ডা. এম এ আহাদ
আপডেট: ২০:২৬, ১০ নভেম্বর ২০২১
‘সে কি কান্না, ট্রেনের লোকজন অবাক হয়ে তাকিয়েছিলো’
ডা. এম এ আহাদ
কৃষ্ণপ্রিয়া এমসি কলেজের প্রফেসর ছিলো, এখন অবসরপ্রাপ্ত; আমরা একই ব্যাচের। বর্তমানে আমেরিকাতে থাকে। জুম মিটিঙে আমার এক বন্ধু জিজ্ঞাসা করেছিল তাকে, সে কি আমাকে চিনে? উত্তরে বলেছিলো আহাদ আমার ভাইপুত (ভাইপো)। আমরা একসাথে লেখাপড়া করেছি, একসাথে বড়ো হয়েছি!
আমার শৈশবে পাকিস্তানী জমানাতে আইয়ুব শাহী শাসন এক দশকেরও বেশি ছিল। তখন সরকার ছিলো হিন্দুবিদ্বেষী, কিন্তু সাধারণ মানুষ ততটা বিদ্বেষী ছিলনা।
আমার গ্রামটি মহকুমা শহরের উপকণ্ঠে। হিন্দু-মুসলিম জনসংখ্যা ছিল প্রায় সমান সমান। এখন অনেক কমে গেছে। কিছু দেশত্যাগ করেছেন। অনেকে শহরে বসবাস করেন, আবার অনেকেই গ্রামে জায়গাজমির মূল্য বেশি হওয়াতে বিক্রি করে একটু দূরে সস্তায় বেশী জায়গা কিনে ওখানেই বাড়ি করেছেন।
গ্রামে কোনোদিন সাম্প্রদায়িক গন্ডগোল হতে দেখিনি। বিয়ে, পূজাপার্বন, উৎসবে সবাই মিলিত হতেন। আমার পাশের সবগুলি বাড়ি ছিল হিন্দুদের; বন্ধুও ছিলো অনেক, স্কুলে পড়েছি একসাথে, খেলাধুলাও একসাথে।
দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড়ো উৎসব। গ্রামে দুর্গাপূজা হতো, প্রতিদিন বিকালে যেতাম। শুধু প্রতিমা দেখা উদ্দেশ্য ছিলোনা, বন্ধুদের সাথে আড্ডাও ছিল বড়ো আকর্ষণ। শহরের সবচেয়ে বড়ো দুর্গাপূজা হতো দুর্গাবাড়িতে ও চৌমুহনার কালীবাড়িতে। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া আসার সময় দাঁড়িয়ে দেখতাম।
এখনো সম্প্রীতি বজায় আছে গ্রামটিতে।
আমার পাশের বাড়িতে আমার দুজন সহপাঠী ছিল ওরা আপন ভাইবোন। ওদের বাবা ছিলেন স্কুল টিচার, আমি দাদু ডাকতাম। বুড়োর দাঁত ছিলোনা যার জন্য খাবারও হজম হতোনা। আমার দাদিকে বড়বোন মানতেন, প্রায় প্রতিদিন দাদির পানিপড়া উনার লাগতো। ভাইবোনরা বিরক্ত হতো। মাঝে মাঝে আমাদের সাথে গল্প করে দাদিকে দিয়ে না পড়িয়ে পানি নিয়ে চলে যেত। সেই পানি পান করে উনিও ভালো হয়ে যেতেন!
একাত্তুরের মে মাসের ১২তারিখ বাড়িতে ছিলাম। হঠাৎ আব্বা বললেন, ভাগ আর্মি আসছে। দৌড়ে পালালাম। যাওয়ার সময় বন্ধুটিকে সাথে নিতে ভুলিনি। আধা মাইল দূরে গিয়ে গাছের আড়াল থেকে তাণ্ডব দেখলাম আমরা। ওরা দুইজন বৃদ্ধ ঠাকুর্দাকে গুলি করে হত্যা করে। ওদের বুড়ি দাদিকে শ্মশানের একপাশে বসিয়ে আগুন লাগিয়ে পুরো বাড়িটি জ্বালিয়ে দেয়। এক-একটি গুলির বিকট শব্দ হয় আর বন্ধুটি আমাকে জড়িয়ে ধরে। ওরা আর ভারত যেতে পারেনি। আমার বাবা ওকে কলেমা তয়্যিবা শিখিয়ে নিজে সাথে করে বাজারে নিয়ে যেতেন। সওদা কেনা শেষ হলে নিজে আর্মির গেইট পার করে দিতেন।
ওর ছোট ভাই ডাক্তার, কানাডাতে আছে। সে তার জীবনীতে লিখেছে- আমার বড়ভাই হাজী আব্দুর রহমান না থাকলে আমি ডাক্তার হতে পারতাম না।
আমাদের বাড়িতে থেকেছে, ওদের পুরো বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়াতে থাকার অসুবিধা ছিল। আমার মায়ের মৃত্যুর সময় সে কি কান্না তার!
ওর বোন কৃষ্ণপ্রিয়া এমসি কলেজের প্রফেসর ছিলো, এখন অবসরপ্রাপ্ত; আমরা একই ব্যাচের। বর্তমানে আমেরিকাতে থাকে। জুম মিটিঙে আমার এক বন্ধু জিজ্ঞাসা করেছিল তাকে, সে কি আমাকে চিনে? উত্তরে বলেছিলো আহাদ আমার ভাইপুত (ভাইপো)। আমরা একসাথে লেখাপড়া করেছি, একসাথে বড়ো হয়েছি!
বেশ কয়েক বছর আগে দিল্লী গিয়েছিলাম সবাইকে নিয়ে। চিনু কাকা যিনি পাকিস্তানি সময়ে ওখানে পড়তে চলে গিয়েছিলেন ওখানেই থেকে যান। কুক্ষণে উনাকে খবর দিয়েছিলাম আমি আসবো। শেষের দুইদিন আমাকে উনি ঘর থেকে বের হতে দেননি! সারাদিন গল্প আর খুঁটিয়ে সবার খবর নেয়া।
আমি কলকাতা আসার দিন ট্রেনে আমাকে উঠিয়ে দিয়ে সে কি কান্না! ট্রেনের লোকজন অবাক হয়ে তাকিয়েছিলো উনার দিকে।
আজ পঞ্চাশ বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশের এ কি অবস্থা! পাকিস্তানি সময়ে সরকারি নিপীড়ন ছিল আর এখন হয়েছে নিজেদের মাঝে বিভাজন। উত্তরণ কি আদৌ সম্ভব?
ডা. এম এ আহাদ, সাবেক সভাপতি, দি মৌলভীবাজার চেম্বার কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি এবং বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) মৌলভীবাজার
- খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ