ঘ কাহিনি। বঙ্গবন্ধুর ভাষ্যে উপস্থাপিত লুদুর জীবনের দুঃসাহসিক বিবরণ পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম। এ-যেনো ভিন্ন এক ফিকশন। এর মধ্য দিয়ে সহজেই উপলব্ধ হয়, সামাজিক স্তরের খবর,এ সমাজস্থিত মানুষের মানসিকতা, এবং তাদের জীবন সম্পর্কিত রেখাগুলো। মনে হয় কোনও বিখ্যাত উপন্যাসের চরিত্র পাঠ করছি। লেখাপড়ার সখ ছিলো তার। কিন্তু লুদুর বাবার সাতটি বিয়ে। এর ওপর নির্যাতন, বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া ইত্যাদি কারণে লুদুর অনিশ্চিত পথে যাত্রা শুরু। সেই থেকে চুরি ও পকেটমার হওয়া নিছক অস্তিত্বের তাগিদে। ওই সময় তার বয়স ছিলো মাত্র ১৩ বছর। তবে চুরিরমাধ্যমেলুদু তার ছোট ভাইকে লেখাপড়া করানোর চেষ্টা করেছেন।এক পর্যায়ে, গ্রেফতার, সাজা ইত্যাদি হয়ে ওঠে তার জীবনের নিত্যসঙ্গী। লুদু বিয়ে করেছেন, তবে তা স্থায়ী হয়নি। পরে আবার বিয়ে করেন। কিন্তু সেখানেও সমস্যা ওই চুরি ও পকেটমারার দায়ে। এক সময় ক্লান্তিবোধ করেন লুদু। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভেতরে খুঁজে পান আরেকটি মানুষ- যার মধ্যে প্রেম আছে, আছে দায়িত্ববোধ ও স্নেহ। বঙ্গবন্ধু, লুদুর মাধ্যমে বেঁকে যাওয়া জীবনের গভীরতল অনুসন্ধান করেছেন সমাজচিন্তকের মতো। তিনি লিখেছেন,- ‘এখন জেল হলে তার ভাল লাগে না। তার স্ত্রীর কথা বলে মাঝে মাঝে দুঃখ করত। … লুদু বলে দুঃখ করে, আর বলে নিজের জন্য দুঃখ নাই, দুঃখ হলো ওর জীবনটা শেষ করে দিলাম। একটা ছেলে ছিল তাও মারা গেছে, ও কি করে থাকবে জানি না। লুদু জেলের বাহির হয়ে কি করবে জানি না, তবে কথায় বার্তায় মনে হয়, ওর জীবনের উপর একটা ধিক্কার আছে।’ [কা রো : ৫৪]
তিনি উল্লেখ করেছেন, ছোটনের কথা। যার ৫৩ বছরের সাজা হয়েছিলো। ছোটন বঙ্গবন্ধুর কাছে বলেছেন, ‘…আমার একটা মেয়ে ও স্ত্রী আছে।…মেয়েটা ও স্ত্রীর কি হবে? কিছু তো আর রেখে আসতে পারি নাই।’ [কা রো: ১৭৫]
কারাগারে নির্যাতনের ফলে ছোটনের শরীর ভেঙে পড়ে। তাকে পরখ করে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন,- ‘কারাগারের এই নিষ্ঠুর ইটের ঘরেই জীবনটা দিতে হবে। তবুও আশা করে পঁচিশ বছর খেটে বের হতে পারবে। আবার মুক্ত বাতাস, মুক্ত হাওয়ায় বেড়াতে পারবে। ছেলে মেয়ে নিয়ে সংসার করবে। মানুষের আশার শেষ নাই। …কিন্তু বাইরে গেলে বেশিদিন বাঁচবে না। এখানে বেশিদিন থাকলে ভিতরে কিছুই থাকে না, শুধু থাকে মানুষের রূপটা।’ [কা রো : ১৭৫]
নরুদ্দিন-নুরু ছিলো ডাকাতি মামলার আসামি। নুরুর ছিলো চমৎকার গায়কী কণ্ঠ। নুরুর কাছে জানতে চেয়েছেন-এভাবে জীবনের পরিণতি কেন। ওই একই উত্তর ওঠে আসে। ‘বাবা, ভাইরা কোনো খবর নেয় না। ডাকাতি ও খুনের মামলায় জেল হয়ে তাদের ইজ্জত মেরেছি।’ [কা রো: ১২৯]
বস্তুত, লুদু, ছোটন, নুরুসহ কারও অপরাধ তিনি সমর্থন করেন নি। কিন্তু তিনি আবিষ্কার করেছেন তাদের ভেতরের মানুষকে। যারা সমাজে বঞ্চিত না হলে কখনোই কোনও অপরাধ করতেন না। সমূহ অনিশ্চিত জেনেও তিনি তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পরামর্শ দিয়েছেন। তাদের জীবন কাহিনি শুনে তিনি তাঁর উপলব্ধিও তৈরি করেছেন। যা চীন ভ্রমণের অভিজ্ঞতার সমান্তরালে উপস্থাপন করেছেন। এ-ভ্রমণে তিনি প্রতিপাদন করেছেন, ব্যবস্থাপনা উন্নত হলে মানুষের ভেতরে ইতিবাচক চিন্তা ও কাজের প্রেষণা জাগানো সম্ভব। চীনে তিনি খেয়াল করেছেন যে, বিপ্লবোত্তর সমাজ ব্যবস্থায় চুরি, ডাকাতি, মারামারি, হিংসা, বেশ্যাবৃত্তি বন্ধ করতে তারা সক্ষম হয়েছে। সেক্ষেত্রে তিনি বলেছেন, ‘পেটে খাবার না থাকলে, ছেলেমেয়ে সামনে না খেয়ে মরলে, রোগে ঔষধের বন্দোবস্ত করতে না পারলে মানুষ অনেক সময় বাধ্য হয় চুরি করতে, ডাকাতি করতে এবং ছলে বলে কৌশলে অর্থ উপার্জন করে ছেলেমেয়েদের খাওয়াতে।’ [আ দে ন : ৮৭]
আমরা অনেকেই পড়েছি- চীনের দুঃখ হোয়াংহো। বঙ্গবন্ধু চীন ভ্রমণে লক্ষ্য করেছেন বিপ্লবের পর হোয়াংহো আর দুঃখের উপলক্ষ থাকেনি। এ-নদীকে উন্নয়নের অংশীদার বানানো হয়েছে। আমরা চীনের ইতিহাস ও বিপ্লবী পরিবর্তন বোঝার জন্য অনেক তথ্য পাঠ করি। কিন্তু এত সহজে, অল্প কথায় চীন সম্পর্কে জানা যায়, ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে।বঙ্গবন্ধু, তাঁর এ-ভ্রমণের সারসংক্ষেপে উপস্থাপন করেছেন সমন্বিত গণতান্ত্রিক চেতনার উপলব্ধি। ‘আমার মতে, ভাত-কাপড় পাবার ও আদায় করে নেবার অধিকার মানুষের থাকবে, সাথে সাথে নিজের মতবাদ প্রচার করার অধিকারও মানুষের থাকা চাই। তা না হলে মানুষের জীবন বোধ হয় পাথরের মতো শুষ্ক হয়ে যায়।’ [আ দে ন : ১১৯] এর চেয়ে সহজ, মূল্যবান কথা আর কী হতে পারে। দেরিদা-র গুরুত্বপূর্ণ বই Of Grammatology –এর ভূমিকায় গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভোক লিখেছেন,- `the structure preface- text becomes open at both ends. The text has no stable identity, stable origin… each act of reading the text is a preface to the next.’ অতএব এ ভাষ্য শেষ হয় না। বঙ্গবন্ধুর কথায় রয়েছে অনেক স্বর ও প্রান্ত। সেসব উন্মোচন করা পাঠকের দায়িত্ব।
স্বপন নাথ, লেখক ও প্রাবন্ধিক
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ