মোহন রবিদাস
আপডেট: ২০:০২, ৯ আগস্ট ২০২১
করোনাকালে আদিবাসী চা শ্রমিকদের বঞ্চনার কথা
আজ (৯ আগস্ট) আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিনটি পালিত হচ্ছে। প্রতি বছরের মতো বিভিন্ন চা বাগানেও এই দিনটি যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। কেননা,পার্বত্য চট্টগ্রামের ১১ টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী বাদে সমতলের সকল আদিবাসী জনগোষ্ঠীরই বসবাস চা বাগানে। বিশ্বব্যাপী অতিমারি “কোভিড-১৯”-এর প্রভাবে এ বছরও এই দিনটি অনেকটা অনাড়ম্বরভাবেই পালিত হচ্ছে সবখানে।
চা বাগানে গারো, ত্রিপুরা, সাঁওতাল, মুণ্ডা, ওঁরাও, বাউরী, লোহার, রবিদাস, তেলেগু, ভূমিজ, কানু, বীণ, ছত্রী, শবর, বাক্তিসহ প্রায় ৯৪টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী বসবাস করে যাদের প্রতেক্যের ভাষা-সংস্কৃতি,আচার-পার্বণ ,ধর্মীয় রীতিনীতি, পূজা-উৎসব, বিবাহপ্রথা সমাজকাঠামো দেশের মূল ধারার জনগোষ্ঠী থেকে ভিন্ন। আমাদের কেউ প্রাক-দ্রাবিড়ীয়, কেউ আদিঅস্ট্রালয়েড কেউবা আমার মঙ্গোলীয় আদিবাসীর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় সরকার চা বাগানের প্রায় ৯০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে সরকারি গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করে নি। অন্যদিকে চা শ্রমিকদের ভাষা-সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও বিকাশেই কোন প্রকার সরকারি কিংবা বেসরকারি উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছেনা।
সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, এই অতিমারি 'কোভিড-১৯'-এর সময়ে চা শ্রমিকদেরকে নানাভাবে অন্যায়, শোষণ, নিপীড়ন ও চরম মাপের বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে। করোনা ভাইরাস থেকে চা শ্রমিকদের সুরক্ষিত রাখতে কোন সরকারি-বেসরকারি কিংবা চা বাগান কর্তৃপক্ষ কর্তৃক উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপ তো গ্রহণ করেই নি এমন কি নূন্যতম স্বাস্থ্যবিধির বিষয়টিও উপেক্ষিত হচ্ছে চা উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ এবং শ্রমিক পল্লীতে।
এ যেন এক দেশে দুই নীতি, যেখানে সারা দেশে কঠোর লকডাউন নিশ্চিত করা হয়েছে আর চা বাগানকে সম্পূর্ণরূপে লকডাউনের আওতামুক্ত রাখা হয়েছে। দিব্যি খোলা থাকছে হোটেল-রেস্তোরা, মদ-হাঁড়িয়া-গাঁজার দোকান, অনিয়ন্ত্রিতভাবে বসে সাপ্তাহিক গুনতি (বড় আকারের অস্থায়ী হাট যেখানে সাপ্তাহিক মজুরি পেয়ে চা শ্রমিকগণ বাজার-সদাই করেন), সেলুনগুলোতে সব সময়ে থাকে উপচে পড়া ভিড় (যেহেতু চা বাগানের বাইরের সেলুনগুলো বন্ধ থাকছে), চা কারখানাতো খোলা থাকছেই স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই ছাড়া। আর চা সেকশনে গাঁ ঘেঁসে (সামাজিক দূরত্ব ছাড়াই) কয়েক শ’ নারী শ্রমিকদের 'পাতিওজনের' (দিনে সাধারণত দুই বার চা পাতা ওজন দিতে একত্রিত হতে হয় শ্রমিকদের) বিষয়টা না ই বা বললাম।
অন্যদিকে এই সময়ে চা শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি যেখানে গুরুত্বসহকারে দেখার কথা ছিল সেখানে এখন পর্যন্ত কোন চা বাগানে আইসোলেশন সেন্টার তো দূরের কথা চলমান চিকিৎসাসেবা পেতে বেগ পেতে হচ্ছে শ্রমিকদের। চা বাগানের কথাকথিত ডিসপেনসারিগুলো আজ 'ময়লার ভাগাড়ে' (এ নিয়ে কয়েকদিন আগে আমার ফেইসবুক পেজে একটা ভিডিও তুলে ধরেছিলাম) রূপান্তরিত হচ্ছে দিন দিন।
এই সময়ে চা শিল্প বাদে দেশের প্রায় সকল শিল্প প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িকভাবে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আর চা কোম্পানিগুলো অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এই সময়ে কয়েকগুণ বেশি লাভবান হয়েছে (বিগত ২০ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেকগুণ বেশি চা উৎপাদিত হয়েছে এই কোভিড-১৯ সময়ে)।
তাই মানবিক দিক বিবেচনা করে হলেও চা শ্রমিকদের জন্য “ঝুঁকি ভাতা” বা বিশেষ “আর্থিক প্রণোদনা” দেয়া উচিত ছিল।
চা বাগান কর্তৃপক্ষ কিংবা সরকার (যেহেতু সরকার চা শিল্প থেকে মোটা অংকের ট্যাক্স পায়) থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে সাবান, স্যানিটাইজার, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য উপকরণ দেয়া তো দূরের কথা বেশিরভাগ চা বাগানে দেড় টাকা দামের একটা মাস্কও দেয়া হয় নাই শ্রমিকদের। এখন প্রশ্ন হলো জিনিসপত্রের চড়াদামের এই সময়ে চা শ্রমিকরা ১২০ টাকা মজুরি দিয়ে জীবন বাঁচাবে না 'করোনা ভাইরাসের সুরক্ষা সামগ্রী' কিনবে যে কারণে চা বাগানে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে দ্রুত গতিতে। আর মৃত্যুর হারও নেহাত কম নয়।
ঘনবসতিপূর্ণভাবে বসবাসরত সকল চা শ্রমিকদের জন্য অন্তত 'টিকা' প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করলেও চা শ্রমিকরা কিছুটা হলেও সুরক্ষিত থাকতো।
এই করোনাকালে চা শ্রমিকদের সাথে চা কোম্পানি ও সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণ দেখে একটা বিষয় পরিষ্কার 'চা বাগান হল একটি রাষ্ট্রের ভিতর আরেকটি রাষ্ট্র, আর চা শ্রমিকরা হলো দেশ ও পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন একটি ভিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা'।
এমতাবস্থায়, এই আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে আমাদের নিম্নলিখিত দাবিগুলোর কথা কার কাছে জানাবো তা নিয়েও সংশয়ে আছি আমরা (কেননা,যেখানে আমাদের ন্যূনতম সমস্যা-দাবির প্রতি কারো ভ্রূক্ষেপ নেই সেখানে মোটাদাগের দাবিগুলো পূরণ অধরাই থেকে যাবে সেটা আমরা হাঁড়ে হাঁড়েই টের পাচ্ছি) :
১) চা বাগানে বসবাসরত সকল জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী’র স্বীকৃতি দিতে হবে;
২) চা বাগানের ভাষা-সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য চা বাগান অধ্যুষিত প্রতিটি উপজেলায় একটি করে “কালচারাল ইন্সটিটিউট” প্রতিষ্ঠা করতে হবে;
৩) অবিলম্বে সকল চা শ্রমিকদের টিকা (কোভিড-১৯) প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে;
৪) করোনা আক্রান্ত শ্রমিকের ১৪ দিনের মজুরিসহ প্রয়োজনীয় সকল সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে;
৫) সকল চা শ্রমিকদের জন্য বিনামুল্যে মাস্ক,সাবান,স্যানিটাইজারসহ প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রী প্রদান করতে হবে;
৬) 'করোনাকালীন ঝুঁকি' ভাতার প্রচলন করতে হবে;
৭) নারী চা শ্রমিকদেরকে (নির্দিষ্ট বয়সের) বিনামূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন/প্যাড প্রদান করতে হবে (যেহেতু উনাদেরকে পিরিয়ডের সময়েও পাহাড়-টিলায় দাঁড়িয়ে সারাদিন কাজ করতে হয়);
৮) চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি কমপক্ষে ৫০০ টাকা ঘোষণা করতে হবে;
৯) জাতীয় বাজেটে চা শ্রমিকদের জন্য পৃথক বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে;
১০) চা শ্রমিকদের ভূমি অধিকার নিশ্চিত করতে হবে;
১১) ৩২,১১৫,১১৭ ধারাসহ শ্রম আইনের শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী সকল ধারা অবিলম্বে সংশোধন করতে হবে;
১২) উচ্চ শিক্ষা ও চাকুরিতে চা শ্রমিক সন্তানদের জন্য “কোটা” সুবিধা চালু করতে হবে;
১৩) প্রতিটি চা বাগানের হাসপাতালগুলোতে নামমাত্র চিকিৎসার পরিবর্তে উন্নতমানের চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে হবে;
১৪) চা বাগানের প্রতি সেকশনে পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থাসহ গণ-শৌচাগার ও বিশ্রামাগার থাকতে হবে;
১৫) পাতি ওজনের জন্য এনালগ মেশিনের পরিবর্তে ডিজিটাল মেশিন ব্যবহার করতে হবে;
১৬) প্রতিবছর ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাসের মধ্যে চা শ্রমিকদের ঘর-বাড়ির সম্পূর্ণ মেরামত অবশ্যই করতে এবং প্রতিবছর কমপক্ষে ২০ টি পাকা ঘর নির্মাণ করতে হবে;
১৭) শ্রমিকদের যাতায়াতের সেকশনগুলোতে) জন্য অভ্যন্তরীণ পরিবহন ব্যবস্থা চালু করতে হবে;
১৮) চা শ্রমিকদের জীবন-জীবিকার উৎস বন-জঙ্গল-পাহাড় ধ্বংস চা চাষ সম্প্রসারণ বন্ধ করতে হবে;
১৯) চা বাগানের চৌকিদারদের (দিন ও রাত উভয়কেই) সুরক্ষা সামগ্রী এবং চা শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় উপকরণ, যেমন: জুতা, স্যান্ডেল, ছুপি-ছাতা-দা-কোদাল ইত্যাদি যথাসময়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রদান করতে হবে;
২০) শ্রমিকদের ঘর নির্মাণের নামে নির্বিচারে চা সেকশনের গাছ কাটা ও বিক্রয়বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে;
২১) নামমাত্র রেশনের পরিবর্তে শ্রমিকের নিত্যপ্রয়োনীয় সকল খাদ্যদ্রব্য 'প্রাসঙ্গিক রেশন' হিসেবে প্রদান করতে হবে;
২২) কীটনাশক স্প্রেয়িং সেকশনে কর্মরত শ্রমিকদের উচ্চহারে ঝুঁকি ভাতা প্রদানসহ তাদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রী প্রদান করতে হবে;
২৩) স্থায়ী এবং অস্থায়ী উভয়কেই সমানহারে মজুরি ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা প্রদান করতে হবে;
২৪) যথাসময়ে প্রভিডেন্ড ফান্ডের সমুদয় টাকা প্রদানসহ এ সংশ্লিষ্ট সকল অনিয়ম দূর করতে হবে;
২৫) যেহেতু রাবার চাষ ও এর প্রক্রিয়াকরণ পরিবেশ এবং শ্রমিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তাই চা বাগানে রাবার চাষ বন্ধ করতে হবে;
২৬) চা বাগানের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে;
২৭) চা বাগানে সকল প্রকার মাদকদ্রব্য সেবন ও বিক্রয় বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস সফল হোক, সার্থক হোক।
মোহন রবিদাস, চা শ্রমিক সন্তান, চা শ্রমিক অধিকারকর্মী,
সংগঠক ও সমন্বয়ক, চা শ্রমিকদের করোনা সুরক্ষা টিম।
- খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ