ইমতিয়াজ মাহমুদ
অন্ধের দেশে দাসদের মধ্যে বসবাস
যখন একজন অভিজিৎ রায়কে ওরা হত্যা করে, তখন আপনার কণ্ঠ খুলে প্রতিবাদ করা প্রয়োজন। প্রয়োজন সেটা আপনার স্বার্থেই। ওরা যখন একজনের কণ্ঠ রোধ করে, তখন আপনার প্রতিবাদ করা প্রয়োজন সেটা আপনার নিজের স্বার্থেই। আপনারা সেটা করেন না। কথাটা অপ্রিয় বটে, কিন্তু সত্যি কথা। বইমেলায় যখন এক প্রকাশকের স্টল বন্ধ করে দেয় পুলিশ এসে, প্রকাশককে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় আপনারা তখন চুপচাপ থাকেন। পুলিশ এসে বইমেলায় ঘুরঘুর করে আর সিদ্ধান্ত দেয় কোন বই মেলায় বিক্রি করা যাবে আর কোন বই বিক্রি করা আবে না তখন আপনারা কি করেন? আপনারা প্রতিবাদ করেছেন? করেননি। উল্টো আপনারা কন্টেন্ট বিচার করতে বসে যান।
আপনারা প্রতিবাদ করেন কেবল তখনই যখন আপনাদের প্রিয় কারো বা পছন্দের কারো বাক ও চিন্তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়। যাদেরকে আপনারা পছন্দ করেন না ওদের বিরুদ্ধে যখন কেউ হামলা করে বা আক্রমণ পরিচালনা করে তখন আপনারা একরকম বিকৃত আনন্দ উপভোগ করেন। এই দেশে টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ করা হয়েছে, খবরের কাগজ বন্ধ করা হয়েছে। আপনারা সেসবের প্রতিবাদ করেননি কারণ আপনারা সেইসব টেলিভিশন চ্যানেল বা খবরের কাগজ সেগুলিকে পছন্দ করেননা। একজন সম্পাদককে মাসের পর মাস জেলে আটকে রাখা হয়েছে, আপনারা টু শব্দটি করেননি- কেননা সেই সম্পাদককে আপনারা পছন্দ করেন না।
শহিদুল আলমকে জেলে আটকে রাখলো পুলিশ, আপনারা কি করেছেন তখন? আমি তো দেখেছি আপনাদের অনেকেই তখন শহিদুল আলমের মামা বা খালু কেউ রাজাকার ছিল কিনা সেই গবেষণায় ব্যস্ত ছিলেন। ভাবখানা যেন শহিদুলের খালু চাচা মামা বা ফুপা কেউ রাজাকার থাকলে তাঁকে জেলে আটকে রাখাটা জায়েজ আছে, যান তাইলে শহিদুলের কোন কথা বলার অধিকার নাই ইত্যাদি। একের পর এক মুক্তমনা লেখকদের হত্যা করা হয়েছে, হামলা হয়েছে ওদের উপর, আসিফ মহিউদ্দিন সহ অনেককেই দেশ ছাড়তে হয়েছে। আপনারা তো সেইভাবে প্রতিবাদ করেননি।
(২)
এমনকি সিনেমা নিয়েও এইসব কাণ্ডকারখানা হয়েছে। ম থেংগাড়ী বা মাই বাইসাইকেল নামে চাকমা ভাষায় একটা সিনেমা বানিয়েছিল এক তরুণ নির্মাতা। সেই সিনেমা বাংলাদেশে দেখানোর জন্যে সার্টিফিকেট দিল না সেন্সর বোর্ড। কেন? শুনেছি মিলিটারির লোকজন নাকি আপত্তি জানিয়েছিল সেই কারণে সার্টিফিকেট দেয়নি সেন্সর বোর্ড। এইটা তো বিশ্বাসযোগ্য কোন কথা নয় আরকি। সেন্সরবোর্ড কেন মিলিটারির কথায় ওদের সিদ্ধান্ত নিবে। সেন্সর বোর্ড তো নিজের বিবেচনায় স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা। কি হয়েছে জানিনা, প্রকাশ্যে খবরের কাগজে স্পষ্ট করে কোন তথ্য এসেছে কি? আমি দেখিনি। কিন্তু কথা সেটা নয়, কথা হচ্ছে যে আপনারা সিনেমার লোকেরা কি ম থেংগাড়ীর জন্যে প্রতিবাদ করেছিলেন?
না, করেননি। আমাদের এফডিসিকেন্দ্রিক সিনেমাওয়ালাদের কথা বাদই দিলাম, যারা নিজেদেরকে ভাল নির্মাতা মনে করেন, দেশে বিদেশে পুরস্কারের জন্যে সিনেমা নিয়ে যান, আপনার কে কতোটুকু প্রতিবাদ করেছিলেন? করেননি। সেরকম উল্লেখযোগ্য কোন প্রতিবাদ আমার চোখে পড়েনি। এই প্রসঙ্গে মনে পড়লো, আপনাদের একজন বড় ফিল্মমেকার তো মুক্তমনা লেখক ব্লগারদের নিন্দায়ও নেমেছিলেন একসময়। মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা প্রসঙ্গেই ঐ লোকটা ঐসব লেখকের সয়ালচনায় নেমেছিলেন। গাধাটার মাথায় এই কথাটা কেউ ঢুকায়নি যে লেখার কন্টেন্ট বিবেচনায় লেখকের স্বাধীনতা নির্ধারিত হয় না।
আপনারা বাক ও চিন্তার স্বাধীনতার কথা সকলেই জানেন। বাঙালি তো কোটেশন মুখস্ত করার ব্যাপারে খুবই পাকা, ভল্টেয়ারের সেই কথাটাও আপনারা অনেকেউ মুখস্ত জানেন, যে আমি তোমার কথা সমর্থন নাও করতে পারি কিন্তু কথাটি বলার জন্যে তোমার যে স্বাধীনতা সেটি রক্ষায় রক্ত ঝরাতে রাজি আছি। কোটেশন মুখস্ত আছে ঠিকই, কিন্তু কাজের বেলায় সেটা দেখা মনে থাকে না আপনাদের। এইসবের ফলাফল কি? এইসবের ফলাফল ঐটাই- এখন একজন সিনেমা পরিচালক আর একজন অভিনেতা জেলে আটক আছে। কেন? সিনেমাতে নাকি পুলিশকে মন্দ রূপে দেখানো হয়েছে, সেই অপরাধে একজন অভিনেতা আর পরিচালক গ্রেফতার হয়ে জেলে আছেন।
(৩)
এই সিনেমাটা এফডিসি কেন্দ্রিক পপুলার সিনেমাগুলিরই একটা। সিনেমার নাম নবাব এলএলবি। সিনেমাতে নাকি একজন অসৎ পুলিশ কর্মকর্তার একটা ক্যারেক্টার আছে। এতে করে নাকি বাংলাদেশের পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে এই অভিযোগে সিনেমার একজন অভিনেতা শাহিন মৃধা ও সিনেমার পরিচালক অনন্য মামুনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
পুলিশ বলছে, সম্প্রতি ফেসবুকে নবাব এলএলবি ছবির একটি ভিডিও খণ্ডচিত্র ভাইরাল হয়েছে। সেখানে দেখা যায় একজন ধর্ষিতা নারী থানায় এসে পুলিশের কাছে ধর্ষণের বিষয়ে অভিযোগকালে পুলিশ তাকে অত্যন্ত আপত্তিকর ইঙ্গিত ও অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। যা সুস্থ বিনোদনের পরিপন্থী এবং জনসাধারণের মধ্যে পুলিশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করবে। এমন আপত্তিকর ও অশ্লীল সংলাপ সংবলিত ভিডিও খণ্ড চিত্র তৈরি ও অভিনয়ের জন্য দুইজনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ।
আপনারাই বলেন। পুলিশ আমাকে বলে দিবে কোনটা সুস্থ বিনোদন আর কোনটা অসুস্থ বিনোদন? আর পুলিশের কাছে কোন কিছু অশ্লীল মনে হলেই পুলিশ সেই সিনেমা নির্মাতাকে গ্রেফতার করবে? এটা কি কোন সভ্য সমাজের আচরণ হয়েছে?
ইন্টারেস্টিং ব্যাপার কি জানেন? এই বিষয়টা নিয়ে আপনি সিনেমার লোকজনকে খুব একটা প্রতিবাদ করতে দেখবেন না। আপনাকে আমি এখনই বলে দিতে পারি, সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি এক হয়ে প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা, ওদের মধ্যে এইটা নিয়ে কোন অসন্তোষই আপনি দেখতে পাবেন না। যদি দুই একজন এইটা নিয়ে বিবৃতি ফিব্রিতি কিছু দেয়ও, ওরাও এই শিল্পী ও এই পরিচালকের মুক্তি চাইবে কি বলে জানেন? ওরা নাকি সুরে বলবে যে না, নির্মাতা আর অভিনেতা ওরা তো পুলিশকে হেয় করতে চায়নি, ওদের উদ্দেশ্য খারাপ না, ওরা পুরো পুলিশবাহিনীকে মন্দ বলেনি, প্লিজ ওদেরকে ছেড়ে দেন। বাক ও চিন্তার স্বাধীনতার কথাটা কেউ বলবে না।
(৪)
বাক ও চিন্তার স্বাধীনতার কথাটা কেউ বলবে না। কেউ বলবে না যে এই পরিচালক ও অভিনেতাকে গ্রেফতার করা অন্যায় হয়েছে। কেউ বলবে না যে ওদের স্বাধীনতা আছে যা ইচ্ছা তাই বলার। কেউ বলবে না যে ওরা শিল্পী, ওদের শিল্পকর্মের কন্টেন্ট আপনার পছন্দ নাও হলে আনি, কিন্তু ওদের কণ্ঠ রোধ করার অধিকার পুলিশের নাই। কেন বলবে না? কারণ ওরা এইরকম একটা সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যাবস্থা মেনেই নিয়ে বসে আছে যেখানে শিল্পীদের স্বাধীনতা থাকবে না, লেখকদের স্বাধীনতা থাকবে না। ওরা মেনে নিয়েই বসে আছে যে এই রাষ্ট্রে পুলিশ ঠিক করে দিবে কোন কথাটা বলার অধিকার আছে আর কোন কথাটা বলার অধিকার নাই।
একটা স্বাধীন দেশ প্রকৃত অর্থে তখনই স্বাধীন হয় যখন সেখানে মানুষের বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা থাকে। যে রাষ্ট্রে মানুষকে কথা বলার জন্যে শাস্তি ভোগ করতে হয় সেটি কখনোই একটা স্বাধীন আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয় না। এইটা একটা মৌলিক নীতি- এইটা যখন আপনাকে বারবার চীৎকার করে করে বলতে হবে কেন?
ভাল লাগে না। মনে হয় অন্ধের দেশে দাসদের মধ্যে বসবাস করছি। অসহায় লাগে। মানুষের বাক ও চিন্তার স্বাধীনতার মত একটা অতি প্রাথমিক ওঁ অতি মৌলিক বিষয় নিয়ে এখনো কে এতো কথা বলতে হবে? এটা কিসের লক্ষণ!
লেখক- ইমতিয়াজ মাহমুদ, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
ইমেইল: [email protected]
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ