জসীম উদ্দিন মাসুদ
আপডেট: ২৩:৫৪, ১৪ ডিসেম্বর ২০২০
মাথাপিছু আয় ২০৬৪ ডলার: অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের নেপথ্য গাথা
সংকটে ঘুরে দাঁড়ায় বাঙালি
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় বাংলাদেশের মানুষ শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ঘুরে দাঁড়াতে পারে এবং নতুন উদ্যমে বাঁচার সংগ্রামে সম্মিলিতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বিশ্ব অর্থনীতি যখন টালমাটাল অবস্থা ঠিক তখনও ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। যারা জোর গলায় বলেছিলেন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটা ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হবে, দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে এবং অসংখ্য মানুষ না খেয়ে মারা যেতে পারে তাদের সমুচিত জবাব দিতে বাঙালির চিরচেনা সেই সত্ত্বাই যেন পুনরায় জেগে উঠেছে । বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এই মহাদুর্যোগকালীন সময়ে আমাদের জন্যে আশা জাগানিয়া যে সুখবরটি দিয়েছে তা হলো, “বর্তমানে দেশে মাথাপিছু আয় ২০৬৪ মার্কিন ডলার এবং এ বছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ”। সবচেয়ে সুখকর বিষয়টি হচ্ছে দেশে দুর্ভিক্ষও দেখা দেয়নি এবং একজন মানুষও না খেয়ে মারা যায়নি।
নতুন দিনের স্বপ্ন ভাবনা
করোনা মোকাবিলায় সরকার ঘোষিত প্রণোদনায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে গতি ফিরতে শুরু করেছে। এডিবি’র এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক-২০২০ আপডেট প্রতিবেদন বলছে, দ্বিতীয় দফায় করোনার ছোবলে না পড়লে বাংলাদেশ টেকসই অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে পারবে। তবে বাংলাদেশে যেসব দেশ থেকে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় আসে সেসব দেশ নতুন করে বিপর্যয়ের মুখে না পড়লে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি সামনের দিকে থাকবে।
এডিবি বলছে, বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়েছে। রেকর্ড রেমিট্যান্স আসছে। রপ্তানি স্বাভাবিক ধারায় ফিরছে। ফেরত আসা প্রবাসী শ্রমিকরা আবার ফিরে যেতে শুরু করেছেন। পোশাক খাতে বাতিল হওয়া রপ্তানি আদেশ তুলে নেওয়া হচ্ছে। আগস্ট মাস থেকে অর্থনীতি সচল রাখার চাকা আবার ঘুরতে শুরু করেছে। আশা করা হচ্ছে আগামীতে বাংলাদেশের অর্থনীতি টেকসই হবে।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার খসড়ায় দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে, করোনার প্রভাব কেটে গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতি সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও আগামী অর্থবছরে এই লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ।
এরই মধ্যে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরসহ বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ জোরেশোরে শুরু হয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় সমুদ্র থেকে জেগে ওঠা চর চিহ্নিত করে সেখানে শিল্পাঞ্চল নির্মাণের কাজও চলছে। কৃষিজমি রক্ষায় দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সব বিভাগে পল্লী জনপদ তৈরি করা হচ্ছে। সেখানে নিম্ন আয়ের মানুষ পরিকল্পিতভাবে আবাসিক ভবনে বসবাস করার সুযোগ পাচ্ছে।
করোনা মোকাবিলায় কৃষকদের জন্য কয়েকটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। এর মধ্যে ৪ শতাংশ সুদ হারে ঋণ প্রদান, নয় হাজার কোটি টাকার কৃষি ভর্তুকি, ৮৬০ কোটি টাকার বোরো ধান সংগ্রহ, ২০০ কোটি টাকার কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়, ১৫০ কোটি টাকার আমন বীজ প্রদানসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। করোনাকালে কৃষি অর্থনীতিতে যা সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
নেদারল্যান্ডস পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত প্রতিবছর বন্যায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঠেকাতে টেকসই বদ্বীপ ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করায় ১৯৫৪ সালের পর আর বন্যা দেখেনি সেখানকার মানুষ। নেদারল্যান্ডসের সেই ডেল্টা ব্যবস্থাপনার আলোকে দুই বছর আগে ১০০ বছর মেয়াদি যে বদ্বীপ পরিকল্পনাটি অনুমোদন দেওয়া হয়, সেটির আলোকেই এখন উন্নয়ন বাজেটে নদীভাঙন রোধ, নদীশাসন, নদী ব্যবস্থাপনাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়া শুরু হয়েছে।
শেষ কথা- আমরা ঘুরে দাঁড়াচ্ছি, ঘুরে দাঁড়াবোই
করোনাভাইরাসের সংক্রমণে অর্থনীতির ক্ষতি হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। বেকারত্ব বাড়বে, দারিদ্র বাড়বে, ব্যাংকের অবস্থা খারাপ হবে, মানুষের আয় কমবে, সামগ্রিক ব্যয় কমবে, রপ্তানি আয় কমবে, বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হবে এবং সার্বিকভাবে দেশের প্রবৃদ্ধি কমবে- এ ব্যাপারে সবাই একমত। তবে বর্তমানে অর্থনীতির নানা সূচক বিশ্লেষণ করে বলা যায় আমাদের অর্থনীতি শুধু ঘুরেই দাঁড়ায়নি সব কিছু মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি পরিস্থিতি বেশ মজবুত অবস্থানে রযেছে।
এটাও ঠিক আমাদের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কত দ্রুত সম্ভব হবে, সেটা নির্ভর করে বৈশ্বিক অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর গতিপ্রকৃতির ওপর। কারণ আমাদের অর্থনীতির কিছুটা বৈশ্বিক বাজারনির্ভর। হয়তো ভ্যাকসিন শীঘ্রই চলে আসবে। ভ্যাকসিন যদি চলে আসে, তাহলে সবকিছু স্বাভাবিক হতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড কাজ লাগাতে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে এগুলো দৃশ্যমান হলে আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে বাংলাদেশ।
এটা ঠিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে বিবিএসের পরিসংখ্যান প্রথমে অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেননি। কিন্তু যখন বিশ্বব্যাংক, এডিবি, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম পরিসংখ্যান সঠিক বলছে, তখন তারা সুর পরিবর্তন করে বলতে শুরু করল প্রবৃদ্ধি কর্মসংস্থানহীন। আসল কথা হলো অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও স্বনির্ভরতায় এখন সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। তাহলেই আমরা আরো জোর দিয়ে বলতে পারবো- ‘আমরা ঘুরে দাঁড়াচ্ছি, ঘুরে দাঁড়াবোই’।
জসীম উদ্দীন মাসুদ জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা, মৌলভীবাজার জেলা।
- খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ