বঙ্গবন্ধুর আগরতলা মিশন: একটি অনালোচিত অধ্যায়
ধর্মভিত্তিক চিহ্নায়নে প্রতিষ্ঠিত ‘পাকিস্তান’ রাষ্ট্রের জন্মলগ্নে একজন তুখোড় ছাত্রনেতা হিসেবে বিশেষত সিলেটের ‘রেফারেন্ডামে’ শেখ মুজিবুর রহমানের যে কার্যক্রম চোখে পড়ে, ক্ষণকাল পরেই তাঁর মোহভঙ্গের পালাও লক্ষণীয়। পাকিস্তানি শাসকদের নির্লজ্জ কাণ্ড দেখে তাঁর জীবনদর্শনে পূর্ব বাংলার মাটি, মানুষ এবং অসাম্প্রদায়িক বাঙালির জাতিসত্তা সমান্তরালবর্তী হয়ে ভিন্ন স্রোতে যাত্রা করে। এই কালপর্বে তাঁর কৌশলগত রাজনৈতিক চিন্তন ও কর্মকাণ্ডের পরম্পরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পথরেখা সৃষ্টি করেছিল।
পাকিদের শোষণ, বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িক প্রবণতাপুষ্ট রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা দেখে তিনি বাঙালির শাশ্বত শিকড় আঁকড়ে ধরে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। ফলে পদে পদে তাঁকে জেলে যেতে হয়, অন্যদিকে তিনি রাতারাতি জনগণের স্বপ্নপুরুষ হয়ে ওঠেন। তাঁর চিন্তাভাবনাকে বাস্তবায়নের জন্য তিনি অন্যান্য দেশের জাতীয়তাবাদী নেতার মতো আশপাশের বিশ্বস্ত রাষ্ট্রনেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর সশস্ত্র লাইন ধরার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বলা যায় যে, অনেকটা নিয়মতান্ত্রিক পথই অনুসরণ করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু তখন বহির্বিশ্বে খ্যাতি লাভ না করলেও তাঁর জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা-রণকৌশলের কথা সমমনাদের জানানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। সম্ভবত তারই অংশ হিসেবে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬২ সালে গোপনে আগরতলার মাধ্যমে দিল্লির সঙ্গে বোঝাপড়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানি শোষণের পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলায় গড়ে ওঠার অপ্রতিরোধ্য সংগ্রামের বার্তা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে জানান দেয়া, সেই সরকারের মনোভাব বোঝা এবং যোগাযোগ স্থাপন করতে আগরতলা গিয়েছিলেন বলে সম্প্রতি কিছু তথ্যপ্রমাণাদি পাওয়া গেছে। এই ঘটনাটি তাঁর জন্মশতবর্ষে মূল্যায়িত হওয়ার অবকাশ রাখে। কিন্তু কারো কোনো অনুসন্ধানী লেখায়, জীবনী গ্রন্থে এই দিকটি ব্যাপক আলোচিত হয়নি বলে প্রতীয়মান।
শেখ মুজিব আগরতলা যাত্রা বিষয়টি এমন গোপনে করেছিলেন যে, দলের সিনিয়র নেতারা পর্যন্ত আঁচ করতে পারেনি। সামরিক শাসক আইয়ুবের বাঘা বাঘা পাক গোয়েন্দারাও টের পায়নি। সম্ভবত পরে বিষয়টি কিছু আঁচ করে পাক সরকার ১৯৬৮ সালে ইতিহাসে খ্যাত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ হিসেবে মামলা দায়ের করে। কিন্তু ঘটনা অনুদ্ঘাটিত থাকে। এই মামলার মাধ্যমে পাক সরকার দেশ ভাঙার ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে চিরতরে ‘রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন’ করার পাঁয়তারা কষে।
সরকার ভেবেছিল এই কৌশল গ্রহণ করলে বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা কমবে এবং ভবিষ্যতের পথ পরিষ্কার হয়ে যাবে। অথচ অতি দ্রুত তিনি জাতির ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। পাকিস্তানের প্রতি জনমানুষের ঘৃণার পুঞ্জীভূত রূপ অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু কখন, কতবার আগরতলা গিয়েছিলেন তাও অস্পষ্ট রয়ে গেছে। ক্যাপ্টেন এ শওকত আলী তার তথ্যপূর্ণ ‘সত্য মামলা আগরতলা’ [প্রথমা, ২০১১] গ্রন্থে তিনি কেবল মামলার ওপর জোর দেন কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আগরতলা যাওয়ার বিষয়ে কেন ভেতরের সত্যটুকু গোপন রাখলেন তা বোঝার উপায় নেই। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর গোপনে আগরতলা যাত্রার কথা অনুপস্থিত থাকে। তাহলে বলা যায় যে, ‘আগরতলা মামলা’ সত্য ছিল? কিন্তু ইতিহাসের ভেতরে সত্যটি অজ্ঞাত থাকল!
১৯৬২ সালে বঙ্গবন্ধুর আগরতলা যাওয়ার অধ্যায়টি অনেকটা গোপনই থেকে যেত- যদি প্রখ্যাত ভারতীয় সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্য, মানস পাল, অমিতাভ ভট্টাচার্য, ফণীভূষণ পালসহ কয়েকজন অনুসন্ধানী কাজ না করতেন। পরে বিবিসির অনুসন্ধানী রিপোর্টে এই সত্যতা উদ্ঘাটিত হয়েছে। ১৯৬২ সালে গণতন্ত্র পুনরুদ্বার আন্দোলনের কারণে বঙ্গবন্ধু অনেকটা সময় বাসায় নজরবন্দি ছিলেন, তার ঢাকার বাইরে যাওয়া নিষেধ ছিল। তবু তিনি সময়ের প্রয়োজনে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মতো দিন দুইয়েকের জন্য ‘অন্তর্ধান’ করেছিলেন, যা কেউ টের পায়নি।
বঙ্গবন্ধু আগরতলা যাওয়ার বিষয়টি সংঘটিত হয় সম্ভবত তাঁরই ছকে ও অতি গোপনে। তিনি নিজের কয়েকজন পরম বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য বন্ধু ছাড়া দলের কাউকে কিছু বলেননি। তাঁর সংশ্লিষ্ট বন্ধুরাও যাত্রার বিষয় আঁচ করতে পারেননি। এক একজনের দায়িত্ব ছিল আলাদা, অন্যরা অপরের কাজের গতিপ্রকৃতি ও অবস্থান জানত না। তাঁদের সবার জন্য ছিল সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা। বঙ্গবন্ধু নিশ্চয়ই অদৃশ্য কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র ধরে/লোকের মাধ্যমে/ অথবা সবুজ সংকেত পেয়ে আগরতলায় যোগাযোগ করে নিশ্চয় সেদিকে পা রেখেছিলেন।
এই পর্বে তাঁর বিশ্বস্ত বন্ধু ছিলেন তারেক আহমেদ চৌধুরী [বাড়ি: চট্টগ্রাম], আমীর হোসেন চৌধুরী [বাড়ি: কুমিল্লা জেলার বুড়িচং উপজেলার সিধলাই গ্রাম। তিনি জগন্নাথ কলেজে ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন]। তাঁরা দুইজন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আগরতলা পর্যন্ত গিয়েছিলেন। তা ছাড়া তাঁর আরেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন মোয়াজ্জেম হোসেন [(১৯২২-২০০২); বাড়ি: হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার পানিউমদা গ্রাম]। তাঁর পুরো নাম দেওয়ান মোয়াজ্জেম আহমদ চৌধুরী। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। অন্যদিকে ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী রেজা আলী [বাড়ি: ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা গ্রাম।] বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মর্তুজা খান [ছাত্র ইউনিয়ন করতেন এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র ছিলেন]। মূলত তারাই আড়ালে থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন।
বঙ্গবন্ধুর তাঁর আগের পরিচিত জায়গা শ্রীমঙ্গল হয়ে আগরতলা যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। কেন তিনি কুমিল্লা হয়ে আগরতলা গেলেন না? তাও একটা প্রশ্ন থেকে যায়। কুমিল্লার সালদা দিয়ে বা আখাউড়া দিয়ে অথবা তেলিয়াপাড়া হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি ছিল অনেক বেশি। সেখানে সীমান্ত ফাঁড়ি ছিল ঘন ঘন। শ্রীমঙ্গল থেকে চা-বাগান পথে ত্রিপুরা যাওয়ার রাস্তা অনেক নিরাপদ ছিল। বঙ্গবন্ধুর শ্রীমঙ্গল থেকে চা-বাগান হয়ে ত্রিপুরা সীমান্ত পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থায় ছিলেন মোয়াজ্জেম সাহেব। তার দায়িত্ব ছিল ভোরে ট্রেন থেকে শেখ মুজিবকে রিসিভ করে বাগানে নেয়া। তখন শ্রীমঙ্গল এলাকার রাজঘাট ও বিদ্যাবিল চা-বাগানে তার প্রভাব ছিল। পরিকল্পনামতো ফুলবাড়িয়া স্টেশন থেকে [ঢাকা স্টেশনের পূর্ব নাম] মর্তুজা খান নিজের নামে ট্রেনের প্রথম শ্রেণির কামরার দুটি টিকিট করেন। ট্রেনটি রাত ১০টায় সিলেটের উদ্দেশে ছাড়ত।
নির্ধারিত দিন [প্রামাণ্য তারিখ জানা যায় না। তবে তৎকালীন খোয়াই মহকুমা এসডিও স্মরজিৎ চক্রবর্তীর (কুমিল্লার লোক) ডায়েরি সূত্রে বলা যায় যে, সম্ভাব্য তারিখ ছিল ৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬২] ডিবি পুলিশের নজর এড়াতে মর্তুজা খান ঢাকা স্টেশনে কামরায় উঠে বসেন। আমীর হোসেন চৌধুরী গেলেন অন্য কামরায়। গাড়ি যথারীতি ঢাকা স্টেশন ছেড়ে টঙ্গী স্টেশন থামে। অতঃপর গাড়ি ছেড়ে বাঁক নেয়ার সময় কেবা কারা চেইন টেনে গাড়ির গতি থামিয়ে দেয়, অন্ধকারের মধ্যে মর্তুজা কামরা থেকে নামলেন, অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু ও তারেক আহমদ চৌধুরী দ্রুত কামরায় উঠে বসেন। শীতকাল থাকায় শেখ মুজিব কোট দিয়ে মুখ কিছুটা ঢাকলেন, তারেক চাদর দিয়ে। কিন্তু গাড়ি কেন রাস্তায় থামল তা নিয়ে কোনো তদন্ত না হওয়ার কারণে ধারণা করা হয় ট্রেনের কোনো কর্তৃপক্ষ কিছুটা হয়তো জানত। রেজা আলী শ্রীমঙ্গল পর্যন্ত আসলেও তিনি সিলেটে গিয়ে নামেন। প্রায় ভোরে ট্রেন থেকে শেখ মুজিব, তারেক আহমদ চৌধুরী ও আমীর হোসেন চৌধুরী নামলে মোয়াজ্জেম হোসেন গোপনে তাদের রাজঘাট চা-বাগানে নিয়ে আপ্যায়ন করান। পরে বিদ্যাবিল হয়ে সীমান্তে পাঠানো হয়- পথ দেখায় মোয়াজ্জেম সাহেবের অনুগত একজন শ্রমিক সর্দার।
কথা ছিল সীমান্ত অঞ্চল থেকে অন্য লোক এসে তাঁকে আগরতলা নিয়ে যাবে। কিন্তু তিনি সীমান্তে অপেক্ষার পর কেউ না আসায় আমীর হোসেন ওপারে গিয়ে বিএসএফ-এর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাদের কাছে এ ধরনের তথ্য নেই বলে জানানো হয়। সম্ভবত Communication সঠিকভাবে না হওয়ার কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল- যা বঙ্গবন্ধুকে বিচলিত করেছিল। পরে তাঁরা পায়ে হেঁটে খোয়াই মহকুমা এসডিও অফিসে গিয়ে মহকুমা প্রশাসক স্মরজিৎ চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা করেন। স্মরজিৎ চক্রবর্তী তাঁর ৫ ফেব্রুয়ারির ডায়েরিতে [১৯৬২] শেখ মুজিবুর রহমান, তারেক আহমদ চৌধুরী ও আমীর হোসেন যাওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে।
প্রখ্যাত সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্যকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আমীর হোসেন বলেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধুকে তখন খুব চিন্তিত মনে হয়েছিল এবং তিনি বলেছিলেন কোথাও Communication গ্যাপ হয়ে গেছে। অর্থাৎ আসল সোর্স সেখানে ছিলেন না। অগত্যা এসডিও সাহেব আগরতলার সঙ্গে কথা বলে তেলিয়ামুড়া হয়ে বঙ্গবন্ধুকে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। মহকুমা প্রশাসকের গাড়িতে করে করে বঙ্গবন্ধু আগরতলায় গিয়ে পুলিশ হেড অফিসের গোয়েন্দা শাখায় চলে যান। কিন্তু সম্ভবত উচ্চ পর্যায়ের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। রাতে তিনজনের থাকার জন্য গোপন ও নিরাপদ ব্যবস্থা হয়েছিল আগরতলা কেন্দ্রীয় কারাগারের নতুন ভবনে। সেখানে থাকার জন্য আপত্তি জানালে তাঁদের বলা হয় যে পাক গোয়েন্দারা ঘটনা ও অবস্থান জেনে ফেললে বিপদ হতে পারে। তা ছাড়া তাদেরও নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত। বিষয়টি অতি গোপনে হয়েছিল। আবার সীমান্ত পাড়ি দেয়ার কারণে আইনমতো জেলে অতিথিশালায় থাকা যুক্তিযুক্ত। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গীদ্বয় তাঁকে রাতে একা একটি কক্ষে [ভি আই পি] থাকার ব্যাপারে আপত্তি করলে আমীর হোসেনকে তাঁর সঙ্গে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। জেল সুপারিনটেনডেন্ট ননী গোপাল কর ভৌমিক এমনভাবে ব্যবস্থা করলেন যে ‘কাক-পক্ষী’ও জানার সুযোগ থাকল না।
পরদিন সকালে রাজ্য সরকারের চিফ সেক্রেটারি মি. বি এন রমণ জেলে এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বঙ্গবন্ধু রমণকে বলেন, ‘প্রথমত কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে একটা যোগাযোগ ও কথা বলার ব্যবস্থা করে দিন। আমরা কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে কথা বলতে চাই। আমরা যে উদ্দেশ্যে আগরতলায় এসেছি এ বিষয়টা বিস্তারিতভাবে ভারত সরকারকে জানাতে চাই।’ মুজিব বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের ওপর যেভাবে স্টিম রোলার চালিয়েছে তার থেকে মুক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে আমরা ভারতের সাহায্য চাই।’ [দ্রষ্টব্য: অনিল ভট্টাচার্য, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরা: অজানা তথ্য ও ঘটনা, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০১৯, পৃ. ৮৩]। বঙ্গবন্ধু রাজ্যের মুখ্য সচিবের মাধ্যমে কংগ্রেসের প্রভাবশালী নেতা ও রাজ্যের চেয়ারম্যান শচীন সিংহের [শচীন্দ্রলাল সিংহ (১৯০৭-২০০০), পরে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী] সঙ্গে যোগাযোগ করে দেয়ার কথা বলেন। কিন্তু নানা কারণে যোগাযোগ স্থাপিত হয়নি। শচীন সিংহ ছিলেন ত্রিপুরার বাইরে। পরে বঙ্গবন্ধু পররাষ্ট্রমন্ত্রী কৃষ্ণমেলনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন- কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশ ছিলেন।
শেখ মুজিব দেখলেন এই মুহূর্তে দিল্লির [জওহরলাল সরকার] সঙ্গে কার্যত যোগাযোগ হচ্ছে না। তিনি বুঝেছিলেন পরিকল্পিত ছকের কোথাও যেন বিরাট ঘাটতি রয়েছে। দিল্লি থেকে আশার কোনো বাণী না আসায় চিফ সেক্রেটারি মি. বি এন রমণ প্রস্তাব দিলেন তাঁর আসার উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা একটা কাগজে লিখে দিতে। তা হলে তিনি কেন্দ্রের কাছে পৌঁছাতে পারবেন। এই পরামর্শমতো শেখ মুজিবুর রহমান লেখার জন্য টাইপিস্ট চাইলেন। পরে তিনি মূল বিষয়বস্তুর সারসংক্ষেপ চিঠির মতো টাইপ করিয়ে [তিনজনেই স্বাক্ষরসহ] রাজ্য সচিবের হাতে তুলে দেন। চিঠিতে বলা হয়,
‘আমাদের দেশ স্বাধীন হলে অর্থাৎ বাংলাদেশ হলে যে সকল জিনিসপত্র আমাদের প্রোডাকশন হবে না সেগুলো আমরা ভারত থেকে আমদানি করব। কিন্তু আমরা কোনো Political Supremacy ভারতকে করতে দেব না।’ [পৃ. ৮৪]
তখন পাক গোয়েন্দারা কিছু বিষয় আঁচ করার চেষ্টা চালায়। দিল্লি অবগত হয়ে ত্রিপুরাকে জানায় যে সতর্ক অবস্থানে থেকে তাঁকে ফেরত পাঠাতে। ফলে বঙ্গবন্ধুকে সীমান্ত দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ফেরত পাঠানোর প্রয়োজন পড়েছিল। তবে এই সম্পর্কিত কোনো তথ্য বাইরে যায়নি। অবশেষে আগরতলার এডিশনাল এসপি মি. আর সি কোচরা নিরাপত্তা ফোর্স দিয়ে শেষ রাতে বিশালগড় হয়ে মালদা দিয়ে সীমান্ত পার করে দেন। তাঁরা তিনজন পূর্ব বাংলার সীমান্তবর্তী কোনাকাটা চোব্বাশ গ্রামে আমীর হোসেনের এক আত্মীয় বাড়িতে ভোরবেলা ওঠেন। পরে খুব সকালে হেঁটে বুড়িচং থানার সিধলাই গ্রামে আমীর হোসেনের বাড়িতে পৌঁছান।
অসীম সাহস নিয়ে বঙ্গবন্ধু আগরতলা থেকে ফিরলেও তাঁর নিরাপত্তার প্রশ্ন ছিল প্রধান। তাঁর অন্যতম বিশ্বস্ত সঙ্গী তারেক চৌধুরী ট্রেনে করে ঢাকার পথ ধরেন। আর শেখ মুজিব ও আমীর হোসেন হেঁটে ঢাকার দিকে রওনা দেন। শেখ মুজিবকে অনেকটা ছদ্মবেশে [মাথায় চাদর, পরনে লুঙ্গি] যেতে হয়। তখন তাদের হাত ছিল একেবারে শূন্য। আমীর হোসের কিছু টাকা জোগাড় করেছিলেন। তারা প্রচলিত পথে না গিয়ে বিকল্প পথ ধরেন। আমীর হোসেন তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘হাঁটতে হাঁটতে শেখ সাহেবের পা ফুলে গিয়েছিল। সবাই জিজ্ঞেস করে পায়ে কী হয়েছে। আমি বলি, গরু চালাচ্ছিল মইয়ে উঠে, মই উল্টে পায়ে ব্যথা পেয়েছে। হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি দেখাতে। আমার কী হয় জিগ্যেস করলে বলি, আমার ভাই হয়।’ অবশেষে ৩২৮ টাকা দিয়ে লঞ্চ ভাড়া করে তাঁরা নারায়ণগঞ্জ পৌঁছেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করে শেখ মুজিব শেষ রাতে গোপনে বাসায় পৌঁছান। ঘরের মধ্যে আলো দেখে পুলিশ জিজ্ঞেস করে তিনি কী করছেন। পুলিশকে জানানো হয় যে, সেহরির [তখন রমজান মাস শুরু হয়েছে] রান্নার আয়োজন চলছে, তাই বাতি জ্বালানো হয়েছে। বিষয়টি গোয়েন্দারা ধরতে পারেনি। এর কয়েক দিন পরে বঙ্গবন্ধুকে আবারো পুলিশ গ্রেপ্তার করে [আগরতলা যাওয়ার জন্য নয়]।
শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা গিয়ে কী পেয়েছিলেন? এমন প্রশ্ন হতেই পারে। দিল্লিতে বসবাসরত সাংবাদিক সত্যব্রত দত্ত [চল্লিশের দশকে সিলেটের কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক ছিলেন। পাক সরকারের অত্যাচারে পঞ্চাশের শেষ দিকে দিল্লি গিয়ে সাংবাদিকতা করেন] মনে করতেন যে, বঙ্গবন্ধুর বার্তাটি শচীন্দ্রলাল সিংহ হয়ে দিল্লিতে যায়। কিন্তু জওরলাল সরকার সম্ভবত সবদিক বিবেচনা করে বঙ্গবন্ধুর প্রথম পদক্ষেপে তেমন সাড়া দিতে চায়নি। কেবল পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা হয়েছিল। আবার তাদের পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে বিষয়টি জড়িত ছিল। তখনো পূর্ববঙ্গের মুক্তি আন্দোলন গগনচুম্বী হয়ে ওঠেনি, আইয়ুবী লৌহদণ্ড ছিল শক্ত অবস্থানে। পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে ভারতের ক্রমাবনতিশীল ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়েন চলছিল। আবার সীমান্তে ছিল নানা উত্তেজনা। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঝুঁকিও ছিল প্রচুর। ফলে ভারত কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি ছিল না। কার্যত সাদা চোখে দেখলে তাঁর মিশন তেমন সাফল্য লাভ না করলেও তার প্রভাব পড়েছিল সুদূরপ্রসারী। বঙ্গবন্ধু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আগরতলা যাওয়ার ফলে পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তানের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ইতিবাচক।
বিবিসি কলকাতা প্রতিনিধি অমিতাভ ভট্টশালীর ‘শেখ মুজিবুর রহমান কবে গিয়েছিলেন আগরতলায়?’ শিরোনামে ১৭ ডিসেম্বর ২০১৫ সালে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তারাও স্মরজিৎ চক্রবর্তীর ডায়েরির সূত্রে ১৯৬২ সালে বঙ্গবন্ধুর আগরতলা যাওয়ার তারিখের ওপর জোর দিয়েছেন। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রখ্যাত সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্য সাক্ষাৎ করলে তিনি আগরতলার জেল আগের মতো আছে কি না জিজ্ঞেস করেছিলেন। বিষয়টি পরিষ্কার হয় যে বঙ্গবন্ধু ১৯৬২ সালেই প্রথম তাঁর মিশন ও ভিশন নিয়ে আগরতলা গিয়েছিলেন। আগরতলার প্রবীণ সাংবাদিক মানস পাল, সাংবাদিক রাজু ভৌমিক [‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরা’ তথ্যচিত্র নির্মাতা], ফণীভূষণ পাল প্রমুখ বলার চেষ্টা করেন যে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৩ সালে আগরতলা গিয়েছিলেন। তা হলে প্রশ্ন ওঠে, বঙ্গবন্ধু কী দুইবার আগরতলা গিয়েছিলেন? অনেকের ধারণা দ্বিতীয়বারও তিনি শ্রীমঙ্গল হয়ে আগরতলা গিয়েছিলেন। তখন সীমান্ত পাড়ি দিতে সাহায্য করেন বাগান ব্যবস্থাপক সিলেটের কায়েস চৌধুরী। তখন তিনি ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহের তত্ত্বাবধানে তার বোনের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। শচীন্দ্রলাল ১৯৯১ সালে গবেষক মফিদুল হকের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় লিখিত বিবৃতির মাধ্যমে বলেন যে, বঙ্গবন্ধু ১৯৬৩ সালে তার সঙ্গে গিয়ে দেখা করেন এবং কয়েক দিন তিনি তার বোনের বাড়িতে গোপনে অবস্থান করেছিলেন। [দ্রষ্টব্য: songramernotebook.com–এর ত্রিপুরা মিশন]। শচীন্দ্রলাল সিংহ বঙ্গবন্ধুর বার্তা সশরীরে নেহেরুর কাছে পৌঁছান। কিন্তু চীন-ভারত যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো ঝুঁকি না নিয়ে তারা বঙ্গবন্ধুকে ধীরে চলার নীতিতে ধৈর্য ধরতে বলেন। শচীন্দ্রলাল সিংহ ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সাহায্য করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের আগে কিছু তরুণ ত্রিপুরা গিয়ে গোপনে যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছিল।
বোঝা যাচ্ছে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৯৬২ সাল থেকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন পরে পাক গোয়েন্দারা আঁচ করতে পেরেছিল যে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আগরতলার ‘নিবিড়’ যোগাযোগ রয়েছে। তারা আরো দেখেছিল সামরিক বাহিনীর বাঙালি অফিসারদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পূর্ববঙ্গের ৬ দফা আন্দোলন গণ-আন্দোলনের দিকে মোড় নিলে পাক সরকার ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামি করে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দেয়। যার নাম হয় ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ [মূল নাম: রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য]। এই মামলার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসির চিন্তা করেছিল। তখনো শচীন্দ্রলাল সিংহ আইনি মামলা লড়াইয়ের জন্য ব্যারিস্টার পাঠানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুর আগরতলা যাওয়ার কোনো তথ্যপ্রমাণ হাজির করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর আগরতলা যাত্রা নিয়ে অনেক জল ঘোলা হলেও এই বিষয়ে আমাদের অনুসন্ধান যৎসামান্য হয়েছে। এখন ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গবেষণা হলে বঙ্গবন্ধুর জীবনে আরেক নতুন অধ্যায় উন্মোচিত হতে পারে আর আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্বের অজানা জগৎ নতুন করে আবিষ্কারের সম্ভাবনা রয়েছে।
দীপংকর মোহান্ত, লেখক ও গবেষক
- খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ