অমলেন্দু কুমার দাশ
ভারতীয় বন্দী সুকাই বানবাসী যেভাবে ৪ বছর পর ফিরলো তাঁর পরিবারে
ছবিতে সুকাই বনবাসীকে নিয়ে শ্যাওলা-সুতারকান্দি স্থলবন্দরে উভয় দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে লেখক।
সিলেট কারাগারে ভারতীয় বেশ কয়েকজন নাগরিক বন্দী ছিলেন। পরবর্তীতে আমি সিলেট জেলা কারাগার থেকে এদের কয়েকজনকে মুক্ত করে নিজ দেশে ফেরত যেতে সহযোগিতা করি। এ সকল কাজে ভারতের করিমগঞ্জের সাবেক এসপি গৌরভ উপাধ্যায়ের কথা না বললেই নয়, তাঁর সহযোগিতায় আমাদের কাজগুলি অনেক সহজ হয়েছিল। শিলচরের শ্রী অমিত দে, শ্রী সূর্য্য কান্ত সরকার, করিমগঞ্জ শহরের পৃথ্বিশ দাশ, সাংবাদিক করুণা দেব এ কাজে আন্তরিকভাবে আমাকে সহায়তা করেন।
সিলেট কারাগারে ভারতীয় বন্দীদের মধ্যে একজন সুকাই বানবাসী, বয়স ২৬/২৭ হবে। তার বাড়ি ভারতের উত্তর প্রদেশে গাজীপুর জেলার শহবল থানার অর্ন্তÍগত নয়াবস্তিতে। সে কর্মসংস্থানের জন্য ২০১৪ সালের কোনো এক সময়ে তার প্রতিবেশীর সাথে আসামের কাছার জেলায় ইটভাটায় কাজ করতে আসে। কিন্তু এতো দূর থেকে বাড়ি ফেরার সময় পথ ভুলে দালালের খপ্পরে পড়ে বাংলাদেশের জকিগঞ্জ উপজেলার সীমান্তের ভিতরে ঢুকে পড়ে। ধরা পরে যায় বিজিবির হাতে। বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের দায়ে সুকাই বনবাসীর জেল হয় ৯০ দিন। কিন্তু মুক্তিপ্রাপ্ত আসামী হয়েও সে প্রায় ৪ বছর সিলেট কারাগারে বন্দী ছিল।
জেলখানার রেজিষ্টারে তার নাম ঠিকানা ছিল এই ভাবে- নাম: সুকাই, পিতা: অজ্ঞাত, গ্রাম: নয়া বস্তি, জেলা: কাছার। ভাষাগত সমস্যার কারণে তার ঠিকানায় গরমিল হয়ে ভুল তথ্য এন্ট্রি হয়, যা সে বিজিবির নিকট গ্রেফতারকালীন সময়ে রেকর্ডভুক্ত করা হয়। কিন্তু তার প্রকৃত থানা শহবল ও জেলা গাজীপুর এই কথা লিখা ছিল না। গ্রেফতারকালীন সময়ে সুকাই হিন্দি ভাষা ছাড়া বাংলা ভাষা জানতো না বা বুঝতে পারতো না। তাই তার ভাষাগত সমস্যার কারণে ঠিকানায় এই বিপত্তি রয়ে যায়। তাকে ভারতে প্রত্যাবর্তনের জন্য ভারতীয় হাই কমিশন বারবার আসামের কাছার জেলায় পত্র প্রেরণ করলেও কোনো প্রকার উত্তর না পেয়ে সুকাই বানবাসীকে নিয়ে তারা হাল ছেড়ে দেয়।
সুকাই বানবাসী প্রায় ৪ বছর ধরে সিলেট জেলখানায় বন্দী থাকায় সে বাংলা কথা-বার্তা অনেকটা শিখে ও বলতে পারে। আমি তাকে উদ্ধারের জন্য দুই দিন সিলেট কারাগারে যাই। প্রথম দিন জেলসুপার আমাকে সুকাইসহ ভারতীয় নাগরিকদের সাথে দেখা করার অনুমতি প্রদান করেন নাই। নিরুপায় হয়ে আমি ডেপুটি জেলারের মাধ্যমে জেল সুপারের অনুমতি নিয়ে দ্বিতীয় দিন শুধুমাত্র সুকাই বানবাসীর সাথে সাক্ষাৎ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। তার নিকট থেকে অনেক তথ্য, অনেক ক্লু পাই। এর ফলে তার বাড়ির ঠিকানা অনুসন্ধানের জন্য করিমগঞ্জের পৃথ্বিশ দাশের কাছে তথ্য পাঠাই। তিনি এই ছেলের প্রদত্ত ঠিকানার সন্ধান না করতে পেরে সাহায্য নেন তৎকালীন এসপি গৌরভ উপাধ্যায়ের। এই আইপিএস অফিসারের বাড়ি উত্তর প্রদেশের কোনো এক জেলায়। তিনি এই ঠিকানায় শহবল থানা উল্লেখ থাকায় সাথে সাথে উত্তর প্রদেশের সেই জেলার এসপির সাথে সেলফোনে কথা বলে জানতে পারেন সেখানে শহবল থানার অর্ন্তগত নয়া বস্তি গ্রামে সুকাইর দেওয়া পিতার নামে ব্যক্তি রয়েছেন। শুরু হলো শুকাই বানবাসীকে প্রত্যাবর্তনের নতুনরূপে কাজ।
ইতোমধ্যে সুকাইর পিতা-মাতা তার অবস্থান জানতে পেরে পাগলের মতো হয়ে যান। তাদের ধারণা ছিল তাদের পুত্র হয়তো মারা গেছে। সুকাই বানবাসীর স্ত্রী তার স্বামীর কোনো সন্ধান না পেয়ে একমাত্র পুত্রকে রেখে অন্যত্র বিয়ে করে চলে যায়।
সুকাই বানবাসীর প্রকৃত ঠিকানা পাঠানো হলো করিমগঞ্জের তৎকালীন এসপি গৌরভ উপাধ্যায়ের কাছে। সেখানে এম.এল.এ শ্রী কৃষ্ণেন্দু পাল মহাশয়ের পিএ পৃথ্বিশ পাল সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এদিকে আমি ইন্ডিয়ান হাই কমিশন ঢাকায় যোগাযোগ করে শুকাই বানবাসীর প্রকৃত ঠিকানা তাদের নিকট পাঠিয়ে দিলাম। অন্যদিকে এসপি গৌরভ উপাধ্যায় উত্তর প্রদেশের গাজিপুর জেলার শহবল থানা থেকে এই ছেলের পুলিশ ক্লিয়ারেন্স ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিলেন।
- আরও পড়ুন- বন্দী প্রত্যাবর্তন ও কিছু মানবিক উদ্যোগ
এবার দেখা দিল নতুন সমস্যা! হাই কমিশনের প্রথম সেক্রেটারী সুকাই বানবাসীকে প্রত্যাবর্তনের জন্য তিনি বেনাপোল আইসিপি উল্লেখ করে পত্র প্রেরণ করেছেন বাংলাদেশ সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু আমরা অর্থাৎ আমি ও ভারত সাইটের এসপি গৌরভ উপাধ্যায় হাই কমিশনকে অনুরোধ করেছিলাম সুকাইকে সিলেটের শ্যাওলা-সুতারকান্দি অথবা জকিগঞ্জ-করিমগঞ্জ আইসিপি দিয়ে প্রত্যাবর্তন করতে। কিন্তু তারা বাংলাদেশের অন্য প্রান্ত দিয়ে আদেশ করায় সিলেট কারা কর্তৃপক্ষ, এসপি গৌরভ উপাধ্যায় ও সুকাই বানবাসীর পিতাসহ আমাদের কাজ করতে বেশ সমস্যা সৃষ্টি হয়।
পুনরায় আমরা হাই কমিশন ঢাকাকে অনুরোধ করে শ্যাওলা-সুতারকান্দি আইসিপি দিয়ে প্রত্যাবর্তনের আদেশ করার অনুরোধ করা হলে প্রায় ২ মাস উভয় দেশের প্রশাসনিক জটিলতা নিরসন করে অবশেষে ২৪.১১.২০১৭ ইং তারিখ সুকাই বানবাসীকে শ্যাওলা-সুতারকান্দি বর্ডার দিয়ে তার পিতা-মাতার নিকট হস্তান্তর করি।
ছবিতে সুকাই বনবাসীকে (লাল শার্ট পড়া) নিয়ে শ্যাওলা-সুতারকান্দি স্থলবন্দরে উভয় দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সাথে আমি।
অমলেন্দু কুমার দাশ, সহকারী উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা এবং লেখক, লোকগবেষক ও সমাজকর্মী
- খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ