আলমগীর শাহরিয়ার
আপডেট: ১৪:২৪, ৮ অক্টোবর ২০২০
ক্রসফায়ারের ‘গণদাবি’ ও নাগরিক অসহিষ্ণুতা
সক্রেটিস বলেছিলেন রাষ্ট্র কার? শক্তিমানের না দুর্বলের? — রাষ্ট্র দুর্বলের। কারণ শক্তিমান নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে পারে। দুর্বলের স্বার্থ রক্ষার জন্যই রাষ্ট্র। আর রাষ্ট্র মানে নীতিমালা। বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের সমষ্টি। আইনের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা জাল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের সমাজে হয়েছে উল্টো। এখানে সবলের স্বার্থ রক্ষা করাই হয়ে গেছে রাষ্ট্রের কাজ। ফলে নাগরিকরা সহজে আস্থা রাখতে পারেন না রাষ্ট্রের নানাবিধ প্রতিষ্ঠানের উপর। বিশেষ করে কোনো অপরাধ সংঘটনের পর কেউ আর সুষ্ঠু বিচার চাইছেন না। বলছেন অপরাধীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কথিত ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘এনকাউন্টারে’ মেরে ফেলো। অপরাধীকে নিয়ে ‘অস্ত্র উদ্ধারে যাও’, মেরে ফেলো জনসম্মুখে প্রকাশ্যে — এমন দাবি ও পরিস্থিতি গভীর উদ্বেগের। একই সঙ্গে সংকটের।
কোনো অপরাধ সংঘটনের পর কেউ আর সুষ্ঠু বিচার চাইছেন না। বলছেন অপরাধীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কথিত ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘এনকাউন্টারে’ মেরে ফেলো। অপরাধীকে নিয়ে ‘অস্ত্র উদ্ধারে যাও’, মেরে ফেলো জনসম্মুখে প্রকাশ্যে — এমন দাবি ও পরিস্থিতি গভীর উদ্বেগের। একই সঙ্গে সংকটের।
সম্প্রতি, সিলেটের মুরারীচাঁদ কলেজে ও নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে আলোচিত নারকীয় সংঘবদ্ধ ধর্ষণকাণ্ডের পরও সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় নাগরিক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় এমন দাবি দেখা গেছে। এই দাবি খুব প্রবল হয়ে উঠছে দিনদিন। নেটিজেনদের এই মিছিলে শামিল হতে দেখছি রাজনীতিবিদ ও দার্শনিক এডমন্ড বার্কের ফোর্থ স্টেটখ্যাত গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক থেকে সমাজের বিবেকখ্যাত বুদ্ধিজীবী, শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদেরও। একটি বিকাশোন্মুখ রাষ্ট্রের জন্য এটা মোটেই ভালো লক্ষ্মণ নয়। সংহত ও সুস্থ চিন্তার বদলে এক ধরনের অসারতা ও অসুস্থতা। তাৎক্ষণিক ক্রোধান্ধ আবেগের অবিশ্লেষিত বহিঃপ্রকাশ। অবিকশিত সমাজ, রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের লক্ষণ। এর কারণ হয়ত আমাদের রাষ্ট্র গঠনের অভিজ্ঞতা অল্পদিনের। ইউরোপে রাষ্ট্রের ধারণা বেশ পুরনো। ফলে তারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শিখেছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী ব্যক্তি বিশেষের বা উৎকোচে প্রভাবিত হয়ে নয়, সবল ও দুর্বল নির্বিশেষে রাষ্ট্র সকল নাগরিকদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দেয়। শুধু বড় বড় স্থাপনা বা অবকাঠামো নয়, নাগরিকদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার বিষয়টিও একটি দেশের সাংস্কৃতিক মান ও উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ সূচক।
আমাদের দেশে লাগাতার বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও দীর্ঘসূত্রিতা নাগরিকদের এমন অসহিষ্ণু করে তুলছে। এ দেশে সপরিবারে জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের পর ইনডেমনিটি আইন করে খুনিদের শুধু পালিয়ে যেতে সহায়তা করা হয়নি, নজিরবিহীনভাবে এমন জঘন্য খুনিদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পদায়ন ও পুরস্কৃত করা হয়েছে। এভাবে নানাসময় বিচারহীনতার সংস্কৃতি নাগরিকদের বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থায় চির ধরিয়েছে। প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় অপরাধী আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। ভিকটিম সুবিচার পাচ্ছে না। অপরাধী লালদালান থেকে বেরিয়ে এসে আবার দাঁত কেলিয়ে শুধু হাসছে না ক্ষেত্র বিশেষে ভিকটিমের উপর ফের চড়াও হচ্ছে।
বিচার ব্যবস্থায় এই আস্থাহীনতার ফলেই নাগরিকরা এখন ক্রসফায়ারের মতো ‘কুইক সলিউশন’ রব তুলছেন। কিন্তু এটা স্বস্তির ব্যাপার নয়, উদ্বেগের। তা ছাড়া, অপরাধীরও অধিকার রয়েছে আইনের আশ্রয় নেবার। সবচেয়ে বড় কথা নিরপরাধী কেউ যেন দণ্ড না পায়। কক্সবাজারে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তো এখনও দেশব্যাপী আলোচিত। চেহারায় মিল থাকার কারণে দুদকের এক মামলায় আবু সালেকের বদলে নিরপরাধ জাহালামের জেল খাটার আলোচিত ঘটনা তো সেদিনের । ঝালকাঠির সেই কিশোর লিমনের কথাও নিশ্চয়ই মনে আছে? র্যাবের গুলিতে যে শুধু পা হারায় নি অস্ত্র ও বিস্ফোরক আইনে মিথ্যা মামলারও মুখোমুখি হয়। দেশব্যাপী নাগরিক সমাজের সমালোচনার মুখে ২০১৪ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে লিমনকে সাজানো মামলা থেকেও অব্যাহতি দেয়া হয়।
নাম বিভ্রাটেও বছরের পর বছর জেল কাটার নজির আছে অনেক নিরপরাধ মানুষের। তা ছাড়া, অপরাধী সলিমের বদলে রাতারাতি নিরপরাধ কলিম নামে কেউ যে ক্রসফায়ারের শিকার হয়ে যাবে না এই নিশ্চয়তা কে দেবে? একজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা সমগ্র মানব সমাজকে হত্যা করার শামিল। এজন্যই প্রয়োজন যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া। কিন্তু সেটা যেন বিচারপ্রার্থীর ধৈর্যচ্যুতি না ঘটায়। তাকে নিরাশ না করে। দীর্ঘসূত্রিতার জন্য আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা বা অসহিষ্ণু না করে তুলে। কেননা, ‘Justice delayed is justice denied.’ ইউরোপে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রহিত হচ্ছে। স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলিতে কারাগারকে সত্যিকারের সংশোধনাগার করে তোলা হয়েছে। অনেক জেলে কয়েদির অভাবে খালি পড়ে আছে। আর আমাদের ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি অপরাধী জেলগুলোতে গিজগিজ করছে। এসব নিয়ে অপরাধবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীদের গবেষণা করে রাষ্ট্রকে করণীয় ও পরামর্শ দেওয়া জরুরি।
আমরা রক্তক্ষয়ী একটি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র গঠন করেছি। যে সংগ্রামে ৩০ লাখ শহীদ ও দু লাখের বেশি নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন। শহীদের রক্তেভেজা স্বাধীন দেশে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে সংবিধান রচনা করা হয়েছিল তার ‘প্রস্তাবনা’ অংশেই বলা আছে, “আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা — যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করা হবে।” মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত সেই রাষ্ট্র-আকাঙ্ক্ষা থেকে আমরা যেন সরে না আসি।
আলমগীর শাহরিয়ার, কবি ও প্রাবন্ধিক
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ