দীপংকর মোহান্ত
আপডেট: ১৫:০৬, ১৩ অক্টোবর ২০২১
আমাদের উমা, আমাদের গৌরী- আমাদের শারদীয় উৎসব
প্রাগৈতিহাসিক কিংবা পৌরাণিক কাল থেকে শুরু করে হাল আমলের ঐতহাসিক কালপর্বে মানবেতিহাসের ভিন্নতর ভৌগলিক অঞ্চল ও জনজাতির মধ্যে বিভিন্ন দেববেদীর ওপর আত্ম-বিক্ষেপণ করতে দেখা যায়। প্রাচীন দর্শন বা ভাবের কথা হলো যে দেব-দেবী মূল স্রষ্টার সবিশেষ শক্তির অংশ। তাই তাদের শ্রদ্ধা করা আবশ্যক। যেহেতু মাতৃসত্তার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি বা সৃজনের উন্মেষ ঘটে- সেহেতু মাতৃশক্তির-প্রতিভুকে সবচেয়ে অধিকমাত্রায় শ্রদ্ধা, সন্তুষ্টি ও কৃতজ্ঞতা জানানোর রেওয়াজ বেশি ছিল। তাই প্রচীনকালে মাতৃমূর্তির আধিক্য দৃষ্টিগোচর হয়।
উপমহাদেশীয় অঞ্চলে ‘সাংখ্য দর্শনের’ প্রভাবে মাতৃকাশক্তি উর্বরতার প্রতীকে রূপান্তরিত হয়েছেন ভক্তিবাদের কল্যাণে। প্রতীকী মাতৃমূর্তিগুলো বহু অর্থ ব্যঞ্জক- যা দর্শনের গভীরে ব্যঞ্জণা তোলে ও স্পন্দিত হয় অন্তরের গহীনে। মাতৃশক্তির মধ্যে সৃজন, প্রতিপালন, রক্ষা, প্রলয়, প্রেম, সংহার ইত্যাদি বহুবর্ণিল বৈশিষ্ট্য দৃষ্টিগোচর হয়। যা আমাদের পরিবারের মায়ের অনুরূপ। সেখানে কাম-ভাব তিরোহিত- আবার ত্যাগের মহিমার সাথে মানবিকতা যুক্ত হয়েছে নিরন্তন সংগ্রামের রুদ্ররূপে। তা না হলে সৃষ্টি সহিংসতায় ভরে ওঠবে। সেখানে একজন ‘মা’ স্বার্থক। তিনি সংসার রণাঙ্গণের পূর্ণতার প্রতীকও বটে।
পৃথিবীর মূর্তিকেন্দ্রীক পার্বণকে অনেকে ‘পাগান ধর্ম’ও বলে থাকেন। এই ধর্ম-পর্র্ব হাজার বছর আগেই বহু দেশ ও ধর্ম থেকে নিঃষেশিত হয়েছে। প্রকৃতিকে আর ধর্ম হিসেবে দেখা হয় না। কিন্তু ভারতীয় ধর্মদর্শনে সর্বদাই বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের বন্ধ যুক্ত খোঁজেছে। প্রকৃতিক শক্তিকে তারা সাঙ্গীকৃত করেছেন ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যে ও মননভূমের আমর্মে। ঋষিরা আধ্যাত্মিক চৈতন্যে নিজের তৃতীয় নয়ন খুলে দেখেছেন ‘সমদর্শী একত্বে’র এক বিভূতির খেলা চলছে জগত জোড়ে। ফলে ভারতীয় মূর্তি ও মূর্তিপূজায় কখনো জড় হয়ে ওঠেনি। সেখানে ভক্তরা সমত্ব দেখেছে দর্শনে, চৈতন্যের আলোকে ও চিত্তলোকের বিভাসে। ভারতীয় দর্শনে ভাব প্রেম ধ্যান শ্রেয়ঃ অর্ন্তদর্শন সংমিশ্রিত হয়ে একটি স্বতচ্ছ¡ল ধারা প্রবাহিত হয়েছে মর্মর মূর্তির ভিতর দিয়ে- ভক্ত সেখানেও খুঁজেছে ঈশ্বরকণাকে। অনুসারীগণের অন্তরে নিঃশ্রেয়স পন্থায় প্রেমভক্তির দাস্যভাব মিলেমিশে একাকার হয়েছে। তখন সেটা আর মূর্তি থাকেনি; চিন্ময় সত্তায় ভক্তিভাবে মজে যায়। ফলে এই নরম মাটিতে একেশ্বরবাদীদের [ব্রহ্মবাদীরা] কাছে মূর্তিপূজা গৌণ হয়ে যায়নি, সমন্বয় ঘটেছে বারবার। অর্থাৎ শাস্ত্র ও দর্শনের ভেতর দিয়ে মূর্তিপূজা আধ্যাত্মিক জীবনধারায় যুক্ত হয়েছে।
শাস্ত্রে বলা হয়েছে- সাধারণ মানুষের ভক্তিবাদ প্রবল থাকে। তারা মূর্তি বা প্রতীককে ঘিরে-ই চিন্তা করেন। তাত্তি¡কদের বোধ থাকে দর্শনের গভীরে। অন্যদলের থাকে প্রেমভক্তির স্রোত [বৈষ্ণববাদ]। এই মতে মূর্তি মুখ্য নয়। চৈতন্যের চিদানন্দশক্তি বুদ্ধি ও বিশ্বাসের সাথে শ্রেয়কে সংযুক্ত করে সংগোপনে। আবার সাধারণ মানুষ আচার-প্রথা ও সংস্কৃতিকে এক করে দেখে থাকে। তার পূর্ণতা দিতে পারে প্রতীকী কাঠামো। এজন্য হিন্দু ধর্মদর্শনে নানা উপাসক সম্প্রদায় দৃষ্টিগোচর হলেও দ্বৈত বা অদ্বৈত চেতনার উৎসমুখ একই থাকে- পথ ভিন্ন হতেও পারে।
আমরা যে শ্রীদুর্গা দেখি- তাঁর বহুবিদ প্রাচীন আদল বা মূর্তিরূপ পৃথিবীর নানা দেশে পাওয়া গেছে। এই বিষয়ে অনেক মতামতও রয়েছে। কিন্তু বিষয় একটাই- মাতৃবন্দনার ভেতর দিয়ে মানুষের মধ্যে শুভ বোধ, বুদ্ধি ও বিবেক জাগ্রত করা। মানুষ সহজাত প্রবৃত্তিবশত যখন-তখন আসুরিক কিংবা পাশবিক হয়ে ওঠতে পরে। আবার কুবৃত্তিকে দমনও করতে পারে পারে। যদি না পারে, তবে তা সংহারের প্রয়োজন পড়ে। দুর্গা মূর্তির মধ্যে নিহীত মাতৃশক্তি আমাদের ন্যায়ের প্রতীক হয়ে শিক্ষা দেয় যে, একই ব্যক্তির দ্বৈত সত্তাকে নিয়ে সুভনচিত্তে চলতে পারে। আসুরিক প্রবৃত্তি প্রবল হলে ব্যক্তি-সমাজে বিদ্যমান সুন্দরতা ক্রমে ক্ষয় হয়। ফলে অসুরকে দমাতেই হয়।
শ্রীদুর্গাকে কেবল আধ্যাত্নিক চোখে না দেখে ইতিহাস, সমাজতত্ত¡ কিংবা মনো-সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতেও বিচার করা যায়। সংস্কৃতি পাগল বাঙালি হিন্দুরা ক্রমে শ্রীদুর্গাকে শাস্ত্রের একপেশে বন্ধন থেকে মুক্ত করে গণ-দুর্গায় পরিণত করেছে। মনে রাখা দরকার যে শ্রীশ্রীচণ্ডীর [গ্রন্থ] শ্রীদুর্গা এবং বাঙালির চেতনার দুর্গার মধ্যে কিছু ভিন্নতা রয়েছে। এই ভিন্নতার জন্য আজ বাঙালি হিন্দুদের বড় ধর্মীয় উৎসবের রূপে নিয়েছে শারদীয় দুর্গা পূজা [অন্যান্য ভাষা/সংস্কৃতি/জাতির মধ্যে শারদীয় উৎসব গৌণ]। ভাবতে হয় যে গণ-মানুষের দুর্গা দেবী কেমন ছিলেন? দুর্গা পূজা কেবল শাস্ত্রগত নয়- কৃষি সভ্যতার বিবর্তনের স্মারকও বটে। দুর্গাপূজার ‘কলা বউ’ তো কৃষি উপাচার দিয়ে তৈরি করা হয়। আবার মূর্তিটি গোপনে গোপনে প্রান্তিক মানব সংস্কৃতির একটি অহিংস ঐক্যের অর্থও বহন করেছে।
শাস্ত্রের দুর্গা দেবীকে ব্রাহ্মণ্যবাদের নিরিখে সাত্ত্বিক মতে দিন-ক্ষণ-তিথি দেখে পূজা করতে হয়। কিন্তু পাÐববর্জিত বাংলার শ্রীদুর্গার রূপ হলো আমাদের সাধারণ গৃহী মায়ের আদলেই মমতাময়ী। তিনি সৃষ্টিও করেন; আবার শাসন করেন। তাঁর সহনশীল ক্ষমতা অপরিমেয়। তিনি উমা কিংবা গৌরী হিসেবে নিত্যদিন মনের মণিকোঠায় থাকেন। একারণে দুর্গাপূজা সর্বজনীন হয়ে ওঠেছে। ওখানে তাঁকে শাস্ত্র দিয়ে পূজা করতে হয় না। অন্তরের শ্রদ্ধায় পুষ্পাঞ্জলি দিতে হয় মনের ভিতরেই।
বাংলায় শ্রীদুর্গার লৌকিক নাম হলো ‘উমা’। কারো কাছে ‘গৌরী’। লোকবিশ্বাস ও লোক-সংস্কৃতি মতে তিনি রাজকন্যা হয়েও দীহনীন কষ্টে জীবন যাপন করেছেন। কিন্তু সংসার ভাঙেননি। সকলকে নিয়েই তাঁর চলা। আজো শব্দকর সমাজে ‘হর-গৌরী’ নৃত্য কদাচিৎ দেখা যায়। এই নৃত্য আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির হারিয়ে যাওয়া সম্পদ। আবার গ্রামের নারী সমাজে‘ উমা’ হলেন সেই কষ্টের সংসারে থাকা ত্যাগী নারীর প্রতীক। শত কষ্টেও যার মুখ ও বুক ফুটে না। তিনি সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে দুঃখকে আনন্দ-সাগরের অতলে তলীয়ে দিতে পারেন। ফলে গ্রামে এক সময় ‘উমা সঙ্গীত’ বিখ্যাত ছিল। এই ‘উমা সঙ্গীত’ বাংলা সাহিত্যের সম্পদ হতে পারে। দুঃখের বিষয় যে আমাদের নারীর ইতিহাস লেখকরা সে দিকে নজর রাখেন না। লোকসংস্কৃতিবিদরাও এ বিষয়ে নির্বকার। ‘উমা সঙ্গীত’ এখন দুষ্প্রাপ্য হয়েছে। তার সুর-লয় আলাদা। করুণ সুরে গানটি গীত হতো। যে কারণে শ্রীদুর্গার বিসর্জনকে তুলনা করা হয় মেয়ের পিত্রালয়ে ‘নাইঅরী’ করে [সে যুগের] যাওয়ার সাথে। এ কারণে বাঙালি হিন্দুদের জীবনে শ্রীদুর্গা পূজা একটি গণ-চরিত্র বহন করছেন। তার আনন্দ উত্তাপ ধর্মীয়বৃত্ত ছাড়িয়ে সংস্কৃতিবৃত্তের চিত্তকে নাড়া দেয়। বলে রাখা ভালো যে পূজা হয় একটি নির্দিষ্ট সময়ের ক্ষণে। বাকিটা সময় সংস্কৃতি ও উৎসবের চরিত্রবাহী মাতৃবন্দনার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দুর্গা মায়ের হাতের মুদ্রা ও অস্ত্র আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে যে, আনন্দময় জগৎ-সংসারে কল্যাণের জন্য সৃষ্টি আবশ্যক; কিন্তু অকল্যাণের প্রতিকার করতে হবে দৃঢ় মনোবলে।
আজ পাশবিক কিংবা আশুরিক শক্তি বা আশুরিক প্রবৃত্তি বিনাশ করে এই শারদীয় উৎসব হোক নতুন সূর্যোদয়ের মতো নির্মল ও প্রাণবন্ত। তাহলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা পাবে এবং মাতৃজাতি শ্রদ্ধার আসনে থাকতে পারবেন। সবাইকে শারদীয় শুভেচ্ছা।
দীপংকর মোহান্ত, লেখক ও গবেষক।
- খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আরও দেখতে পারেন শারদীয় দুর্গাপূজা নিয়ে আইনিউজের ভিডিও
মৌলভীবাজারের দুর্গাপূজা: আবাহনে লক্ষ মানুষের সমাগম
ইন্দ্রপুরীতে দুর্গা পূজা | ত্রিনয়নী | মৌলভীবাজার
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে আগাম দুর্গাপূজা
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ