অমলেন্দু কুমার দাশ
আপডেট: ১৮:৩৪, ২১ নভেম্বর ২০২১
ভারতের বিভিন্ন কারাগার থেকে বাংলাদেশি নাগরিকদের মুক্তির সূচনা যেভাবে হলো
ভারতে দীর্ঘদিন কাটিয়ে দেশে প্রবেশ করছেন বন্দীরা, সাথে লেখক।
একটি বাংলাদেশি দলকে ভারতের কয়েকটি ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে সুতারকান্দি বর্ডার দিয়ে দেশে আনা হয়, আমি সেদিন উপস্থিত থেকে বন্দীশালা থেকে আগত লোকদের তাদের নিজ নিজ পরিবারের নিকট হস্তান্তর করে সহায়তা করি। সে এক অভাবনীয় মুহূর্ত। দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন থাকা স্বজনের সাথে মিলনের আনন্দ।
ভারতীয় বন্দীদের মুক্ত করে তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনে কাজ করার কারণে আমাকে নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতীয় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। তখন উভয় দেশের সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও দূতাবাসের অনেকের সাথেই আমার পরিচয় হয়। ভারতীয় কয়েকজন সংবাদকর্মী ও সমাজ সেবক আমাকে জানান যে, বাংলাদেশের অনেক লোক আসামের বিভিন্ন কারাগারে বন্দী আছেন। আপনি এদেরকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করুন। আমি শুরু করলাম বাংলাদেশি বন্দীদের তথ্য সংগ্রহের কাজ।
আসাম প্রদেশের কাছার জেলা তপশীল উন্নয়ন পরিষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান, জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক শ্রী সূর্য্যকান্ত সরকার ও শিলচরের বিশিষ্ট সমাজসেবক শ্রী অমিত দে’র সহায়তা নিয়ে শিলচর জেলা কারাগার থেকে বাংলাদেশি বন্দীদের তালিকা সংগ্রহ করলাম। এই তালিকায় ৩০-৪০ জন বাংলাদেশি নাগরিক ছিলেন যাদের বাড়ি সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নরসিংদী, কুমিল্লা, নেত্রকোনা, রাঙ্গামাটিসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়। তালিকায় দেখা যায় অনেকের ঠিকানায় অনেক গরমিল রয়েছে। জেলার সাথে উপজেলা বা ইউনিয়নের বা গ্রামের মিল নেই। অনেকের ঠিকানা অস্পষ্ট রয়েছে। অনেকের আবার সঠিক ঠিকানা রয়েছে।
আমি সারাদেশের সাথে যোগাযোগের জন্য আমার প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (শৃঙ্খলা) জনাব মো. আতাউর রহমানের সহায়তা নিয়ে (বর্তমানে উপপরিচালক) যোগাযোগের মাধ্যম তৈরি করে নিলাম। তিনি আমাকে সারাদেশে কর্মরত আমাদের কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের ফোন নম্বরসহ তালিকা দিয়ে সহায়তা করেন। আমি আমার সহকর্মী “সহকারী উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তাদের” সহায়তা নিয়ে বন্দী ব্যক্তিদের এলাকার ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করি এবং পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলাসহ প্রকৃত নাগরিকত্ব সনদপত্র সংগ্রহ করতে থাকি।
ভারতে বাংলাদেশের মোট ৬টি দূতাবাস রয়েছে। প্রধান দূতাবাস নয়াদিল্লীতে। অপরগুলি কলকাতা, মুম্বাই, আগরতলা, গৌহাটি ও সর্বশেষটি চেন্নাইতে। গৌহাটিতে মার্চ ২০১৭ সালে হাই কমিশন কার্যালয় উদ্বোধন করা হয়। তখন সহকারী হাই কমিশনার ছিলেন জনাব কাজী মুনতাসির মুর্শেদ। দূতাবাসে কর্মরত ওয়াহিদুজ্জামান নামে একজন ষ্টাপের সাথে আমার একদিন ফোনে কথা হয়। আমি তাকে আমার পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে কথা বলি। তিনি আমাকে জানালেন তার ইমেইলে বন্দীদের তথ্য প্রেরণ করার জন্য। আমি শিলচর কারাগারের আমার প্রাথমিকভাবে সনাক্তকৃত ১০-১২ জন বন্দীর তথ্য প্রেরণ করলাম। অপরদিকে এব্যাপারে ভারতের লোকসভার তৎকালীন মাননীয় সদস্য মিস সুস্মিতা দেবের সহায়তা কামনা করলে তিনি বাংলাদেশি বন্দীদের মুক্তির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে পত্র প্রেরণ করেন।
শ্যাওলা-সুতারকান্দি বর্ডারে বন্দীদের স্বজনরা অপেক্ষা করছেন, সাথে আমি।
২০১৮ সালের জুন মাস নাগাদ আমার প্রেরিত তালিকার লোকজনের সাথে আরো কয়েকজনের ট্র্যাভেল পারমিট ইস্যু হয়ে যায়। প্রথমে ২০ জনের একটি বাংলাদেশি দলকে ভারতের কয়েকটি ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে সুতারকান্দি বর্ডার দিয়ে দেশে আনা হয়, আমি সেদিন উপস্থিত থেকে বন্দীশালা থেকে আগত লোকদের তাদের নিজ নিজ পরিবারের নিকট হস্তান্তর করে সহায়তা করি। সে এক অভাবনীয় মুহূর্ত। দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন থাকা স্বজনের সাথে মিলনের আনন্দ।
গৌহাটিতে বাংলাদেশ সহকারী হাই কমিশনের কার্যালয় প্রথমে গণেশগুরিতে ছিল। আগস্ট ২০১৮ মাসে দূতাবাসের ষ্টাপ ওয়াহিদুজ্জামান আমাকে জানালেন যে, গৌহাটির সহকারী হাই কমিশনার বদলী হয়ে চলে গেছেন। নতুন দূতাবাস প্রধান হিসেবে ড. শাহ মোহাম্মদ তানভীর মনসুর ০৮ আগস্ট, ২০১৮ তারিখে যোগদান করেছেন। তিনি আমাকে নতুন সহকারী হাই কমিশনারের সেল নম্বর দিয়ে বললেন স্যারের সাথে যোগাযোগ করলে বাংলাদেশি লোকদের দেশে নেওয়া সহজ হবে। ড. শাহ মোহাম্মদ তানভীর মনসুরের সাথে একদিন ফোনে কথা বলে পরিচয় হলো। তিনি আমার পরিচয় জেনে খুব খুশি হলেন। আমি এ সকল কাজ করছি জেনে আমাকে আরো উৎসাহিত করলেন। ইতোমধ্যে তিনি আসাম প্রদেশের কয়েকটি ডিটেনশন ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন এবং বাংলাদেশি নাগরিকদের আইডেন্টিফাই করার চেষ্টা করেছেন। অনেককে তিনি আইডেন্টিফাই করতে পারলেও প্রত্যেক ডিটেনশন ক্যাম্পে হাবাগোবা, মানসিক ভারসাম্যহীন অনেক বন্দীকেই আইডেন্টিফাই করতে না পেরে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। তখন শুধু আসাম প্রদেশের ৬টি ডিটেনশন ক্যাম্প কুকড়াঝাড়, গোয়ালপাড়া, শিলচর, তেজপুর, জোড়হাট ও ডুবরীতে প্রায় ১৫০/১৬০ জন মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলাদেশি নাগরিক বন্দী ছিলেন।
- আরও পড়ুন- বন্দী প্রত্যাবর্তন ও কিছু মানবিক উদ্যোগ
২০১৯ সালে আমি পরিকল্পনা করলাম সরকারি ছুটি নিয়ে ভারতের আসাম রাজ্যের গৌহাটিতে যাবো। লক্ষ্য তীর্থ ভ্রমণ, পাশাপাশি এই ডিটেনশন ক্যাম্পগুলি ভিজিট করা। সরকারি ছুটি মঞ্জুর হওয়ার পর বিষয়টি ড. তানভীর মনসুরকে অবহিত করি। তিনি আমার এই ভ্রমণের কথা শুনে খুব খুশি হলেন এবং আমাকে আন্তরিকভাবে আহবান জানালেন তাঁর অফিসে যাওয়ার জন্য। ইতোমধ্যে আমার সহযোগিতা নিয়ে তিনি ২১ জন বাংলাদেশিকে কারামুক্ত করে শ্যাওলা-সুতারকান্দি বর্ডার দিয়ে দেশে প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। ১৯ জানুয়ারি ২০১৯ খ্রি. তারিখে আমি বর্ডারে উপস্থিত থেকে তাদের পরিবার পরিজনের নিকট হস্তান্তর করি।
অমলেন্দু কুমার দাশ, সহকারী উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা এবং লেখক, লোকগবেষক ও সমাজকর্মী
- খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ