মাসুদ হাসান
আপডেট: ০০:১৮, ২৯ মে ২০২১
শিক্ষার্থীদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে
শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। মহামারি করোনা জাতির সেই মেরুদন্ডটাই ভেঙ্গে দিচ্ছে। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ছেলেমেয়েদের স্বাভাবিক জীবনযাপন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খুললে শিক্ষার মুল ধারা থেকে জাতিকে অনেক সম্ভাবনাময় ছেলেমেয়েদের হারিয়ে ফেলতে হবে। সরকারের রূপকল্প-২০৪১ ও ডেল্টাপ্ল্যান-২১০০ তো আজকের এই শিক্ষার্থীদের হাতেই বাস্তবায়িত হবে।
এ অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে জনমত তীব্র হচ্ছে। আইনিউজের জন্য বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করেছেন মাসুদ হাসান।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে স্কুলের অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়বে। বাড়বে বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম। কোভিড-১৯ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলায় বেকারত্ব ও দারিদ্র বেড়েছে। দরিদ্র অনেক শিশু কাজে নেমে পড়েছে।
ফিরে দেখা
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান থেকে প্রথম যে মরণঘাতী করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছিল, তিন মাসের মধ্যে তা আঘাত হানে বাংলাদেশে। দেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। এর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ দেশে করোনায় প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। তারও দু’দিন আগে ১৬ মার্চ সোমবার মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় পরদিন মঙ্গলবার ১৭ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। ১৫ দিনের জন্যে যে ছুটি সেদিন দেয়া হয়েছিল সেই ছুটি বাড়তে বাড়তে এ বছরের মে মাস পর্যন্ত তা গড়িয়েছে , যার ডেটলাইন ছিল ২৯ মে।
শুধু খোলা হয়নি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
গত ১৫ মাসে শিক্ষামন্ত্রী অনেকবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু খোলেনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে সর্বপর্যায়ে নানাধরণের বিধিনিষেধের প্রজ্ঞাপন হয়েছে। কঠোর বিধিনিষেধ হয়েছে, লকডাউন হয়েছে, কঠোর লকডাউন হয়েছে, শপিংমল বন্ধ হয়েছে, শপিংমল খুলেছে, বাস-ট্রেন বন্ধ হয়েছে, বাস-ট্রেন খুলেছে, অনুষ্ঠান বন্ধ হয়েছে, আবার অনেক বড় বড় অনুষ্ঠানও হয়েছে। হয়নি শুধু ক্লাস, হয়নি শুধু পরীক্ষা। সরকার ব্যবসায়ীদের কথা শুনেছেন, শিল্প ও কলকারখানার মালিকদের কথা শুনেছেন, পরিবহন শ্রমিকদের কথা শুনেছেন, মুদি দোকানদারদের কথাও শুনেছেন। কেবল শোনা হয়নি শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মনের কথা। তাদের কষ্ট ও আর্তনাদের বাণী যেন এখনও সরকার অবধি পৌঁছাতে পারেনি। তাই সবকিছু খুলেছে-বন্ধ হয়েছে, আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুধু বন্ধই হয়েছে, খুলেনি এখনও একবারও।
এলো নতুন ঘোষণা
সবাই ভেবে নিয়েছিল এবার বোধহয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে। কিন্তু ২৬ মে ভার্চুয়াল এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানালেন, ‘করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চলমান ছুটি আগামী ১২ জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। নতুন করে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি না হলে সেদিন থেকে শিক্ষার্থীদের সশরীরে উপস্থিতিতে পাঠদান কার্যক্রম শুরু করা হবে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে খুলে দেয়া নির্ভর করছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সবাইকে করোনা টিকার আওতায় নিয়ে আসার ওপর।’
শিক্ষামন্ত্রী আরও বললেন, ‘যদি ১৩ জুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হয় তবে ২০২১ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী ব্যাচকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। তাদের সপ্তাহের ছয়দিন ক্লাসে আসতে হবে। ২০২২ সালে যারা এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী তাদেরকেও হয়তো একই সময়ে ক্লাসে নিয়ে আসা হবে। অন্যান্য ক্লাসের ব্যাপারে হয়তো সপ্তাহে একদিন তাদের ক্লাসে নিয়ে আসা হবে।’
খুলে দেয়ার পরও বেশিরভাগ শিক্ষার্থী থাকবে সুযোগবঞ্চিত
শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পর সপ্তাহের ৬দিন ক্লাস করবে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা, আর কেবলমাত্র একদিন সুযোগ পাবে অন্যান্য ক্লাসের শিক্ষার্থীরা। সেক্ষেত্রে একদিনেই কি অন্যান্য ক্লাসের সকল শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে গাদাগাদি করে বসবে? স্বাস্থ্যবিধি না মেনে একে অপরের গা ঘেঁষে বসার সিদ্ধান্ত তো পরামর্শক কমিটি দেয়ার কথা নয়। আবার বলা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরুর বিষয়ে সকল শিক্ষার্থীকে টিকাকরণের পরে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। ক্লাস শুরুর সাথে টিকাকরণকে সম্পৃক্ত করে বিষয়টাকে আরও জটিল করা হচ্ছে না তো? সুযোগ দিতে গিয়ে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী সুযোগবঞ্চিত হবে নাতো?
বাস্তবতা যেখানে
গ্রাম বা মফস্বলের মানুষের মধ্যে করোনার ভয় নেই বললেই চলে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া ছাড়া সেখানে সব কাজই স্বাভাবিকভাবে চলছে। শিক্ষার্থীরা সেখানে ঘরে বসে নেই। তারা রাস্তাঘাটে ঘুরছে, মার্কেটে যাচ্ছে, দলবেধে আড্ডা দিচ্ছে অর্থাৎ লেখাপড়া ছাড়া অন্য সব কাজই করছে।
এরই মধ্যে বাতিল হয়েছে পিএসসি, জেএসসি, এইচএসসি এবং সব শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা। এই দীর্ঘ সময় অনলাইন ও সংসদ টিভিতে ক্লাস চললেও ডিভাইস ও নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কাছে সেই সেবা পৌঁছায়নি।
করোনাভাইরাসের এই সময়ে অনেক স্কুল বিক্রির বিজ্ঞাপন ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গেম খেলায় অতিরিক্ত সময় দিচ্ছে, এতে লোপ পাচ্ছে তাদের সৃজনশীলতা। ২১ মে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান থ্রনের একটি জরিপে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, পৃথিবীর ৪৫ শতাংশ শিশু এখন ফেসবুক ব্যবহার করছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পক্ষে মত
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার ব্যাপারে অনেকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সরগরম। এ সম্পর্কিত নানাধরণের মন্তব্য ও গান ইতোমধ্যে ভাইরাল হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও নেমেছে মানববন্ধন, প্রতিবাদসহ বিভিন্ন আন্দোলনে। শিক্ষার্থীদের দাবি, হাট-বাজার, শিল্প–কলকারখানা, গণপরিবহন সহ দেশের সবকিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে খোলা থাকলেও বন্ধ রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে করে শিক্ষার্থীরা পড়েছেন বিপাকে। পরীক্ষাসমূহ না হওয়ায় ভয়াবহ সেশনজটের আশংকা করছেন অনেক শিক্ষার্থী। তারা বলছে, এই অবস্থা একদিকে যেমন মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করছে শিক্ষার্থীদের অন্যদিকে একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকেও ঠেলে দিচ্ছে তাদের।
১০ মে প্রকাশিত পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি)-এর এক যৌথ গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, করোনার বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের ৯৭ শতাংশ অভিভাবক তাঁদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে চান। রিপোর্ট থেকে জানা যায়, শিক্ষার্থীদের অনেকেই রয়েছে মানসিক চাপে এবং শিক্ষার্থীদের শিখতে না পারার ঝুঁকি বেড়ে গেছে। শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ করতে হলে শিক্ষা পুনরুদ্ধার কর্মসূচি হাতে নেয়ার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়েছে রিপোর্টে।
শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাগুলোর মোর্চা গণসাক্ষরতা অভিযানের ১৯ জানুয়ারি প্রকাশিত ‘এডুকেশন ওয়াচ ২০২০-২১ সমীক্ষার অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন’–এ বলা হয়েছে, দেশের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষা কর্মকর্তারা স্কুল খুলে দেওয়ার পক্ষে। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী দ্রুত ক্লাসে ফিরতে চায়। আর ৭৬ শতাংশ অভিভাবক ও ৭৩ শতাংশ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা স্কুল খুলে দেওয়ার পক্ষে। তবে ৫৮ শতাংশ শিক্ষক ও ৫২ শতাংশ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সতর্কতার সঙ্গে স্কুল খুলে দেওয়ার পক্ষে বলেছেন। সমীক্ষায় দেখা গেছে, দূরশিক্ষণের (সংসদ টিভি, অনলাইন, রেডিও ও মোবাইল) মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল কম। ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশ গ্রহণ করে। বাকি ৬৯ দশমিক ৫ শতাংশ অংশ নেয়নি। সমীক্ষার তথ্য বলছে, ৬২ শতাংশের বেশি শিক্ষক মনে করেন, শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পাঠ্যসূচি সংক্ষিপ্ত করা দরকার।
চলমান অবস্থায় লংঘিত হতে পারে শিশু অধিকার
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে স্কুলের অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়বে। বাড়বে বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম। কোভিড-১৯ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলায় বেকারত্ব ও দারিদ্র বেড়েছে। দরিদ্র অনেক শিশু কাজে নেমে পড়েছে। অসহায় অভিভাবকরা স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া অনেক মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। লকডাউন থাকায় এসব অনেক ঘটনা অপ্রকাশিত থেকে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েরা পারিবারিক সহিংসতার শিকার হচ্ছে। লেখাপড়া নেই বলে পাড়ায় পাড়ায় কিশোর গ্যাং তৈরি হচ্ছে। কিশোর গ্যাংয়ের মাধ্যমে দেশে কয়েকটি খুনোখুনির ঘটনাও ঘটেছে। বিভিন্ন এলাকায় তাদের বিরুদ্ধে পুলিশকে তৎপর হতেও দেখা গেছে।
ছেলেমেয়েদের মধ্যে ঘটছে আচরণগত পরিবর্তন
দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ছেলেমেয়েদের স্বাভাবিক জীবনযাপন হচ্ছে বাধাগ্রস্ত। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সিল সেন্টারের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ইসরাত শারমিন রহমান বলেন, ‘হঠাৎ করে জীবনযাপনের পরিবর্তন শিশুদের উপর প্রভাব ফেলে। আমরা দেখি যে, অনেকের আচরণগত সমস্যা হচ্ছে, অনেকে প্রচণ্ড জেদ করছে, ইমোশনাল রিঅ্যাকশন হচ্ছে, কান্নাকাটি করছে কেউ কেউ, কেউ হয়তো জেদ করে কোন কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে, ইন্টারনেট ও মোবাইল ব্যবহার বাড়ছে’।
তিনি আরও বলেন, ‘একটু বড়রা পরিবারের অন্যদের সাথে দূরত্ব তৈরি করছে, আইসোলেটেড হয়ে আছে, তারা তাদের রুমেই বেশি সময় কাটাচ্ছে’। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এ ধরণের আচরণগত পরিবর্তন শিশুদেরকে মহামারি পরবর্তী জীবনেও তাদের খাপ-খাইয়ে নিতে অসুবিধার সৃষ্টি করবে’।
বিশ্ব পরিস্থিতি
২০২১ সালের মার্চে ইউনিসেফের তৈরি করা এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের মতো এত দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে বিশ্বের মাত্র ১৩টি দেশে, যেখানে দক্ষিণ এশিয়া থেকে আছে শুধু বাংলাদেশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনলাইনে পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। প্রকৃত অর্থে, উন্নত দেশগুলোর অনলাইন শিক্ষা বা পরীক্ষার সাথে আমাদের রয়েছে যোজন ফারাক। প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে তারা আমাদের চেয়ে অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে। অধিকন্তু অনলাইনের ফাঁকে ফাঁকে তাদের দেশগুলোতে শারীরিক উপস্থিতিতে ক্লাস হয়েছে, পরীক্ষা হয়েছে।
২৭ মে শিক্ষার্থীদের অনিশ্চয়তার কথা চিন্তা করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উচ্চ মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক পরীক্ষা জুলাই ও আগস্টে নেয়ার তারিখ ঘোষণা করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ‘নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এবারের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। বাড়ির কাছে নিজের স্কুলে পরীক্ষার আসন পড়লে যানবাহনে চড়ে যেতে হবে না ছাত্র-ছাত্রীদের। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি কমবে। আবশ্যিক বিষয়ের পরীক্ষা নেওয়া হবে আর ঐচ্ছিক বিষয়গুলোর ওপর নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা নেওয়া হবে। তিন ঘণ্টার পরিবর্তে দেড় ঘণ্টার পরীক্ষা নেয়া হবে।’ আমাদের দেশেও পরীক্ষা নেয়ার এই প্রক্রিয়াটির বিষয়ে চিন্তা করা যেতে পারে।
নেয়া যেতে পারে আরও উদ্যোগ
প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া এখন সময়ের দাবি। কিন্ত তা বললেই তো আর হলো না! সারাবিশ্ব এখন পার করছে এক কঠিন সময়। জীবনের মূল্যটা অন্য সবকিছুর চেয়ে অনেক বেশি বলে সকল পরিকল্পনায় সেই ভাবনাটাকেই প্রাধান্য দিতে হচ্ছে। তারপরও জীবন ও জীবিকার কথা ভেবে সবকিছুই যখন খুলে দেয়া হচ্ছে, তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া ছাড়া হয়তো গত্যান্তর থাকবে না। এক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকে বিবেচনায় রেখে নানাধরণের উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ এসেছে:
-
স্বাস্থ্যবিধি মেনে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হল ও হোস্টেল খুলে দেওয়া।
-
বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীদের জন্য ভ্যাকসিন নিশ্চিত করা।
-
সুষ্ঠু পাঠ-পরিকল্পনা গ্রহণ করা।
-
আটকে থাকা গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাগুলো সংক্ষিপ্ত সিলেবাস এবং সময় বাড়িয়ে নেওয়া। যে পরীক্ষা যে সিলেবাস অনুযায়ী হবে তার পরবর্তী ভর্তি পরীক্ষাগুলো সে সিলেবাস অনুযায়ী নেওয়া।
-
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যতদিন বন্ধ ছিলো সেই বেতনের কমপক্ষে অর্ধেক মওকুফ করে দেয়া। অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীদের বেতন সম্পূর্ণ মওকুফ করা।
-
কোন শিক্ষার্থী করোনায় আক্রান্ত হলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তদারকিতে আক্রান্ত শিক্ষার্থীর চিকিৎসা করানো এবং আক্রান্ত হওয়ার ফলে কোন পরীক্ষা দিতে শিক্ষার্থী ব্যর্থ হলে পরবর্তীতে তাকে সাপ্লিমেন্টারী পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া।
-
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে রিভিউ ক্লাস, এক্সট্রা ক্লাস, ওপেন ক্রেডিট, ব্যাকলগ পরীক্ষা ইত্যাদি সুবিধাসমূহ দিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষতিপূরণের সুযোগ প্রদান এবং এর জন্য অতিরিক্ত কোন ফি আদায় না করা।
-
অটোপ্রমোশন বা অটোপাশ নয় সেশনজট এড়াতে প্রয়োজনবোধে সেশনের সময়সীমা কমানো।
-
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে রোডম্যাপ তৈরী, বাস্তবায়ন ও মনিটরিং করা।
-
শিক্ষাখাতে অবকাঠামোগত উন্নয়নে ও সার্বিক কাজে বাজেট বৃদ্ধি করা।
-
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ম মেনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা।
-
আসনবিন্যাস পরিবর্তন করে এক বেঞ্চে সর্বোচ্চ দুজন করে বসানো।
-
পালা করে বিভিন্ন শ্রেণির ক্লাস নেওয়া।
-
ঝরে পড়া ঠেকাতে শিক্ষার্থীদের বিশেষ বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা।
-
শিক্ষা পুনরুদ্ধার কর্মসূচি হাতে নেয়া। ২০২১-২২ অর্থ বছরের বাজেটে এ বিষয়ে বিশেষ বরাদ্দ রাখা।
সরকারের ভাবনা
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টি নিশ্চিত করতে অন্তত ৬০টি নির্দেশনা প্রস্তুত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে একেকটি বেঞ্চে একজন করে শিক্ষার্থী বসবে। শিক্ষার্থীদের প্রবেশ ও বেরিয়ে যাওয়ার পথ আলাদা হবে। একজন ক্লাসে কতোজন শিক্ষার্থী বসবে সেটা নির্ভর করবে ক্লাসের আয়তনের ওপর। -মোহাম্মদ আবুল খায়ের, জন সংযোগ কর্মকর্তা, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয়
ইতোমধ্যে যেসব শিক্ষার্থীদের বয়স ৪০-এর কম তাদেরকে বিশেষ বিবেচনায় টিকা দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন। নতুন টিকা আসলেই তারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা পাবে। এক্ষেত্রে আবাসিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় টিভি, রেডিও ও অনলাইনে পাঠদান কার্যক্রম চালিয়ে আসছে সরকার। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেছেন, ‘কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এসব কাজ শেষ হলে করোনা পরিস্থিতি দেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে সরকার’।
শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি কোনো কোনো জেলায় বেশি। এসব মাথায় রেখে ছুটি বাড়ানো হয়েছে’। এক্ষেত্রে যেসব জেলায় করোনার সংক্রমণ বেশি শুধুমাত্র সেসব জেলায় প্রয়োজনবোধে আরও কিছুদিন স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা যেতে পারে। এতে দেশের সামগ্রিক ক্ষতি কিছুটা হলেও কমবে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন সংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল খায়ের জানান, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টি নিশ্চিত করতে অন্তত ৬০টি নির্দেশনা প্রস্তুত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে একেকটি বেঞ্চে একজন করে শিক্ষার্থী বসবে। শিক্ষার্থীদের প্রবেশ ও বেরিয়ে যাওয়ার পথ আলাদা হবে। একজন ক্লাসে কতোজন শিক্ষার্থী বসবে সেটা নির্ভর করবে ক্লাসের আয়তনের ওপর।
তিনি আরও জানান, উপস্থিত সব শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলক মাস্ক পড়তে হবে। মাস্ক সরবরাহ করা হবে স্কুল থেকেই। হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং সাবান পানিতে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়া স্কুলের শ্রেণীকক্ষ, টয়লেট, স্কুল প্রাঙ্গণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা, এগুলোর সঠিক সম্পর্কেও সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশনা দেয়া হবে। বেসরকারি স্কুল তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে যাবতীয় খরচ বহন করবে। অন্যদিকে সরকারি স্কুলগুলোর খরচ দেবে সরকার।
শেষকথা
শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। যে কোন পরিস্থিতিতে শিক্ষার কাঠামোকে মেরুদন্ডের মতো সোজা রাখতে না পারলে সেখানে বিপর্যয় নেমে আসতে বাধ্য। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর এখন তাই বোঝা যাচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে একটা বড় ধরনের ঐক্যমত তৈরি হয়েছে। কারণ দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খুলতে পারলে শিক্ষার মুল ধারা থেকে অনেক সম্ভাবনাময় ছেলেমেয়েদের হারিয়ে ফেলতে হবে আমাদের। সরকারের রূপকল্প-২০৪১ ও ডেল্টাপ্ল্যান-২১০০ তো আজকের এই শিক্ষার্থীদের হাতেই বাস্তবায়িত হবে। তাই মেধাভিত্তিক একটি সমাজ গঠনের লক্ষ্যে এবং শিক্ষার এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে দু-তিন বছরের জন্য কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়ে এখন থেকেই কাজ শুরু করতে হবে। এসব কাজের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত বিনিয়োগ। তাই এবার জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ২০ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা উচিত।
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ