Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, শনিবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৫,   বৈশাখ ৬ ১৪৩২

জসীম উদ্দীন মাসুদ

প্রকাশিত: ২২:৩৩, ৪ অক্টোবর ২০২১
আপডেট: ১৭:১৬, ৮ অক্টোবর ২০২১

‘শিশুর জন্য বিনিয়োগ করি, সমৃদ্ধ বিশ্ব গড়ি’

শিশুদের প্রতিটি ইচ্ছা এক একটি স্বপ্ন, প্রতিটি ইচ্ছাই এক একটি অধিকার। এই ইচ্ছা, অধিকার এবং স্বপ্নকে যতদিন আন্তরিকভাবে গ্রহণ করা না হবে ততদিন শিশুরা অদূর ভবিষ্যতে সুনাগরিক হয়ে উঠতে পারবে না এবং তাদের পক্ষেও তখন অন্যদের আশা-আকাঙ্খা পূরণ করা সম্ভব হবে না।

১৯৫৩ সাল থেকে বিশ্ব শিশু দিবস পালিত হয়ে আসছে। শিশু অধিকার সপ্তাহ পালন শুরু হয়েছে তারও অনেক পরে যখন ১৯৯০ সালের ২ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ আইনে পরিণত হলো তখন থেকে। বিশ্বের সকল শিশুর কল্যাণের কথা মাথায় রেখে বিশ্ব শিশু দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে, ‘শিশুর জন্য বিনিয়োগ করি, সমৃদ্ধ বিশ্ব গড়ি’। আজ থেকে ৯৬ বছর আগে ১৯২৪ সালে শিশুর জন্য এই বিনিয়োগ ভাবনা থেকেই লীগ অব নেশনস-এর জেনেভা কনভেনশনে সর্বপ্রথম উচ্চারিত হয়েছিল এক মহান ঘোষণা- “মানবজাতির সর্বোত্তম যা কিছু দেয়ার আছে, শিশুরাই তা পাওয়ার যোগ্য”। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এখনও শিশুদেরকে মানবজাতির সেই সর্বোত্তম উপহার আমরা দিতে পারিনি এবং তাদের জন্যে উপযুক্ত বিনিয়োগের অভাবে আজ অব্দি শিশুর বাসযোগ্য পৃথিবীও আমরা গড়তে পারিনি।

ব্যক্তি, পরিবার, প্রতিষ্ঠান,সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার উন্নয়নের স্বার্থে আমরা উপযুক্ত বিনিয়োগের কথা ভাবি। তবে একটি কথা প্রায়শই ভুলে যাই, এই ৫টি ক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে কোন না কোনভাবে আবর্তিত হচ্ছে আমাদের শিশুরা। তাই সামষ্টিক উন্নয়নের স্বার্থ বিবেচনায় গুরুত্ব দিতে হবে শিশুর জন্য বিনিয়োগকে। অথচ বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায়, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিনিয়োগের যে কথা আলোচিত হয় তার প্রায় পুরোটাই জুড়ে থাকে শিল্প, কৃষি এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক খাত। অবশ্য সুখকর বিষয় হচ্ছে এখন বিশ্ব নেতুবৃন্দ ভাবছেন একটি দেশের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ হচ্ছে সে দেশের শিশুদের জন্য বিনিয়োগ করা। সে লক্ষ্যে রাষ্ট্র তার ভবিষ্যৎ কর্ণধারদের সুনাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠার কথা ভাবনায় রেখে বিনিয়োগ করার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

সন্তান মাতৃগর্ভে আসার পর থেকেই শিশুর জন্য এই বিনিয়োগ শুরু করতে হবে। শিশুর পৃথিবীতে নিরাপদ আগমনের জন্যে গর্ভজাত শিশু ও গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্য সেবার জন্য রাষ্ট্র বিনিয়োগ করবে। পিতামাতা তাদের সন্তানের কথা মাথায় রেখে বিনিয়োগ করবে। লেখাপড়ার জন্য ভালো পরিবেশ তৈরি করা, উপযুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া এবং স্বাস্থ্যসেবা সহ শিশু বিকাশের প্রতিটি ক্ষেত্রে নজর রাখা হচ্ছে অভিভাবকের অন্যতম দায়িত্ব। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, উন্নত হাসপাতাল, খেলার মাঠ, বিনোদন পার্ক ইত্যাদির জন্যে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করা। সরকারি এবং বেসরকারি  পর্যায়ে এই বিনিয়োগ যত বাড়ানো যাবে ততই শিশুরা সুনাগরিক হয়ে গড়ে উঠবে এবং রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারবে। অন্যান্য ক্ষেত্রে বিনিয়োগের মতো লাভ লোকসানের বিষয়টি এখানে মাথায় না আনাই শ্রেয়।

আমাদের মহান স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর শিশু ভাবনাগুলো নবগঠিত সরকারের মাধ্যমে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। পবিত্র সংবিধানের ২৮(৪) ধারায় শিশুদের অগ্রগতির জন্য রাষ্ট্রকে বিশেষ বিধান প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। বঙ্গবন্ধু দেশের প্রাথমিক শিক্ষাকে করেন জাতীয়করণ। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭৪ সালে প্রথম শিশু আইন প্রণীত হয় এবং তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৪ সালে ঘোষণা করা হয় জাতীয় শিশুনীতি। বর্তমান সরকারের সময়ে শিশুদের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম আরও গতি পায়। জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে সরকার জাতীয় শিশুনীতি-২০১১ প্রণয়ন করেছে। সরকার দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০, শিশুশ্রম নিরসন নীতি-২০১০, শিশু আইন-২০১৩, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩, শিশুর প্রারম্ভিক যত্ন ও বিকাশের সমন্বিত নীতি ২০১৩, গৃহকর্মী সুরক্ষা কল্যাণ নীতিমালা ২০১৫, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ এবং শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র আইন-২০২১ প্রণয়ন করেছে।

পথ শিশু, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশু, বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া ও প্রতিবন্ধী শিশুদের কল্যাণে কয়েক পর্যায়ে  আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। পরিত্যক্ত শিশুদের সেবা ও ভাতা প্রদান, পথ শিশুদের পুনর্বাসনসহ তাদের জীবনমান উন্নত করতে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। শিশুর শিক্ষা ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে মিড-ডে মিল, শিশুর জন্য নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। শিশুর পুষ্টি ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য প্রায় ১১ লাখ মাকে মাতৃত্বকালীন ও ল্যাকটেটিং মাদার ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। পাশাপাশি, বর্তমান সরকার হতদরিদ্র ও ছিন্নমূল শিশুদের জন্য শিশুবিকাশ কেন্দ্র কার্যক্রম প্রসারণ এবং চা-বাগান ও গার্মেন্টস কর্মীদের শিশুদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন করেছে।

প্রতিটি শিশুর আছে নিজস্ব ভাবধারা, চিন্তা, মতামত এবং প্রকাশ ক্ষমতা যদিও একথা আমাদের বয়স্ক মন মানতে চায়না। আমরা অনেকসময় ভুলে যাই শিশুরাও মানুষ। শিশুদের প্রতিটি ইচ্ছা এক একটি স্বপ্ন, প্রতিটি ইচ্ছাই এক একটি অধিকার। এই ইচ্ছা, অধিকার এবং স্বপ্নকে যতদিন আন্তরিকভাবে গ্রহণ করা না হবে ততদিন শিশুরা অদূর ভবিষ্যতে সুনাগরিক হয়ে উঠতে পারবে না এবং তাদের পক্ষেও তখন অন্যদের আশা-আকাঙ্খা পূরণ করা সম্ভব হবে না। শিশুদের যতগুলো অধিকার আছে যেমন- জন্মনিবন্ধন, শিক্ষা, খেলাধুলা, চিকিৎসা, বিনোদন, স্নেহ-ভালোবাসা, নিরাপত্তা ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের উপযুক্ত দায়িত্ব নিতে হবে।

এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব-তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ।
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।

বিপ্লবী কিশোর কবি সুকান্তের সাথে আমরা ক’জন এক হতে পারবো জানিনা তবে শিশুর জন্যে নিবেদিত হয়ে সব জঞ্জাল প্রাণপণে সরাবার দৃপ্ত অঙ্গীকার নেয়া গেলে হয়তো এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে গড়ে তোলা যাবে। প্রায় পঁচাত্তর বছর আগের এই কবিতার আবেদন যেন এখনও প্রাসঙ্গিক।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সুকান্তের কথাটা সবসময় মনে রাখি। এই বিশ্বকে আমরা এমনভাবে তৈরি করতে চাই, আমাদের শিশুরা যেন সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে, চলতে পারে, উন্নত জীবন পেতে পারে। সুন্দর জীবন পেতে পারে, নিরাপদ জীবন পেতে পারে। আর শিক্ষা দীক্ষায় সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়।

প্রধানমন্ত্রী এবারের বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহের প্রাক্কালে বলেছেন, সরকার দেশের সকল শিশুর সমঅধিকার নিশ্চিত করে সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে কাজ করে যাচ্ছে। শিশুর সার্বিক বিকাশ ও অধিকার বাস্তবায়নে এবং শিশুদের প্রতি সহিংস আচরণ ও নির্যাতন বন্ধের ক্ষেত্রে পিতা-মাতা, পরিবার ও সমাজের সকলকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। 

করোনা অতিমারী আমাদের শিশুদের পিছিয়ে দিয়েছে বিস্তর। এই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া খুব কঠিন হয়ে পড়বে যদি দায়িত্বশীলরা উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হই। ১৯৪১ সালে সরকারের সুখী ও সমৃদ্ধ দেশের স্বপ্ন পূরণে আজকের শিশুরাই তো হাল ধরবে। দায়িত্ব পালনে আমাদের কোন ব্যর্থতা যেন তাদেরকে ছুঁতে না পারে। শিশুদের কল্যাণের কথা ভেবে কোন কাজ ফেলে রাখার সুযোগ নেই। মাতৃগর্ভ থেকে শুরু করে প্রারম্ভিক শৈশব,কৈশোর অর্থাৎ শিশু উন্নয়নের প্রতিটি পর্যায়ে নির্ভেজাল ও আন্তরিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে আমাদের সকলকে।

বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ পালনের অন্তর্নিহিত অর্থ হচ্ছে শিশুদের স্বার্থ ও কল্যাণকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করা। পরিশেষে ১৯৪৫ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী চিলির গ্যাব্রিয়েলা মিস্ট্রাল এর একটি কবিতা দিয়ে শেষ করছি, এখানেও পরোক্ষভাবে শিশুর জন্য বিনিয়োগের কথাই বলা হয়েছে-

“আমাদের অনেক প্রয়োজনই দেরিতে মিটলেও চলবে
শিশুর বেলায় তা চলবে না।
কারণ, এখনই গঠিত হচ্ছে তার অস্থি মজ্জা,
তৈরী হচ্ছে রক্ত
তার অনুভূতিও বিকশিত হচ্ছে এখনই।
তাই, তার কোন প্রয়োজনই আগামীকালের জন্য ফেলে রাখা যাবে না;
আজকের প্রয়োজন তার মেটাতে হবে আজকেই।”

জসীম উদ্দীন মাসুদ, জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা, মৌলভীবাজার 

Green Tea
সর্বশেষ
জনপ্রিয়