ইমতিয়াজ মাহমুদ
আপডেট: ২১:০০, ১৭ আগস্ট ২০২১
ভাগাভাগি করে নিয়ে ওরা বলবে ‘নারীকে দিয়েছি সর্বোচ্চ সম্মান’
প্রকাশ্যে নারীদের প্রহার করছেন এক তালেবান সদস্য, দাঁড়িয়ে দেখছে এক শিশু। ছবি: উইকিপিডিয়া।
যদি আমরা আমাদের ঘরের কাজটা করতে না পারি, তাইলে তরুণদের মধ্যে এইসব তালেবানি উগ্রপন্থার প্রভাব থাকবেই। নারীর কথাটা বারবার ঘুরে ঘুরে আসে- নারীর অধিকার প্রশ্নে জনমত তৈরি ও শিক্ষা প্রধান এই দুইটা না করলে আমাদের ছেলেমেয়েরাও তালেবানি পন্থাতে কোন দোষ দেখবে না।
আফগানিস্তানে তালেবান মুসলিম জঙ্গিরা ক্ষমতা দখল করেছে। উৎখাত হয়েছে আমেরিকার পৃষ্ঠপোষকতায় থাকা সরকারটি। এটা কোন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তর নয়। এখন আফগানিস্তানে যেসব কর্মকাণ্ড হতে থাকবে তার প্রথম শিকার হবে নারীরা।
নারীদেরকে ওরা গরু ঘোড়া বা অন্য যে কোন গৃহপালিত পশুর মর্যাদায় নামিয়ে আনবে আর বলতে থাকবে, আমরা দিয়েছি নারীকে সর্বোচ্চ সম্মান। ওরা নারীদের তালিকা করবে, নিজেদের মধ্যে নারীদেরকে ভাগাভাগি করে নিবে, যেভাবে মানুষ লুটের মাল ভাগাভাগি করে আর বলবে, নারীকে আমরা দিয়েছি সর্বোচ্চ সম্মান।
আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন, ভাই কীভাবে আপনারা নারীকে সর্বোচ্চ সম্মান দিলেন? ওরা আপনাকে বলবে, নারীদেরকে আমরা মহা মূল্যবান মনি মুক্তা হিরা জহরতের মত কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে রেখেছি। কোন নারীকে তার মালিক বা হেফাজতকারি ছাড়া আর কেউ দেখতেও পারবে না। আপনি যদি বলেন যে, কিন্তু নারীরাও তো মানুষ, ওদের কি ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন মূল্য নাই? সেই কথার আপনি কোন জবাব পাবেন না। কেননা ওরা যে নীতি আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করতে চায় সেখানে নারীদেরকে আসলেই মানুষ হিসাবে বিবেচনা করা হয় না। নারীদেরকে ওরা যদি সম্মান করে তাইলেও করবে পোষা জীবজন্তু বা বস্তুর মত। নারীদেরকে ওরা যদি নির্যাতন করে সেটাও হবে ঐ একই নীতিতে।
আফগানিস্তানের এই ঘটনায় আমাদের কি করনীয় বা আফগানিস্তানে তালেবানদের উত্থানে আমাদের প্রতিক্রিয়া কী হওয়া দরকার?
(২)
প্রথমত, আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে আমরা হস্তক্ষেপ করতে পারি না। আফগানিস্তানের জনগণকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে ওরা কি চায়। সেইজন্যে আফগানিস্তানে যেন একটা ন্যূনতম গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিরাজ করে তার জন্যে আন্তর্জাতিক একটা ক্যাম্পেইন সূচনা করা বা অন্যরা সেরকম কোন কার্যক্রম শুরু করলে সেটাতে যোগ দেওয়া আমাদের কর্তব্য হবে। বিশেষ করে নারীদের অধিকার- নারীর শিক্ষার অধিকার, রাজনীতিতে ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের অধিকার এবং সামাজিকভাবে নিজের জীবন সম্পর্কে নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার এইসব বিষয়ে আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন যারাই থাকুক ওরা যেন ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করে তার জন্যে চাপ সৃষ্টি করা আমাদের দায়িত্ব।
কেন আমাদের দায়িত্ব? প্রথমত পৃথিবীর সর্বত্রই নারী অধিকারের যেসব ন্যূনতম কিছু ইস্যু জগতজুড়ে সকলে মানে, সেইটা যেন আফগানিস্তানেও মানা হয় সেইটা দেখা তো পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব। আমরা তো সকলেই CIDAW ইত্যাদি স্বাক্ষর করেছি, জাতিসংঘের অন্যান্য অধিকার সনদ ইত্যাদিতে স্বাক্ষর করেছি। তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেটা, আফগানিস্তান ভৌগলিক ভাবে আমাদের কাছাকাছি এবং ঐতিহাসিকভাবেও আমাদের সাথে ওদের রয়েছে নানাপ্রকার সাংস্কৃতিক ও সামাজিক যোগাযোগ। আফগানিস্তানে একটি উগ্রবাদী জঙ্গি রাজনৈতিক উত্থান আমাদের দেশের পরিস্থিতিকেও নানাভাবে প্রভাবিত করবে।
আমাদের এখানে ইতিমধ্যেই একটা নারীবিদ্বেষী মৌলবাদী গোষ্ঠীর বিকাশ হয়েছে। হেফাজতের তেরো দফা আপনাদের মনে আছে, হেফাজতের মৃত আমির মৌলানা শফির 'তেঁতুল বক্তৃতা' আপনাদের মনে আছে। আমাদের এখানে ওদের সংখ্যা কম নয় যারা মনে করে নারীরা মহামূল্যবান পাথরের মত বা সুস্বাদু খাবারের মত বস্তু মাত্র- মানুষ নয়। এইরকম কথাবার্তা এবং এইরকম নীতি থেকে উৎসারিত আচরণ আপনারা প্রতিদিনই দেখেন অনলাইনে ভার্চুয়াল জগতে এবং অফলাইনে বাস্তব জগতে। তালেবানি শাসনাধীন আফগানিস্তানের উপস্থিতি আমাদের এইখানে অন্ধকারের শক্তিগুলিকে তাকত জোগাবে। আফগান রাষ্ট্র বা আফগান জনগণকে তো আপনি উধাও করে দিতে পারবেন না, কিন্তু তালেবানি নীতি যেন ওরা অনুসরণ না করতে পারে সেই চেষ্টা তো আমাদেরকে করতেই হবে আমাদের নিজেদের স্বার্থেই।
(৩)
টেলিভিশনে এবং অনলাইনে আফগান নারীদের অবস্থা ও ওদের আশংকা আপনারা দেখেছেন। নারীদের কথা শুনেছেন, খবর দেখেছেন। ভীতিকর একটা পরিস্থিতিতে আছে আফগান নারীরা। বিশেষ করে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলেজে ইশকুলে পড়তেন ওরা আছেন এখন মহা বিপদে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করা মেয়েরা তো আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। অনেকের প্রাণ যাবে নিতান্ত পশ্চিমা শিক্ষা গ্রহণের চেষ্টা করেছে বলেই।
আমি জানি আফগানিস্তানের মানুষই একসময় আজকের এই অন্ধকার সময় থেকে নিজেদের দেশকে বের করে নিয়ে আসবে। সময় লাগবে, অনেক সময় লাগতে পারে হয়তো- কিন্তু মানুষের শক্তির কাছে অপরাজেয় কিছু নাই। এইসব পচা পুরনো বাতিল নীতি আদর্শ যেগুলি দেখিয়ে ওরা নারীদেরকে নিবর্তন চালায় সেগুলি একসময় আফগানরা ছুড়ে ফেলবে। কিন্তু এই সময়টা আফগানিস্তানের প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলি যদি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন না করে তাইলে আফগানদের জন্যেই পরিস্থিতি যে কেবল কঠিন হবে তাইই শুধু নয়- দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা যারা অন্যান্য রাষ্ট্রগুলি রয়েছে আমরাও ঝামেলায় থাকবো।
প্রত্যাশা করি আমাদের সরকার নিশ্চয়ই কাবুলের পরিস্থিতি ঠিকমত পর্যবেক্ষণ করছে। এই পরিস্থিতি নিয়ে আফগানিস্তানের এই দিকের প্রতিবেশি যেসব রাষ্ট্র আছে আর উল্টা দিকের প্রতিবেশি যারা আছে সকলের সাথেই নিশ্চয়ই আমাদের সরকার কূটনৈতিক যোগাযোগ রাখবে। রাখতেই হবে- এইসব সন্ত্রাস হচ্ছে নোংরা দুর্গন্ধযুক্ত ময়লার মত। পাশের বাড়িতে থাকলে সেটা আপনাকেও বিরক্ত করবে। আপনাকেই ব্যবস্থা নিতে হবে যেন এই ময়লা আপনার আঙ্গিনায় চলে না আসে আর প্রতিবেশিকে চাপ দিতে হবে যেন ময়লা পরিষ্কার করে।
(৪)
তালেবানদের সমমনা জঙ্গি ও জঙ্গি মনভাবাপন্ন উগ্রবাদী গোষ্ঠী কি আমাদের দেশে নাই? আছে তো। সেই কারণে ঘরের মধ্যেও কিছু তৎপরতা পরিচালনা করতে হবে। না, পুলিশ দিয়ে লোকজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া কোন কাজের তৎপরতা নয়। আদর্শগত তৎপরতা পরিচালনা করতে হবে। সেটা খুব কঠিন কোন কাজও না। শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে সাম্প্রদায়িক প্রবণতা দূর করে সেক্যুলার লিবারেল বিজ্ঞানমনস্ক গণতান্ত্রিক চেতনা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। একদিনে হবে না, ধীরে ধীরেই করতে হবে। কিন্তু এই কাজটা করতেই হবে। সেই নিজের দেশে গণতান্ত্রিক চর্চা, গণতান্ত্রিক অনুশীলন এইসব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। একটা সেক্যুলার আধুনিক রাষ্ট্র হিসাবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
আমরা নিজেরা যদি আমরা আমাদের ঘরের কাজটা করতে না পারি, তাইলে তরুণদের মধ্যে এইসব তালেবানি উগ্রপন্থার প্রভাব থাকবেই। নারীর কথাটা বারবার ঘুরে ঘুরে আসে- নারীর অধিকার প্রশ্নে জনমত তৈরি ও শিক্ষা প্রধান এই দুইটা না করলে আমাদের ছেলেমেয়েরাও তালেবানি পন্থাতে কোন দোষ দেখবে না।
এই কাজগুলি আমাদেরকে করতে হবে আমাদের নিজেদের স্বার্থেই। আমেরিকা, চীন বা রাশিয়ার মত বড় শক্তি নই এমনকি আফগান প্রশ্নে পাকিস্তান ও ভারতের গুরুত্বও সম্ভবত আমাদের চেয়ে বেশি। সেইসব কথা বিবেচনায় নিয়ে হাতগুটিয়ে বসে থাকলে সমস্যা আমাদের নিজেদের আঙিনায় চলে আসবে। কাল না আসলেও পরশু ঠিকই চলে আসবে। এজন্যে পদক্ষেপ নিতে হবে আমাদের নিজেদের স্বার্থেই এবং এখনই।
ইমতিয়াজ মাহমুদ, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
- খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ