ডা. সাকলাইন রাসেল
আপডেট: ১৯:১০, ৭ মে ২০২১
হেরে গেছেন চিকিৎসক-পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট, জিতেছে ক্ষমতা
ডা. সাকলাইন রাসেল
বহু বছর আগে সায়েন্স ল্যাব মোড়ে একটা গাড়ির বিজ্ঞাপন চোখে পড়েছিল। বিশাল বিলবোর্ডে গাড়ীর ছবির নিচে লেখা 'পাওয়ার ইজ নাথিং উইদাউট কন্ট্রোল'। সেই নাথিং পাওয়ার আমার চোখে পড়েছে।
পক্ষ তো চারটা। ডাক্তার, পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট ও সাংবাদিক। কিন্তু আমার নজরে যেটা বেশি এসেছে সেটা ক্ষমতা। বহু বছর আগে সায়েন্স ল্যাব মোড়ে একটা গাড়ির বিজ্ঞাপন চোখে পড়েছিল। বিশাল বিলবোর্ডে গাড়ীর ছবির নিচে লেখা 'পাওয়ার ইজ নাথিং উইদাউট কন্ট্রোল'। সেই নাথিং পাওয়ার আমার চোখে পড়েছে।
ঘটনাস্থল অ্যালিফ্যান্ট রোড। যদিও রোডটির পরিবর্তিত নাম ড. কুদরত-ই-খুদা সড়ক। বহু বছর আগে রোডটির নাম পরিবর্তন করা হলেও ভোলানো যায়নি অ্যালিফ্যান্ট রোড নামটি। ম্যাজিস্ট্রেট সরকার ঘোষিত কঠোর লকডাউন বাস্তবায়নে তাঁর দায়িত্ব পালন করছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুলিশ সহায়তা দিচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক পদমর্যাদার একজন নারী চিকিৎসক ডিউটি শেষে সে পথেই যাচ্ছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সম্মিলিত ভাবে তাঁর আইডি কার্ড চাইলে ঘটনার সূত্রপাত হয়। ঘটনার পর সাংবাদিক পুলিশ চিকিৎসকদের ব্যাক্তিগত বিশ্লেষণ আমার চোখে পড়েছে। প্রত্যেকেই নিজের মতো করে ব্যখ্যা করছেন। কোন পক্ষ অবলম্বন আমার মোটিভ নয়। কিন্তু ঘটনার প্রেক্ষিতে আমার বিশ্লেষণ শেয়ার না করলে নিজ বিবেকের কাছে অপরাধী থাকব। আমি পেশায় চিকিৎসক। শখের বসে সাংবাদিকও। লেখায় কিছুটা বায়াসনেস আসতে পারে। তবে আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করব আমার অবস্থান সাধারণ মানুষের কাতারে।
সব পক্ষই জানতো ভিডিও হচ্ছে। এই জানাটা তাদের বডি ল্যাংগুয়েজ, আচরণের উপর প্রভাব ফেলেছে। পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেটকে কিছুটা নমনীয় করেছে। কারণ তারা জানতেন এই মুহুর্তে তাদের আচরণ পরে বিশ্লেষিত হবে। আর চড়াও হতে সাহায্য করেছে চিকিৎসককে। কারণ তিনি জানেন স্বজাতির কাছে এই প্রতিবাদ অনেকবেশি বাহবা কুড়াবে।
প্রথমেই জানতে চাই, আইডি কার্ড দেখতে চাওয়া কি পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেটের অপরাধ? নাকি এটা তার ডিউটির মধ্যে পড়ে? সরকারি আদেশে তো বলাই আছে, চিকিৎসকদের মুভমেন্ট পাশ লাগবেনা। আইডি কার্ড হলেই হবে। তাই আইডি কার্ড দেখতে চাওয়া কি অন্যায় কিছু?
লকডাউনে আইডি কার্ড দেখতে চাওয়া নিয়ে আলোচিত সেই ঘটনার ফাইল ছবি।
আপনি নিজেকে চিকিৎসক বলে পরিচয় দিয়েছেন। ওনারা এতে খুশী নন। আপনি যে নিশ্চিত চিকিৎসক তার স্বপক্ষে প্রমান হল আপনার আইডি কার্ড। ওনারা সেটা দেখতে চেয়েছেন। আপনি সেটা সাথে রাখেননি। সাথে রাখাটা আপনার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কারণ আপনার আইডি কার্ডই আপনার মুভমেন্ট পাস। সে মুভমেন্ট পাস তো আপনার সাথে রাখতেই হবে। আপনি রাখেন নি। যেহেতু রাখেননি সেহেতু আপনাকে বিনয়ী হতে হবে।
'সরি, আমিতো ভুলে আজ আইডি কার্ড আনিনি' অন্তত এতোটুকু বলতে পারতেন। বল তখন ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশের কোর্টে পড়ত। নিশ্চয়ই তাঁরা সৌজন্যতা দেখাতেন এবং এটাই কাম্য। না দেখালে বিষয়টা তাদের বিপক্ষে যেতো। আমরা আদৌ জানিনা এমন কিছু হয়েছিল কিনা।
প্রশ্ন আরো আছে। গাড়ীতে হাসপাতালের মুভমেন্ট পাস সম্বলিত স্টিকার, গায়ে চিকিৎসকের পোশাক এবং একজন নারী। গাড়ির আরোহী যে আপাতত দৃষ্টিতে একজন চিকিৎসক তা বোঝার জন্য এতোটুকুই যথেষ্ট। তবুও কেন পরিচয় পত্র দেখতে চাওয়া?
এটার সম্ভাব্য ব্যখ্যাও জেনেছি। অনেক সময় অ্যাম্বুলেন্সে করে সাধারণ যাত্রী পরিবহন করা হয়। তাই গাড়ির ভিতরে অবৈধ কেউ আছেন কিনা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। অথবা সাদা অ্যাপ্রোন তো শুধু ডাক্তার না অনেকেই পরেন। তাই নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন এ্যাপ্রোন পরিহিত ব্যাক্তি চিকিৎসক কিনা।
পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেটের পক্ষ থেকে এসব ব্যখ্যা আসতে পারে। আসতে পারে পুলিশকে দায়িত্ব পালনে অসহযোগিতার অভিযোগ।
গাড়িতে হাসপাতালের স্টিকার, ভিতরে চিকিৎসকের পোশাকে নারী। কাছে আসা মাত্র ইশারায় গাড়িকে চলে যেতে বলতে পারতেন পুলিশ। ইগনোর করতে পারতেন আইডি কার্ডের বিষয়টি। বাস্তবে তাই হচ্ছে।
আবার বিষয়টা অন্য রকমও হতে পারত। গাড়িতে হাসপাতালের স্টিকার, ভিতরে চিকিৎসকের পোশাকে নারী। কাছে আসা মাত্র ইশারায় গাড়িকে চলে যেতে বলতে পারতেন পুলিশ। ইগনোর করতে পারতেন আইডি কার্ডের বিষয়টি। বাস্তবে তাই হচ্ছে। আমার গাড়িতেও হাসপাতালের অনুমোদিত স্টিকার আছে। চেকপোস্টের আশেপাশে আসলে মাঝেমধ্যে ইশারা করা হয় থামানোর জন্যে। কাছে আসতেই কিছু জিজ্ঞেস না করে ইশারা করেন চলে যেতে। আলোচ্য ঘটনাটা ঠিক এমন হলে বিষয়টা এতোদূর পর্যন্ত গড়াতো না।
ফলাফল এখানে ক্ষমতা জিতেছে। চিকিৎসক পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট হেরে গেছেন।
সরকারঘোষিত স্কেল অনুযায়ী এখানে পদমর্যাদায় সবার উপরে চিকিৎসক। কিন্তু দায়িত্বের বিচারে সবচেয়ে ক্ষমতাবান সেই মুহুর্তে পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি যদি পুলিশের সর্বনিম্ন পদমর্যাদারও হন তবুও সেই মুহুর্তে তিনিই ক্ষমতাবান। কারণ এই চেকপোস্টে যেকোন ব্যাক্তিকে চেক করার ক্ষমতা ও অধিকার তার আছে। আপনি চাইলেই বলতে পারবেন না, আমি আপনার চেয়ে অনেক বড় পদ মর্যাদার। আপনি আমাকে চেক করতে পারেন না। অথবা আমাকে সন্দেহ করতে পারেন না।
পেশাগত কারণে আমি নিজেও এমন চেকিং এর শিকার হয়েছি। পুলিশ আমার পরিচয় জানার পর বলেছে, সরি স্যার, আমি চিনতে পারিনি। উত্তরে বলেছি, এটা আপনার দায়িত্ব। আপনি চেক করতেই পারেন। এতে সরি হওয়ার কিছু নাই। আবারো প্রশ্ন, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ বারবার কেন আইডি কার্ড দেখতে চাচ্ছিলেন?
ঐ যে বলেছি ক্ষমতা। এই ক্ষমতাবলে তিনি মুভমেন্ট পাস চেয়েছেন। পরে চিকিৎসক বুঝতে পেরে আইডি কার্ড চেয়েছেন। তিনি বারবার বলছিলেন তিনি ডাক্তার, তিনি সহযোগী অধ্যাপক, তাঁর গাড়ীতে হাসপাতাল অথোরিটির দেয়া স্টিকার আছে। এমনকি এপ্রোনটি যে একজন ডাক্তারের সেটার প্রমান হিসেবে আঙ্গুল দিয়ে এপ্রোনের লোগো দেখিয়েছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। হাতে ক্ষমতা আছে। এই ক্ষমতাই ঘটনাকে এতোদূর নিয়ে এসেছে।
পুলিশের পোশাক দেখলেই বোঝা যায় তিনি পুলিশ, আইনজীবীর পোশাক দেখলে আইনজীবী, আর্মির পোশাক দেখলেই আর্মি। কিন্তু এপ্রোন দেখলেই বোঝা যায় না তিনি ডাক্তার। চিকিৎসকের পোশাকী পরিচয়ও ছিনতাই হয়েছে অনেক আগে। স্কুল কলেজ থেকে শুরু করে পোশাকশিল্প মোটামুটি সব জায়গায় সাদা এপ্রোনের পেশাজীবি দেখা যায়।
সমস্যা আরো আছে। পুলিশের পোশাক দেখলেই বোঝা যায় তিনি পুলিশ, আইনজীবীর পোশাক দেখলে আইনজীবী, আর্মির পোশাক দেখলেই আর্মি। কিন্তু এপ্রোন দেখলেই বোঝা যায় না তিনি ডাক্তার। চিকিৎসকের পোশাকী পরিচয়ও ছিনতাই হয়েছে অনেক আগে। স্কুল কলেজ থেকে শুরু করে পোশাকশিল্প মোটামুটি সব জায়গায় সাদা এপ্রোনের পেশাজীবি দেখা যায়।
শুরুটা হয়েছিল নিশ্চয়ই এপ্রোচ থেকে। আইনের চোখে সবাই সমান। কিন্তু এসব চেকপোস্টে মাঝেমধ্যে এমনভাবে এপ্রোচ করা হয় যেন সবাই চোর। হতে পারে নারী চিকিৎসকের প্রতি শুরতে তাদের এপ্রোচ ভালো ছিল না। যার কারণে তিনি ক্ষিপ্ত হয়েছেন। আবার এমনও হতে পারে পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেটের প্রতি নারী চিকিৎসকের এপ্রোচ ভাল ছিল না। যার কারণে তারা আইডি কার্ড চাওয়ার নামে নারী চিকিৎসকের ভাষায় অহেতুক হয়রানি করেছেন।
এবার আসি অন্য প্রসঙ্গে। যদি মনে করেন আলোচ্য চিকিৎসক শুরু থেকেই মারমুখী ছিলেন তবে আপনাকে যেতে হবে ঘটনার শুরুতে। সমস্যা হলো ভিডিওতে তো ঘটনার প্রথম অংশ নাই। কেন নাই সে ব্যখ্যায় পরে যাচ্ছি। ঘটনার শুরুতে গেলে আপনি যেটা পাবেন সেটাইতো এপ্রোচ। পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটের এপ্রোচ। কিন্তু আপনি যদি ঘটনার শুরু এখানেই মনে করেন তবে ভুল করবেন। ঘটনার শুরু আরো আগে।
করোনার শুরু থেকেই চিকিৎসকরা নানাভাবে নাজেহাল হয়েছেন। হাসপাতালে সিট নাই, দোষ চিকিৎসকের। ঔষধপত্র নাই, দোষ চিকিৎসকের। আইসিইউ নাই, দোষ চিকিৎসককের। এ নাই, ও নাই দোষ চিকিৎসকের। সাংবাদিকদের কলম কিংবা নেতানেত্রীদের বক্তব্য। সবজায়গাতেই অভিযোগের তীর চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে। অথচ চিকিৎসক চিকিৎসার অনেকগুলো উপাদানের মাঝে একটা উপাদান মাত্র। ফ্রন্টলাইনার হিসেবে সবচেয়ে বেশি জীবন দিয়েছেন চিকিৎসকরাই। কারণ পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন বেশিরভাগ চিকিৎসকরাই। আক্রান্ত হয়েছেন তাঁদের পরিবার। বাকি পেশার লোকজন আক্রান্ত হয়েছেন মূলত কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আক্রান্তের হার তাদের মধ্যে কম। বিনিময়ে সরকারঘোষিত প্রণোদনা বা সুযোগ সুবিধা তো পাননি, পাননি প্রাপ্য অধিকারটুকুও।
এখানে সাংবাদিকপক্ষ নির্দোষ। তিনি ঘটনার দৃশ্য ধারণ করেছেন মাত্র। তবুও চিকিৎসকদের ক্ষোভের দ্বিতীয় কারণ ঐ সাংবাদিকরাই। এর পিছনের কারণ কি?
জরুরি দায়িত্বে নিয়োজিত সব পেশার লোকেরাই এখন নিজেকে ফ্রন্টলাইনার দাবি করছেন। অথচ খোদ চিকিৎসদের সবাই ফ্রন্টলাইনার না। আমি নিজে একজন ভাসকুলার সার্জন। হাসপাতাল থেকেই ইনফেক্টেড হয়েছিলাম। প্রতিদিনই চেম্বার করি, অপারেশন করি। কোভিড পজিটিভ রোগীদের মাঝেমধ্যে চিকিৎসা সেবা দেই। চেম্বারেও প্রতিদিন কোন না কোন রোগী পজিটিভ থাকেন। রোগীর দ্বারা আবারো ইনফেক্টেড হওয়ার সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকি আমি। তবুও আমি নিজেকে প্রকৃত ফ্রন্টলাইনার ভাবিনা। আমি যদি নিজেকে ফ্রন্টলাইনার ভাবি তবে যারা আইসিইউতে বা ওয়ার্ডে সরাসরি কোভিড রোগীকে সেবা দিচ্ছেন তার সাথে আমার কোন পার্থক্য থাকেনা। প্রকৃত ফ্রন্টলাইনার তো ওনারাই। চিকিৎসক হওয়ার পরও আমাদের অবস্থান দ্বিতীয় সারিতে। অথচ এই ফ্রন্টলাইনার সম্বোধনটুকুও ছিনতাই করা হচ্ছে। গত বছর আমরা দেখেছি চিকিৎসকদের পিপিই তথাকথিত ফ্রন্টলাইনাররা কিভাবে দখল করেছেন। চিকিৎসক বা প্রকৃত ফ্রন্টলাইনার না হয়েও পিপিই পরে অফিস করেছেন। ধরলাম সবাই ফ্রন্টলাইনার, কিন্তু করোনা রোগীরা সরাসরি চিকিৎসায় নিয়োজিত ব্যাক্তিরা যেমন চিকিৎসক, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট কিংবা অন্যান্য স্টাফ তাদের ঝুঁকি আর অন্যান্যদের ঝুঁকি কি এক? বাস্তব অর্থে সবাই ফ্রন্টলাইনার হোক আর নাই হোক দেশটাকে সচল রাখতে, করোনার বিরুদ্ধে জিততে সকলের ভূমিকা সমগুরুত্বপূর্ণ।
করোনাযুদ্ধে জীবন দানকারী চিকিৎসকের সংখ্যা প্রায় ২০০ এর কাছাকাছি। আমরা জানি কতটা ঝুঁকি নিয়ে সীমিত সম্পদ কাজে লাগিয়ে মানুষের সেবা দিচ্ছিন চিকিৎসকরা। তারপরেও সামান্য একটু অসংগতি হলেই সমস্ত অভিযোগের তীর চিকিৎসকদের দিকে। বেশিরভাগ সময় চিকিৎসকদের হাজারো অর্জন নজর কাড়েনা সাংবাদিকদের। কিন্তু সামান্য পান থেকে চুন খসলেই 'তুই খারাপ'।
এসব ঘটনায় বহুদিন থেকে ক্ষোভ জমে আছে চিকিৎসকদের মনে। আলোচ্য চিকিৎসকও সেই চিকিৎসকদের একজন। দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন তিনি। ডাক্তার হয়রানি বন্ধ করতে হবে, হবে, হবে। এ উক্তিটা বহু ঘটনার হঠাৎ প্রকাশ। হাজারো চিকিৎসকের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি প্রতিবাদের মাধ্যমে।
সরকারের প্রজ্ঞাপনে স্পষ্ট বলা আছে চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত ব্যাক্তিগণ লকডাউনের আওতামুক্ত। তারা স্বাধীনভাবে নিজ কর্মস্থলে যেতে পারেন।
কিন্তু আমরা কি দেখেছি? বহু চিকিৎসক এই মুভমেন্ট পাশের অভাবে নাজেহাল হয়েছেন, হচ্ছেন। জরিমানাও গুনেছেন একাধিক চিকিৎসক। বিনিময়ে দুঃখিত বলা তো দূরের কথা, উল্টো নানা অপব্যখ্যার কুটকৌশল দেখেছি আমরা। বলা হচ্ছে, আমরা চেক করে দেখছি ওনারা সরাসরি কোভিড চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক কিনা। কি হাস্যকর যুক্তি। হাসপাতালে কি শুধু কোভিডের চিকিৎসা হয়? বাকী রোগ কি বসে আছে লকডাউন দেখে? আরো বলা হচ্ছে, হাসপাতালে তো রোস্টার করা আছে। আমরা দেখছি, রোস্টার অনুযায়ী ঐ চিকিৎসক পথে বেরিয়েছেন কিনা!
কি বিচিত্র! আমার তো মনে হয় না কোন ডিউটি না থাকা সত্বেও কোন চিকিৎসক শুধুমাত্র লক ডাউন দেখতে বের হবেন।
চিকিৎসককে বহনকারী রিকশাও থামিয়ে উল্টে দেয়া হচ্ছে। আমার চেম্বার সহকারীর আইডি কার্ড দেখার পরও রিকশা থেকে নামিয়ে দেয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল হাসপাতালের গাড়ী আছে সেটাতে যাবেন। নইলে হেটে যাবেন। এদের কে বোঝাবে সব চিকিৎসকের গাড়ী কেনার সামর্থ নাই। সব হাসপাতাল গাড়ী দেয় না। গাড়ী দিলেও নিদিষ্ট সময়ে দেয়। লকডাউনে চিকিৎসক কিংবা স্বাস্থ্যকর্মী হয়রানির এসব খবর কারো অজানা নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বহু অভিযোগ ভেসে বেড়াচ্ছে।
অথচ ঘটনা হওয়া উচিত ছিল একেবারে ভিন্ন। ফ্রন্টলাইনার চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীদের চলাচল সর্বোচ্চ নির্বিঘ্ন করার দায়িত্ব ছিল প্রশাসনের। বাড়তি সম্মান নয়, চিকিৎসকদের চাওয়া ছিল অস্মমানিত না হওয়া। খুবই সামান্য চাওয়া এটা।
এসব ঘটনায় বহুদিন থেকে ক্ষোভ জমে আছে চিকিৎসকদের মনে। আলোচ্য চিকিৎসকও সেই চিকিৎসকদের একজন। দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন তিনি। ডাক্তার হয়রানি বন্ধ করতে হবে, হবে, হবে। এ উক্তিটা বহু ঘটনার হঠাৎ প্রকাশ। হাজারো চিকিৎসকের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি প্রতিবাদের মাধ্যমে।
তাই আপনি যদি মনে করেন সামান্য ঘটনায় অনেক বেশি প্রতিবাদ করেছেন তিনি তবে আবারো ভুল করবেন। বরং এই প্রতিবাদ সকল চিকিৎসকের মনে জমে আছে আগ্নেয়গিরির মতো। মৃত হাজারো আগ্নেয়গিরির ভিড়ে একমাত্র লাভা উদগীরণকারী আগ্নেয়গিরি তিনি।
প্রশ্ন আরো আছে।
এখানে কি সাধারণ কোন চিকিৎসক প্রতিবাদ করেছেন? উত্তর, না। এখানে সাধারণ কোন চিকিৎসক প্রতিবাদ করেননি। সাধারণ চিকিৎসকের সে ক্ষমতা নেই। সে মান সম্মানের ভয় পায়। চাকরির ভয় পায়। বদলীর ভয় পায়। আইনের ভয় পায়। জীবন হারানোর ভয় পায়। আলোচ্য ঘটনা একজন সাধারণ চিকিৎসকের সাথে হলে তিনি দুঃখিত হতেন। ক্ষমা চাইতেন। অথবা অপদস্ত হয়ে ঘরে ফিরতেন। পর্দার আড়ালেই থেকে যেতো সে খবর।
এখানে তাই কোন চিকিৎসক প্রতিবাদ করেননি। প্রতিবাদ করেছেন একজন মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে, একজন বীর বিক্রমের মেয়ে। একজন রাষ্ট্রের ক্ষমতাধর ব্যাক্তির আত্মীয়। আর আমরা সাধারণ চিকিৎসকরা ভাগ্যবান যে তাঁর আরেকটি পরিচয় তিনি একজন চিকিৎসক। ক্ষমতার আবরণ তাকে প্রতিবাদ করতে সাহস যুগিয়েছে। স্বরের স্কেল সর্বদা উপরে রাখতে সহায়তা করেছে। তার পরিচয় কেবলমাত্র সাদা এপ্রোনের একজন সাধারণ চিকিৎসক হলে ঘটনার দিন হয়ত তাঁকে থানাতেই ইফতার করতে হতো। গুনতে হতো জেল জরিমানা। সাধারণ চিকিৎসকরা মেনে নেয়। ওরা মেনে নিতে শিখে।
চিকিৎসকদের অভিযোগ সাংবাদিক শুধু চিকিৎসকের রেগে যাওয়ার অংশ ভিডিও ধারণ করেছেন। শুরুতে তাকে নাজেহাল করে রাগিয়ে দেয়া হয়েছে কিনা সে ভিডিও ধারণ করেন নাই। এটার উত্তর খুব সহজ।
এখানে সাংবাদিকপক্ষ নির্দোষ। তিনি ঘটনার দৃশ্য ধারণ করেছেন মাত্র। তবুও চিকিৎসকদের ক্ষোভের দ্বিতীয় কারণ ঐ সাংবাদিকরাই। এর পিছনের কারণ কি?
চিকিৎসকদের অভিযোগ সাংবাদিক শুধু চিকিৎসকের রেগে যাওয়ার অংশ ভিডিও ধারণ করেছেন। শুরুতে তাকে নাজেহাল করে রাগিয়ে দেয়া হয়েছে কিনা সে ভিডিও ধারণ করেন নাই। এটার উত্তর খুব সহজ।
এটাতো পূর্ব পরিকল্পিত কোন ঘটনা না যে আগে থেকেই লাইট ক্যামেরা রেডি থাকবে। ঘটনার সুত্রপাত হতে সময় লেগেছে। বিস্ফোরণটা সাংবাদিকের নজরে এসেছে। তিনি সে অংশটুকুই ধারণ করতে পেরেছেন। আমি ব্যাক্তিগত ভাবে উক্ত পত্রিকার একজন সাংবাদিকের সাথে যোগাযোগ করি। তিনিও আমাকে এমনটাই জানিয়েছেন। চিকিৎসকদের মূল অভিযোগ ঘটনা পরবর্তী প্রকাশিত নানা সংবাদের কারণে। তাদের অভিযোগ সংবাদমাধ্যম নারী চিকিৎসককে ভিলেইন বানিয়ে খন্ডিত সংবাদ প্রকাশ করেছেন।
যদিও সাংবাদিকদের এটা অন্যতম দূর্ভাগ্য যে কোন একটা খবর কারো পক্ষে না গেলে তারা সে পক্ষের রোষানলে পড়েন।
গায়ে লোগো সম্বলিত সাদা এপ্রোন, গাড়ীতে হাসপাতালের অথোরিটির মুভমেন্ট পাস সম্বলিত স্টিকার কিংবা চিকিৎসকের নিজের মুখে দেয়া পরিচয়ের পরও আইডি কার্ডে ইস্যুকে থামিয়ে রাখার বিষয়টি কোন সংবাদমাধ্যমের ট্রিটমেন্ট পায়নি। চিকিৎসকের দুর্ব্যবহারের বিষয়টি প্রাধান্য পেলেও খবরে আসেনি নানা অভিযোগে গ্রেফতার পাপিয়ার সাথে একজন সম্মানিত চিকিৎসককে তুলনা করার বিষয়টি। ভুয়া স্টিকার বলার বিষয়টিও। একজন পুলিশ সদস্য মেজাজ ধরে রাখতে না পেরে স্পষ্ট বলেছেন এসব পাপিয়া টাপিয়া কত দেখছি। চিকিৎসকরা মনে করছেন মূল খবর প্রচার না করে নিদিষ্ট একটা পক্ষাবলম্বন করেছেন সাংবাদিকরা। যদিও সাংবাদিকদের এটা অন্যতম দূর্ভাগ্য যে কোন একটা খবর কারো পক্ষে না গেলে তারা সে পক্ষের রোষানলে পড়েন।
ঘটনাকে কিভাবে দেখছেন অনলাইনে ব্যস্ত পুলিশেরা। আমার পরিচিত একজন পুলিশ অফিসার সরাসরি না বলেলেও লিখেছেন, ডাক্তার হলেও মানুষ হতে পারেননি।
দীর্ঘদিন ধরে তারা নিজেদের বঞ্চিত মনে করেছেন। দূর্বল ভাবছেন। প্রতিবাদ করতে না পারার মনোবেদনায় ভুগছেন। ঘটনায় তারা প্রতিবাদ দেখেছেন। নিজেকে উক্ত নারী চিকিৎসকের স্থানে ভেবেছেন।
প্রায় কাছাকাছি স্ট্যাটাস প্রকাশ করেছেন অন্যান্য পুলিশ বন্ধুরাও। তবে চিকিৎসক গ্রুপগুলোতে প্রশংসায় ভাসছেন আলোচ্য চিকিৎসক।
দুই একজন তাঁর ভাষা বা ব্যবহার নিয়ে কথা তুললেও বেশিভাগই বাহবা দিচ্ছেন ওনাকে। এটার সম্ভাব্য ব্যখ্যা খুব সহজ। দীর্ঘদিন ধরে তারা নিজেদের বঞ্চিত মনে করেছেন। দূর্বল ভাবছেন। প্রতিবাদ করতে না পারার মনোবেদনায় ভুগছেন। ঘটনায় তারা প্রতিবাদ দেখেছেন। নিজেকে উক্ত নারী চিকিৎসকের স্থানে ভেবেছেন। ন্যায় বা অন্যায় ভাষা তাদের বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদে তাদের চাওয়া প্রতিফলিত হয়েছে।
এবার আসি ভিডিও বিশ্লেষণে। ভিডিওতে কিছু চমকপ্রদ তথ্য আছে। ভিডিওটা একেবারে ক্যান্ডিড না। ঘটনা ঘটেই চলেছে আর অজান্তে সাংবাদিক রেকর্ড করেছে তেমনও না। সব পক্ষই জানতো ভিডিও হচ্ছে। এই জানাটা তাদের বডি ল্যাংগুয়েজ, আচরণের উপর প্রভাব ফেলেছে। পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেটকে কিছুটা নমনীয় করেছে। কারণ তারা জানতেন এই মুহুর্তে তাদের আচরণ পরে বিশ্লেষিত হবে। আর চড়াও হতে সাহায্য করেছে চিকিৎসককে। কারণ তিনি জানেন স্বজাতির কাছে এই প্রতিবাদ অনেকবেশি বাহবা কুড়াবে।
ফলাফল কি হল? শুরুতে যেমনটা বলেছি। এখানে সব পেশাই হেরে গেছে। জিতেছে শুধু ক্ষমতা। অথবা এই ক্ষমতাটাই হেরে গেছে। কারণ কন্ট্রোল না থাকলে পাওয়ার মূল্যহীন হয়ে পড়ে।
করোনার শুরু থেকে মাঠের সম্মুখসারিতে আছেন চিকিৎসক ও পুলিশ। সংখ্যার দিক থেকে পেশা হিসেবে চিকিৎসকরাই সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন। এরপরই আছেন পুলিশ। পুলিশ শুধু পুলিশিং করেছেন তা না। এই করোনায় ডেড বডি গোসল দেয়া থেকে শুরু করে দাফনের দায়িত্বও তারা নিয়েছেন। এসব নিয়ে আমি একটা ভিডিও
করোনার শুরু থেকে মাঠের সম্মুখসারিতে আছেন চিকিৎসক ও পুলিশ। সংখ্যার দিক থেকে পেশা হিসেবে চিকিৎসকরাই সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন। এরপরই আছেন পুলিশ। পুলিশ শুধু পুলিশিং করেছেন তা না। এই করোনায় ডেড বডি গোসল দেয়া থেকে শুরু করে দাফনের দায়িত্বও তারা নিয়েছেন। এসব নিয়ে আমি একটা ভিডিও করেছিলাম 'এমন পুলিশ দেখিনি আগে' শিরোনামে (লিংক-https://youtu.be/9JrIyu_hgt8)। পুলিশ ভাইদের কাছে ভিডিওটা বেশ বাহবা পেলেও কেউ কেউ আবার বিরূপ মন্তব্য করেছেন।
কিন্তু কেন যে আমরা মাথায় ঢুকিয়ে নেই আমি বড়, আমিই বড়। এই বড়ত্বের কাছে অন্য পেশা ছোট হয়ে যায়। দেখা দেয় পেশাগত দ্বন্দ্ব। এসব দ্বন্দ্ব পারস্পরিক সুন্দর সম্পর্কগুলোকে আহত করে।
সব পেশাই গুরুত্বপূর্ণ এবং সমমর্যাদার দাবিদার। কিন্তু কেন যে আমরা মাথায় ঢুকিয়ে নেই আমি বড়, আমিই বড়। এই বড়ত্বের কাছে অন্য পেশা ছোট হয়ে যায়। দেখা দেয় পেশাগত দ্বন্দ্ব। এসব দ্বন্দ্ব পারস্পরিক সুন্দর সম্পর্কগুলোকে আহত করে। আলোচ্য ঘটনা তেমনই কিছু। আমি মনে করি আমাদের সুন্দর সম্পর্কের মাঝে উক্ত ঘটনা কেবলই একটা বিচ্যুতি মাত্র। ক্ষমতার জায়গায় বিনয় যুক্ত হলে দৃশ্যটা অনেক বেশি সুন্দর হতো। সহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ অনেক সমস্যার সমাধান দিতে পারে।
ভাল মন্দ সব পেশাতেই আছে। লকডাউন কোন আইনি বিষয় না। এটা জনস্বাস্থ্য ইস্যু। আমাদের সমস্যাও লকডাউন বা চেকপোস্ট না। এই মুহুর্তে দেশের প্রধান সমস্যা কোভিড-১৯। সারাবিশ্বেরও প্রধান সমস্যা। সরকার ফ্রন্টলাইনারদের সবচেয়ে বেশি সম্মানিত করেছেন। সবার আগে তাদের সুরক্ষা ভ্যক্সিন নিশ্চিত করেছেন। করোনা যুদ্ধে জিততে হলে আমাদের একসাথে যুদ্ধে নামতে হবে। প্রতিপক্ষ যেখানে করোনা সেখানে সব পেশার মেলবন্ধন অত্যন্ত জরুরি।
আমরা নিশ্চয়ই সে পথে হাঁটব।
ডাক্তার সাকলাইন রাসেল, ভাসকুলার সার্জন ও ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট || ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হসপিটাল এন্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট।
- খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ