হেলাল আহমেদ
আপডেট: ২২:২৯, ১৬ আগস্ট ২০২১
বইয়ে ‘মিথ্যা লেখা’ ছিঁড়লে গুনাহ হয়না
আমি তখন খুব ছোট। জিয়া সরকার তখন ক্ষমতায়। স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে এখন যেমন উন্নয়নের পরোক্ষ ইঙ্গিত তখনো তেমনি ইতিহাস বিকৃতির হিড়িক পড়েছে। সর্বদিকে চেষ্টা করে প্রমাণের চেষ্টা চলছে শেখ মুজিব আসলে বাঙালির জন্য কিছুই করেন নি। নিজেকে বাঁচাতে জেলে থেকেছেন। অন্যদিকে জিয়া যুদ্ধের ময়দানে থেকে একাই এগিয়ে নিয়ে গেছেন যুদ্ধকে। দিয়েছেন স্বাধীনতার ঘোষণাও! এমনকি ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা বাঙালির কাঙ্ক্ষিত একটু ঘটনা। এমনটাই তখন আশপাশে শোনতাম।
কেউ কেউ বলতেন শেখ মুজিবের স্বজনপ্রীতির কারণেই তাকে মারা হয়েছে। এখানে দুঃখ করার কিছু নেই। আশেপাশে এসব কথা শোনে, বইয়ে বিকৃত ইতিহাস পড়ে বড় হচ্ছি।
এদিকে আমাদের ঘরেও তখন এসব কথাই বেশি হতো। কারণ আব্বা বিএনপির একনিষ্ঠ সমর্থক। শহীদ জিয়া আব্বার শ্রেষ্ঠ নেতা, বেগম খালেদা জিয়ার দুঃখ দুর্দশার কথা বললে আব্বার বুক ভারী হয়ে আসে। দেশের মৌলভীরা যখন বিনাদোষে মার খায় আব্বার চোখে তখন জল নেমে সাগর ভাসায়। আব্বা আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শোনাতেন। কিভাবে জিয়া একাই মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। দেশের ঘোর বিপদের সময় কিভাবে বঙ্গবন্ধু দেশ ছেড়ে বিদেশের জেলে বসে রইলেন। আবার স্বাধীনতার পরে নাটক করে চলে আসলেন। আমরাও শোনতাম। কানভরে শোনতাম এসব কথা। কারণ তখন বুঝতাম না যে এদেশের ইতিহাস ইতিমধ্যেই বিকৃত করে ফেলা হয়েছে। আব্বা যা বলতো বিশ্বাস করতাম। মনে মনে শেখ মুজিবের প্রতি রাগ জমতে থাকে। শিশুমনের মনিকোঠায় খালেদা জিয়াকে সম্মানের আসনে বসিয়ে দেই আমরা। ঘৃণা জমতে থাকে মুজিবের প্রতি।
একবার লিলু নানা আসলেন আমাদের বাড়িতে। এর আগে শোনেছি লিলু নানা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। রাইফেল চালিয়ে আমাদের গ্রামে প্রায় চল্লিশজন মিলিটারিকে একাই শায়েস্তা করেছেন। তাই লিলু নানার প্রতি আমাদের আগ্রহের শেষ রইলো না। লিলু নানা যখন আমাদের বাড়িতে আসলেন রাতে আমরা সবাই মিলে নানাকে ঘিরে ধরলাম। দাবি একটাই আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাতে হবে।
লিলু নানা গল্প শুরু করলেন। আমরা গভীর আগ্রহ নিয়ে গল্প শুনছি। গল্পের এক পর্যায়ে লিলু নানা বললেন, ৭মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু স্বধীনতার ডাক দিলেন। সবাইকে যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকার কথা বললেন। তারপর ২৫শে মার্চ রাতে রেডিওতে হঠাৎ শোনলেন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা।
আমরা লিলু নানার কথা থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'স্বাধীনতার ঘোষক তো জিয়াউর রহমান। তুমি বারবার শেখ মুজিব বলছো কেন?' নানা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন 'স্বাধীনতার ঘোষক জিয়া কে বলেছে? কে শিখিয়েছে এসব তোদের?' আমি ডান বাম না ভেবে আব্বার কথা বললাম। লিলু নানা বললেন, 'ভুল, যা জানোস সব ভুল। স্বাধীনতার ঘোষক শেখ মুজিবুর রহমান। জিয়াউর রহমান ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলেন মাত্র।'
তাইলে আব্বা যে বললো, 'জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক?'
লিলু নানা হেসে হেসে বললেন, 'তোর আব্বার জন্ম যুদ্ধের সময়। সে বড় হতে হতে দেশে অনেক কিছু বদলে গেছে। ততোদিনে বঙ্গবন্ধুকে মেরে ইতিহাস নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। তাই তোর আব্বা যা জানে তাও ভুল। এইখানে তোর আব্বার দোষ নাই। যা শোনছে তাই বলছে।'
আমি বললাম, 'খালি আব্বা বলে নাই। বইয়ের মাঝেও এইটাই লিখা।' দৌড়ে গিয়ে ঘর থেকে বই এনে লিলু নানাকে দেখালাম। লিলু নানা সাথে সাথে বইয়ের পাতা ছিড়ে ফেলে দিলেন। আমরা তো অবাক! লিলু নানা বইয়ের পাতা ছিড়ে ফেলেছেন!
আমার ভাই বললো, 'নানা বই ছিড়লে গুনা হয়। গুনা হইলে জাহান্নামে যেতে হয়।'
লিলু নানা বললেন, 'বই পড়লে গুনা হয় জানি। কিন্তু বইয়ে মিথ্যা লিখা থাকলে সেই বই পুড়িয়ে ফেললেও গুনা হয়না।'
আমরা সেদিন কিছুই বুঝিনি। কোনটা মিথ্যা আর কোনটা সত্যি বুঝার শক্তি তখন আমাদের নাই। লিলু নানাও আর গল্প শোনান নি। দুইদিন থেকে চলে গিয়েছিলেন। এরপর অনেকদিন কেটে গেছে। আমি ধীরে ধীরে প্রাইমারির গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিকে উঠলাম। দেশে সরকার তখন বদলেছে। সরকার ফ্রি'তে বছরের প্রথম দিনই বই দিলো। বই নিয়ে দৌড়ে বাড়িতে এসে বই খোলে বইয়ের গন্ধ নিচ্ছি। নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকা তখন নেশার মতো লাগতো। একদিন শীতের বেলা দুপুরে মাঠের মাঝে খড়ের উপর বসে নতুন বই খুলে নাড়াচাড়া করছি। হঠাৎ একটা পাতায় বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখতে পেলাম। ডান হাতের আঙুল উঁচানো, চোখে চশমা, ভাষণ দেওয়ার ছবি৷ জীবন্ত ছবি মনে হচ্ছিলো। বেশ বড় একটা অধ্যায়। কৌতুহলবশত পড়া শুরু করলাম। এক পর্যায়ে জানলাম এই মানুষটিই সাড়ে সাত কোটি মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিলো। দ্বীপ্ত কণ্ঠে ডাক দিয়েছিলো স্বাধীনতার। এই মানুষটি দীর্ঘদিন জেল খেটেছে। যতো পড়ছি নতুন বিষয় জানছি। একদম শেষের দিকে এসে জানলাম আব্বার কথা শোনে যেই জিয়াকে বুকের মধ্যে ঠাই দিয়েছিলাম এই জিয়ার নির্দেশেই বঙ্গবন্ধুর শরীরে ষোলোটা গুলি গেঁথে দেওয়া হয়েছিলো নিকৃষ্টভাবে। আরো জানলাম জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক এটা ছিলো ইতিহাসের নিখুঁত মিথ্যা কথা! নিখুঁত কারণ একটা দীর্ঘসময় পাঠ্য বইয়ে আমরা এই বিষয়টাই পড়েছি। সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম আমি বড় হতে হতে অনেক ইতিহাসই বিকৃত হয়ে গেছে। লিলু নানা সেদিন কেন বইয়ের পৃষ্ঠা ছিড়েছিলেন তাও আন্দাজ করলাম। মনে মনে ভাবলাম ঠিকিতো বই ছিড়লে গুনা হয়। কিন্তু বইয়ে মিথ্যা লেখা থাকলে সেই বই ছিড়লে গুনা হয়না।
মুক্তিযুদ্ধের ৪৮ বছর পেরিয়ে গেলেও এই মিথ্যা পুরোপুরি মিটে যায়নি। এখনো এরকম অনেক মিথ্যা রয়ে গেছে ইতিহাসে, বইয়ের পাতায়। যেগুলো লিলু নানার মতো ছিড়ে ফেলতে হবে। এর আগ পর্যন্ত এদেশের কোনো শহীদের আত্মাই শান্তি পাবে না। এখনো আমাদের বাচ্চাদেরকে শেখানো হয় বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা বললে পাপ হবে! এখনো আমাদের বাচ্চাদের কানে মন্ত্র দেওয়া হয় একুশের প্রভাতে শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া গুনাহ! শেখানো হয় একজন হিন্দু কবির লেখা গান জাতীয় সঙ্গীত হতে পারে না।
বাঙালির ইতিহাসে এই অসঙ্গতিগুলো এখনো রয়ে গেছে। এগুলোকে ইতিহাসের বই থেকে ছিড়ে ফেলতে হবে। তানাহলে একটা পুরো প্রজন্মই বঞ্চিত হবে তার সত্য ইতিহাস থেকে।
হেলাল আহমেদ, কবি
- খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ