Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, রোববার   ২০ এপ্রিল ২০২৫,   বৈশাখ ৭ ১৪৩২

রাহাত মিনহাজ

প্রকাশিত: ০১:৩৭, ১১ ডিসেম্বর ২০২০
আপডেট: ১৫:১৮, ১২ ডিসেম্বর ২০২০

ভারতীয় স্বীকৃতির ঐতিহাসিক সেই দিন

৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১। বিকেল আনুমানিক সাড়ে পাঁচটা। শীতকালের অল্প সময়ের বিকেলে পার হয়ে সন্ধ্যা একটু পরেই নামবে। কলকাতার এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতা করছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধি। এ সময় তার কাছে খবর আসে ভারতীর বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে বিমান হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান। একটু পরেই জানা যায় পাকিস্তানের বিমানগুলো ভারতের অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, অবন্তীপুর, উত্তরালই, যোধপুর, আম্বালা এমনকি দিল্লীর সন্নিকটে আগ্রার বিমান ঘাঁটিতে অতর্কিত হামলা চালিয়েছে। খবর পেয়েছে দ্রুত দিল্লীতে ফেরেন ইন্দিরা গান্ধি। রাতে ডাকেন মন্ত্রীসভার জরুরী বৈঠক। পাটনা থেকে অর্থমন্ত্রী, বোম্বে থেকে দেশরক্ষা মন্ত্রী দ্রুত ফেরেন দিল্লীতে। রাতে জরুরী বৈঠক শেষ হওয়ার একটু পরই সারাদেশে জরুরী অবস্থা জারী করা হয়। তার একটু পরেই রাত সাড়ে এগারোটার দিকে ভারতীয় বিমান বাহিনী শুরু করে পাল্টা হামলা।

বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশ ইতিহাসে এই হামলা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। কারণ এর মাধ্যমেই নতুন করে ইতিহাস তৈরীর ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিলো। পাকিস্তান এই হামলা চালিয়েছিলো ভিন্ন এক  উদ্দেশ্যে নিয়ে। পূর্ব রণাঙ্গণে পাকিস্তানের পরাজয় যখন শুধুই কিছু সময়ের জন্য তখন এই যুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে রূপ দিতে চেয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান।

বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশ ইতিহাসে এই হামলা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। কারণ এর মাধ্যমেই নতুন করে ইতিহাস তৈরীর ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিলো। পাকিস্তান এই হামলা চালিয়েছিলো ভিন্ন এক  উদ্দেশ্যে নিয়ে। পূর্ব রণাঙ্গণে পাকিস্তানের পরাজয় যখন শুধুই কিছু সময়ের জন্য তখন এই যুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে রূপ দিতে চেয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান। তার ধারণা ছিলো পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সহযোগিতায় যুদ্ধ বিরতীতে পৌঁছানো সম্ভব হবে। যার মাধ্যমে পাকিস্তান পরাজয়ের কলঙ্ক  থেকে রক্ষা পাবে। তার সেই পরিকল্পনা যে সফল হয়নি তা সবারই জানা। কারণ সেই সময় আরো পরিপক্ক ও চতুর কৌশল নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন ইন্দিরা গান্ধি। যার কাছে হেরে যান ইয়াহিয়া খান ও ভূট্টো গং। 

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে ভারতীয স্বীকৃতি অপরিহার্য ছিলো। ১৭ এপ্রিলে মুজিবনগর সরকার গঠনের পর থেকেই ভারতীয় সরকারের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেতে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছিলো আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব। কিন্তু ভারত এ পথে একটু ধীর গতিতে এগুচ্ছিলো। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে আন্তর্জাতিক ভারতকে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো। এছাড়া ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও বিষয়টি নিয়ে দ্বিধা-দ্ব›দ্ব ছিলো। তবে ৩ ডিসেম্বরের পাক হামলা সব দ্বিধা দূর করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার অনন্য সুযোগ এনে দেয়। 

প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দীন আহমদসহ অন্যান্য নেতারা জানতেন ভারতের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা অনেকটাই অসম্ভব। ৩ নভেম্বরের হামলার পর ভারতের কাছে ৪ নভেম্বর স্বীকৃতি চেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করে প্রবাসী সরকার ।

প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দীন আহমদসহ অন্যান্য নেতারা জানতেন ভারতের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা অনেকটাই অসম্ভব। ৩ নভেম্বরের হামলার পর ভারতের কাছে ৪ নভেম্বর স্বীকৃতি চেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করে প্রবাসী সরকার । প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দীন আহমদের যুক্ত স্বাক্ষরিত সেই চিঠিতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বীকৃতি দেওয়ার আবেদন করা হয়। যা ইন্দিরা গান্ধির মন্ত্রী সভা সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন করে। ইন্দিরা গান্ধি স্বাক্ষরিত আনুষ্ঠানিক এক চিঠিতে ৬ ডিসেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ভারত। এরপর বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের বিষয়টি ঘোষণা দিয়ে লোকসভার তার ব্যাখ্যা দেন ইন্দিরা গান্ধি। এ সময় বাংলাদেশের পক্ষে দিল্লীতে বাংলাদেশের বিশেষ দূত হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী (পরে জাতীয় সংসদের স্পীকার) এক ভাষণ দেন। তাতে তিনি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনতার পক্ষ থেকে ইন্দিরা গান্ধি ও ভারতীয় জনগণের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। 

হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী

এরপর পূর্ব রণাঙ্গনে যুদ্ধের জন্য ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ড গঠন করা হয়। ওদিকে পশ্চিমেও প্রবল আক্রমণ চালায় ভারতীয় সেনারা। দু দিতের তীব্র আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পাক বাহিনী। এদিকে মুক্তি পাগল বাঙ্গালীর সাথে বীর বিক্রমে দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলে যৌথ বাহিনীর সেনারা। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই ঢাকার উপকন্ঠে পৌছে যায় যৌথ বাহিনী।

এদিকে ভারতীয় স্বীকৃতির পর মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী কার্যালয়ে কলকাতার ৮ নাম্বার থিয়েটার রোডে আনন্দের বন্যা । সবাই জয় বাংলা ধ্বনিতে মুখরিত করে তোলে পুরো ভবন। সবারই জানা ছিলো ভারতের স্বীকৃতি মানেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ভারতীয় স্বীকৃতির সেই দিনের কথা চমরপত্র খ্যাত এম আর আখতার মুকুল তাঁর ‘আমি বিজয় দেখেছি’ বইটিতে তুলে ধরেছেন। তাতে তিনি লিখেছেন ‘ ৬ ডিসেম্বর ৮ নাম্বার থিয়েটার রোডে তুমুল উত্তেজনা। সুদীর্ঘ নয় মাস পর ভারত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তখন একটার পর একটা খবর এসে পৌছাচ্ছে। কামাল লোহানী, সুব্রত বড়ুয়া জালাল, আলী যাকের, আলমগীর কবীর কারও কোন বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ নেই। রাতেই খবর এলো মুক্তিবাহিনী লালমনিরহাটে পৌঁছেছে। সিলেট ও মৌলভীবাজার মুক্তির পথে। যে কোন সময় যশোরের পতন। প্রচন্ড আক্রমণে হানাদাররা পিছু হটছে’।  

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তখন একটার পর একটা খবর এসে পৌছাচ্ছে। কামাল লোহানী, সুব্রত বড়ুয়া জালাল, আলী যাকের, আলমগীর কবীর কারও কোন বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ নেই। রাতেই খবর এলো মুক্তিবাহিনী লালমনিরহাটে পৌঁছেছে। সিলেট ও মৌলভীবাজার মুক্তির পথে।

এদিকে দেশী বিদেশী শতাধিক সংবাদকর্মী ভিড় করেছেন থিয়েটার রোডের সেই কার্যালয়ে। তাজ উদ্দীন আহমদ তাদের ব্রিফ করেন। এক সংবাদিক তাঁকে তার অনুভূতির কথা প্রকাশ করতে বলেন। তাজউদ্দীন আহমদ বলেন ‘আজ যে সন্তানের জন্ম হলো তার পিতা (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) বহুদূর কারাগারে বন্দি। এ সন্তানের জনক আমি না, এর জনক শেখ মুজিবুর রহমান। আমি শুধু একজন ধাত্রীর কাজ করেছি মাত্র’। এরপরই জনাকীর্ণ সেই সংবাদ সম্মেলনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন দৃঢ় চিত্ত তাজ উদ্দীন আহমদ। 

রাহাত মিনহাজ, টেলিভিশন সাংবাদিকতায় সম্পৃক্ত এবং সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Green Tea
সর্বশেষ
জনপ্রিয়