ইমতিয়াজ মাহমুদ
আপডেট: ১৯:৫৫, ৬ ডিসেম্বর ২০২০
ভাস্কর্য আর মূর্তির মধ্যে কি পার্থক্য?
ইমতিয়াজ মাহমুদ
ভাস্কর্য আর মূর্তির মধ্যে কি পার্থক্য? এই পার্থক্য কে নির্ধারণ করেছে? মৃণাল হক যে পচা পচা কতোগুলি জিনিস বানিয়েছে সেগুলি কি ভাস্কর্য? নাকি মূর্তি? আমার তো সেগুলি ভাস্কর্য বা মূর্তি কোনটাই মনে হয় না। অ্যাডোনিস গ্রীক বিশ্বাসে দেবতা ছিলেন, ঐটা কি মূর্তি নাকি ভাস্কর্য? ভারতে কোন এক শহরে ঢুকার মুখে দেখি বিশাল এক হনুমান- ল্যাঙট পরে ইয়াব্বড় একটা গদা কাঁধে নিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে ভেংচি কাটছেন যারাই শহরে ঢুকছে সবাইকে। সেটাতে কেউ পূজা করে বলে মনে হয়নি- সেটা কি মূর্তি নাকি ভাস্কর্য? বালিতে এয়ারপোর্ট থেকে নেমে নুসা দুয়ার দিকে যেতে এক চৌরাস্তায় দেখি কয়েক ঘোড়ার রথে চড়ে গরুড়ের সাথে যুদ্ধ করছে এক সুদর্শন রাক্ষস। মূর্তি?
আমার বাসায় কয়েকটা গৌতম বুদ্ধ আছে। একটা আছে বেশ পুরনো, এটা একসময় কোন একটা মন্দিরে পূজার জন্যে স্থাপিত ছিল। এগুলির মধ্যে কোনটা মূর্তি কোনটা ভাস্কর্য? কয়েক সেট তিন বান্দরও আছে আমার বাসায়। আমার স্ত্রী, তিনি এই তিন বান্দরের বড়ই ভক্ত- একেক দেশ থেকে একেকটা কিনেছেন। একটা নটরাজও আমার মেয়েদের ঘরে তাণ্ডব করছেন- ইনি পিতলের বেশ ভারি। এইগুলি কোনটা মূর্তি আর কোনটা ভাস্কর্য আর কোনটা খেলনা আর কোনটা গৃহসজ্জার সামগ্রী?
দক্ষিণ ভারতীয় এক সেট লোক দেবতা আছেন, একদম এক সারি বিচিত্র দর্শন দেবতা আর মাঝখানে সিদ্ধিদাতা গণেশ। আমার স্ত্রী গিয়েছিলেন পেশাগত কাজে মাদুরাই, সেখানে তাঁকে এটা উপহার দিয়েছে কারা যেন। উপহার হিসাবে তিনি মহাত্মা গান্ধীর একটা মূর্তি/ভাস্কর্যও পেয়েছেন, সাথে একটা সরস্বতীও- দুইটাই সাদা মার্বেলের, আকৃতিতে ছোট। আরও কি কি সব আছে। সেগুণ কাঠের দুইজন বার্মিজ নারী আছেন, রেঙ্গুন থেকে এই দুইটা ভারি কাঠের মূর্তি/ভাস্কর্য আমি কাঁধে করে বয়ে এনেছি। প্লেনে লাগজের সাথে দিইনি- লিটারেলি কাঁধে নিয়ে প্লেনে উঠেছি, কেবিনের উপরের ডালায় যত্ন করে নিচে একটা কম্বল দিয়ে, আরেকটা কম্বল দিয়ে পেঁচিয়ে তবেই রেখেছি। অনেকগুলি বারবি ছিল আমাদের, এখন কোথায় আছে জানিনা। খুঁজলে হয়তো এখনো কয়েকটা পাব।
জাতিকে যে আপনারা দিচ্ছেন মূর্তি আর ভাস্কর্যের নিপুণ পার্থক্য বুঝার জ্ঞান, সেই গান তো আমার মগজে ঢুকছে না। আমি কোনটাকে ভাস্কর্য বলবো আর কোনটাকে মূর্তি? আর আমি যদি কারো সাথে বিবাদ লাগি, কোনটা ভাস্কর্য আর কোনটা মূর্তি তাইলে কার কাছে গিয়ে রায় নিব? আদালতে যাব? শিল্প বা বিশ্বাস নিয়ে রায় দেওয়ার মতো প্রশিক্ষণ বা এখতিয়ার কি জজ সাহেবদের আছে? নাকি মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে যাব? কোন মন্ত্রীর কাছে যাব? নাকি চারুকলার ডিন স্যারের কাছে যাব? সেখানেও তো সমস্যা আছে। শিল্পীদের চিন্তা তো সবার এক নয়- মৃণাল হকের ঐসবকে কেউ ভাস্কর্য বলবেন কিনা জানিনা, কিন্তু একজন শিল্পী যেটাকে ভাস্কর্য বলবেন সেটাকে যদি অন্য কোন শিল্পী রদ্দি বলেন তাতে কি অবাক হবার কিছু আছে?
আচ্ছা, না হয় আমি একজনের কাছ থেকে একটা সার্টিফিকেট নিলাম যে এটা ভাস্কর্য নয় মূর্তি অথবা উল্টোটা, যে না এটা মূর্তি নয় ভাস্কর্য- তাতে কি হলো? বাংলাদেশে কি এমন কোন আইন আছে যে আমি আমার ঘরে বা আমার পাড়ার মোড়ে বা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে কোন ভাস্কর্য রাখতে পারবো না? বা কোন মূর্তি রাখতে পারবো না? নাই। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুইটা বড় স্থাপনা আছে, একটা আবদুল্লাহ খালিদ সাহেবের করা আরেকটা শামিম শিকদারের করা। ও, আরেকটা আছে, রাজু ভাস্কর্য। এছাড়া ব্রিটিশ কাউন্সিলের ঐদিকে ছোট ছোট অনেকগুলি ছিল একসময়- সেগুলি করেছেন নভেরা আহমেদ। সেগুলিকে যদি কেউ সার্টিফিকেট দিয়ে বলে যে না, এগুলি ভাস্কর্য নয় মূর্তি- সেগুলি ভেঙে ফেলতে হবে?
এগুলি ভাঙতে চায় এরকম লোক তো বাংলাদেশে সবসময়ই ছিল। অপরাজেয় বাংলা তখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, তখন জিয়াউর রহমানের সময়, তখন একদল লোক অপরাজেয় বাংলা ভাঙার জন্যে রাতের বেলা খন্তা কুড়াল নিয়ে হামলা করেছিল। বয়স্ক লোকজনকে জিজ্ঞেস করেন, ওদের মনে থাকবে। পুরনো খবরের কাগজে এই নিয়ে রিপোর্টও পাবেন। ঐ তস্করগুলিকে ডেকে এনে আমরা কি হাত জোড় করে বলবো, হুজুর এই যে দেখেন এইটা তো মূর্তি না ভাস্কর্য, এইটা ভাঙবেন না? নগরের এখানে সেখানে সাজ সজ্জার জন্যে বা কোন বিশিষ্ট জন্য বা ঐতিহাসিক ঘটনার স্মারক হিসাবে আমরা নানাকিছু স্থাপন করি। সেগুলি মূর্তি কি ভাস্কর্য সেই সার্টিফিকেট নিয়ে তবে স্থাপন করতে হবে?
শোনেন, মূর্তি না ভাস্কর্য এইসব কি ধরনের কথা জানেন? ঐ যে সেদিন বুড়িমারিতে একজন লোককে পিটিয়ে আগুনে পুড়ে মেরে ফেললো না? সেই ঘটনার পর কাদের যেন একটা তদন্ত কমিটি গিয়ে তদন্ত করেছে, খবরে বলছে যে ওরা নাকি রিপোর্ট দিয়েছে সেখানে ধর্ম অবমাননার কোন ঘটনা ঘটেনি। ভাবখানা যেন ধর্ম অবমাননার ঘটনা ঘটলে ওকে পিটিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলা সহি হতো! ফেসবুকেও দেখলাম অনেকে মৃতব্যক্তির টুপি পাঞ্জাবী পরা ফটো দিচ্ছেন- যে না, ওকে মেরে ফেলা ঠিক হয়নি। ভাবটা ঐটাই- ঐ লোক যদি বেনামাজি হতো তাইলে ওকে মেরে ফেলা ঠিক ছিল, নাকি?
এইসব হচ্ছে নতজানু মনোবৃত্তি। একদল লোক বলে বেড়াচ্ছে নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশ এখানে এই হবে না, সেই হবে না। ওরা হুমকি দিচ্ছে, জাফর ইকবালকে মারবে, শারিরার কবিরকে যেখানে পাওয়া যায় সেখানে পেটানো হবে। আনুষ্ঠানিকভাবে বলে ঘোষণা দিচ্ছে নাস্তিকদেরকে হত্যা করা হবে। এই দেশটা কি নব্বই পারসেন্টের একার দেশ? তাইলে হিন্দু ব্যাটা বেটিদের কি এটা দেশ নয়? বৌদ্ধদের? একজন লোক খৃস্টান- এটা কি তার দেশ নয়? এটা তো সকলের দেশ। একঘর ইহুদী ছিল দেশে, এখন আছে কিনা জানিনা- এটা তো ওদেরও দেশ। আর্মেনীয়ও ছিল কয়েকজন- ওদেরও তো দেশ এটা। কয়েকটা ট্রাইব আছে এদেশে, খুবই ছোট ছোট ট্রাইব- ওদের দেশ নয় এটা? নব্বই ভাগ হয়েছেন বলে এইটা ওদের দেশ হয়ে গেছে?
শোনেন, এইসব ঔদ্ধত্যকে যে প্রশ্রয় দিচ্ছেন, এর ফলাফল কি হবে জানেন? পাকিস্তানের একটা উদাহরণ দিই। পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ভদ্রলোক (নাকি গভর্নর ছিলেন ভুলে গেছি)। অন্যান্য পাকিস্তানীর তুলনায় একটু লিবারেল আর গনতন্ত্রমনা ছিলেন। পাঞ্জাবের আদালত যখন ইসলাম ধর্ম অবমাননার জন্যে কম বয়সী একটা খৃস্টান মেয়েকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে, ঐ বেচারা বলেছিল যে না, এই মেয়েটাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ঠিক হয়নি। ব্যাস। মুখ্যমন্ত্রীর যে গার্ডরা ছিল, সেই গার্ডদের মধ্যে একজন মেজর দিয়েছে মুখ্যমন্ত্রীকে গুলি করে। গুলি খেয়ে মুখ্যমন্ত্রী তো মারা গেলেন, ঐ মেজরের বিরুদ্ধে খুনের মামলা হয়েছে। মেজরকে পুলিশ যখন গ্রেফতার করে আদালতে নিয়ে যাচ্ছে, পুলিশের গাড়ীর সামনে পিছনে ডানে বাঁয়ে হাজার হাজার মুসলমানে চলেছে মেজরের সাথে- মেজরের নামে জিন্দাবাদ ধ্বনি দিচ্ছে। কি ব্যাপার? না, নাস্তিক মুরতাদকে মেরেছে মেজর সাহেব, সে তো নায়ক!
অনেকদূর চলে গেছেন, তবুও বলি, এখনো সময় আছে। ওদের প্রতি নতজানু হবেন তো ওরা দেশকে মৌলবাদী সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে পরিণত করবে। একটু পৃষ্ঠপোষকতা দিবেন তো আপনার ঘাড় ধরে আপনাকে নতজানু আজ্ঞাবহ করে ছাড়বে। বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছেন, সেটা কোন মৌলবাদী সন্ত্রাসী রাষ্ট্র নয়। নব্বই পারসেন্ট হয়েছে বলে বাকিদের কোন অধিকার থাকবে না, সেইরকম রাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু চাননি, এইজন্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। সাময়িকভাবে আপনার মনে হতে পারে যে ওদের সাথে মৈত্রী করে নানারকম সুবিধা নিবেন। কি সুবিধা আপনারা নিবেন জানি না, কিন্তু বিনিময়ে ওরা আপনাদেরকে একদম ইয়ে বানিয়ে ছাড়বে।
না এটা তো ভাস্কর্য, মূর্তি নয় বা না, আমি তো নাস্তিক নই আমাকে কেন মারবেন বা না, ঐ লোক তো মুরতাদ নয় ওকে কেন মারবেন বা না, সে তো ধর্ম অবমাননা করেনি, ওকে কেন মারবেন- মেহেরবানী করে এইসব কথা বলার আগে একটু ভেবে বলবেন। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখবেন, দেখবেন ধীরে ধীরে আপনার মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে যাচ্ছে।
লেখক- ইমতিয়াজ মাহমুদ, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। ইমেইল: [email protected]
খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। আইনিউজ- এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনিউজ আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ