সৈয়দ তাওসিফ মোনাওয়ার
আপডেট: ২০:১৮, ৩০ নভেম্বর ২০২১
কখনো কি ফিরবে সড়কের শৃঙ্খলা?
সৈয়দ তাওসিফ মোনাওয়ার
সড়ক শুধু সড়ক নয়। এটি আমাদের সমাজের অনেকগুলো সমস্যার অনন্য এক প্রতিফলন। এতে যেমন ঘুষ-দুর্নীতি জড়িত, তেমনি জড়িত পরিকল্পনাগত ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা। যার অন্যতম কারণ, সদিচ্ছার অভাব। আর এর প্রতিটিও আমাদের রাজনীতি এবং গণপরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সিন্ডিকেটের ক্ষমতায় প্রভাবিত।
ঢাকার রামপুরায় আরও একজন স্কুলছাত্র বাসচাপায় মারা গেছে। দিনের পর দিন আন্দোলন-সংগ্রাম করলেও সড়কের শৃঙ্খলা কি আদৌ ফিরবে? শৃঙ্খলা 'ফেরা'র কথা বলছি, অথচ কখনো কি ছিল সেই শৃঙ্খলা?
খেয়াল করে দেখুন, আমাদের দেশে যেসকল সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে— তার অধিকাংশ ঘটে মহাসড়কে এবং ঢাকা শহরে। এর বাইরে মফস্বল শহর বা বিভাগীয় শহরগুলোর রাস্তায় আপনি বড় দুর্ঘটনা বা প্রাণহানির খবর কখনো শুনবেন না। মহাসড়কে দুর্ঘটনার প্রধান কারণ অনিয়ন্ত্রিত গতি, অদক্ষ চালক, ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেকিং এবং ফিটনেসহীন যানবাহন। এই কথাগুলো আমরা সকলেই জানি। পেশাদার চালকদের যেখানে একদিনে সর্বোচ্চ ৮ ঘণ্টা গাড়ি চালাবার কথা, সেই জায়গায় একজন চালক মাত্র তিন ঘণ্টা ঘুমিয়ে ষোলো-সতেরো ঘণ্টা গাড়ি চালান। রাজধানী শহরের বাস সার্ভিসগুলোর দিকে তাকালে দেখবেন, এদের চালকরা প্রশিক্ষিত নয়, অনেকে মাদকাসক্ত, বয়সে অপরিপক্ব এবং লাইন্সেন্সপ্রাপ্ত নয়।
আসুন লাইসেন্সের কথায়। বিআরটিএ নামক যে অথর্ব প্রতিষ্ঠানটি গাড়িচালকের লাইন্সেন্স ও যানবাহনের ফিটনেস সনদ প্রদানের কাজের নিয়োজিত, তার বড় অংশই চলছে ঘুষ-উপঢৌকনের মাধ্যমে। বছরের পর বছর ধরে যথাযথ যাচাই প্রক্রিয়া ছাড়াই যে কেউ লাইসেন্স পাচ্ছেন বাড়তি অর্থের বিনিময়ে। ফিটনেস প্রদানের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম, পূর্ব নির্ধারিত দালালের হাতেই সব দায়িত্ব। পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সঙ্গেও বিআরটিএ'র কোনো সমন্বয় নেই।
সড়কের দিকে তাকান। মহাসড়কগুলোর দুই প্রান্তে বা কিনারায় রিফ্লেক্টর নেই। দাগ টানা নেই। অনেক জায়গায় এবড়থেবড়ো। ডিভাইডার না থাকা বা লেন মানতে বাধ্য করার সুযোগও সব জায়গায় নেই। আবার মহাসড়কের উপর দিয়েই চলাচল করে ধীরগতির যান, যেমন রিকশা, সিএনজি, নসিমন-করিমন, ভটভটি ইত্যাদি। এদের কারণে বড় যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে আনা অনেকক্ষেত্রেই দুষ্কর হয়ে পরে। উপরিউক্ত সমস্যাগুলো তো আছেই।
আইনও যেন এক প্রহসন। রয়েছে নানা ফাঁকফোকর। হাইড্রলিক হর্ণ বা হুটার বাজানোর কথাই ধরুন। মাত্র ১০০ টাকা জরিমানা। বড় কোনো শাস্তি নেই। ফলে অনেকেই রাস্তায় জমিদার বনে যান।
ঢাকা শহরের সড়কের দিকে তাকান এবার। প্রতিবছর ক্রমেই বেড়ে চলেছে এই শহরের জনসংখ্যা। যার প্রতিফলন দেখবেন সড়কে। প্রতিদিন ভোর থেকে মধ্যরাত অবধি রাস্তায় গিজ গিজ করছে লাখো মানুষ, আছে অসংখ্য ব্যক্তিগত যানবাহন, ছোট যান এবং বাস। তিল ধারণের জায়গা কোথাও নেই। অথচ ঢাকা শহরের এই উপচে পড়া জনসংখ্যা এড়াতে বহু আগেই বিকেন্দ্রীকরণের পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন ছিল, যে ব্যাপারে ভাবেনি কেউ। যে সংখ্যক মানুষকে ঢাকা শহর ধারণ করতে পারে, সে সংখ্যাটির স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচলের জন্যও কখনো সুপরিকল্পিত গণপরিবহন ব্যবস্থা এখানে গড়ে ওঠেনি।
ঢাকার প্রধান সড়কগুলো উত্তর-দক্ষিণমুখী বা উলম্বভাবে সাজানো, আনুভূমিকভাবে কেবল তার শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত। এই উলম্ব সংযোগও বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্থ হয়েছে ভুল সিদ্ধান্তে। যেমন মহাখালীর সেতু ভবনের অংশটি। এছাড়া বছরের পর বছর ধরে ঢাকার খালগুলো ভরাট হয়েছে, ফলে এখানে সড়কের বিকল্প গণপরিবহন ব্যবস্থা হিসেবে ওয়াটার ট্র্যান্সপোর্ট তৈরির সুযোগটিও রুদ্ধ হয়েছে। বাস সার্ভিস নামক যে বাসগুলো চালু আছে তার কোনোটি একটা সভ্য দেশের নূন্যতম মানদণ্ডে পড়ে কিনা আমার জানা নেই। মুড়ির টিনের মত বিবর্ণ একেকটি বাস, ছাড়ছে কালো ধোঁয়া, নির্ধারিত স্টপেজ নেই, থামে যত্রতত্র, যাত্রীদের উঠতে হয় ছোটখাটো দৌড় প্রতিযোগিতার মাধ্যমে; নামতে হয় গলাধাক্কা খেয়ে। এই বাস সার্ভিসের সংস্কার বা রুটভিত্তিক শৃঙ্খলা আর নিয়মানুবর্তীতাও কখনো তৈরি হয়নি।
যেহেতু গণপরিবহনে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচলের সুযোগ নেই, উপরন্তু মানিব্যাগ-মোবাইল ছিনতাইয়ের আশঙ্কা এবং মহিলাদের যৌন হয়রানির শিকার হবার বিষয়গুলো প্রায়শই ঘটে চলেছে; তাই একটু সামর্থ্য হলেই মধ্যবিত্তরা ব্যক্তিগত গাড়ি কেনেন। ঢাকা শহরের মোট সড়কের ৫ শতাংশ গণপরিবহন বা বড় যানবাহন ধারণের উপযোগী, সেই পাঁচ শতাংশের ৭০ শতাংশ দখল করে থাকে প্রাইভেট কার। বাকি অংশে ফুটপাতের দোকানদার, রিকশা, সিএনজি এবং অন্যান্য যান, সঙ্গে অপর্যাপ্ত কিছু পাবলিক বাস। এই সড়ক নিয়ন্ত্রণের জন্য নেই কোনো সিগনাল বাতি, নেই কার্যকর জেব্রা ক্রসিং, নেই লেন মানার নিয়ম। ডিজিটাল বাংলাদেশের ট্রাফিক পুলিশের পুরো ব্যবস্থাপনাই এখনো দড়ি এবং লাঠিনির্ভর। যেহেতু প্রয়োজনীয় অবকাঠামোই কখনো সাজানো হয়নি, তাই ট্রাফিক পুলিশের করণীয় খুবই সীমিত। এদিকে তিন বা চারলেনের রাস্তায় ঘেষে চলে ছয়-সাতটি গাড়ি। লেন পরিবর্তনের জন্য ইনডিকেটর দেয়া বা অন্যান্য নিয়ম মানার কথা না হয় বাদ-ই দিলাম।
প্রচণ্ড ভীড়ের এই শহরে প্রতিনিয়ত ছুটতে ছুটতে নাভিশ্বাস ওঠে মানুষের। রাস্তা পারাপারে তারা ফুটওভার ব্রিজে উঠতে চান না। বেশিরভাগ জায়গায় নেইও সেই ফুটওভার ব্রিজ। কার্যকর জেব্রা ক্রসিং এবং সিগনাল না থাকায় সড়কের যেকোনো এক অংশ দিয়েই তারা দৌড়ে পার হন। ওদিকে দীর্ঘক্ষণ জ্যামে আটকে থাকা বাসটি সুযোগ পেলেই বিমানের গতিতে চলার চেষ্টা করে, তার চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারান রাস্তা পার হতে যাওয়া পথচারী। এই বিমান চলার প্রতিযোগিতায় দুই বাসের মাঝে চাপা পড়েন কেউ। কারোর হাত খুলে পরে থাকে রাস্তায়। ভাড়া নিয়ে বাকবিতণ্ডা হলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়ার নজির তো আছেই।
সড়ক শুধু সড়ক নয়। এটি আমাদের সমাজের অনেকগুলো সমস্যার অনন্য এক প্রতিফলন। এতে যেমন ঘুষ-দুর্নীতি জড়িত, তেমনি জড়িত পরিকল্পনাগত ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা। যার অন্যতম কারণ, সদিচ্ছার অভাব। আর এর প্রতিটিও আমাদের রাজনীতি এবং গণপরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সিন্ডিকেটের ক্ষমতায় প্রভাবিত।
এর সমাধান কী হতে পারত? প্রথমত, সড়কে নিয়ন্ত্রিত ট্রাফিক ব্যবস্থা—যেখানে প্রত্যেককে লেন মানতে হবে, ড্রাইভিংয়ের সকল আদবকেতা মেনে গাড়ি চালাতে হবে। তার আগে চালক প্রশিক্ষিত কিনা, লাইসেন্স পাবার যোগ্য কিনা, সেটি সুচারুভাবে নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিআরটিএ'র। যে স্মার্ট লাইসেন্সটি তৈরি করা হয়েছে তাতে পয়েন্ট কাটার ব্যবস্থা থাকতে হবে। ট্রাফিক পুলিশ যখন একজন চালকে আটক করবে, সেখানে স্মার্ট ডিভাইসের মাধ্যমে লাইসেন্সের পয়েন্ট কাটা হবে, পর্যায়ক্রমে তা বাতিল হবে। লাইসেন্স বাতিল হওয়া বা নিষিদ্ধ হওয়া চালক কখনো গাড়ি চালাতে পারবে না। স্মার্ট টিকেটিং বা র্যাপিড পাসের মাধ্যমে ভাড়াসংক্রান্ত জটিলতাও এড়াতে হবে।
উন্নত বিশ্বে এসব ব্যবস্থা বহু আগে থেকেই চলে আসছে। চাইলেই যেকোনো একটি মডেল অনুসরণ করা সম্ভব। অন্যদিকে গণপরিবহনের মান উন্নয়ন করতে হবে, মানুষকে প্রাইভেট কার কেনার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করে সড়কের চাপ কমাতে হবে; যাতে যানজট কমে। সব সড়কে স্পিড ক্যামেরা বসাতে হবে, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে যানবাহনের রেট্রো-রিফ্লেক্টিভ নম্বরপ্লেট শনাক্ত করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। সব চালক ও তার দ্বারা চালিত যানের ডাটাবেজ তৈরি করে তা ট্রাফিক পুলিশের ফলোআপের ব্যবস্থা রাখতে হবে। বিশ্বের বহু শহর এখন কার্বন নিঃসরণ কমাতে চেষ্টা করছে। জোর দেয়া হচ্ছে বাইসাইকেল ব্যবহারে। আমাদের মন্ত্রী-সচিবরা যেদিন গণপরিবহন চড়বেন অথবা বাইসাইকেলে করে অফিসে যাবেন, সেদিন সাধারণ মানুষের মাঝে গাড়ি চড়ার প্রবণতা কমে আসবে, সড়কে কমবে গাড়ির দৌরাত্ম্য। সর্বোপরি, আমাদের মানবিকতার বিকাশ ছাড়া কোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব ন।।
এ সকল ভাবনা আসলে স্বপ্ন। অথচ বাস্তবে প্রতিদিন এক অদ্ভুত অমানবিক সড়কে আমরা চলাচল করছি। প্রাণ হাতে নিয়ে ঘর থেকে বের হচ্ছি। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে গেলে যে সমন্বিত উদ্যোগ ও পরিকল্পনা নেয়া জরুরি, সেটি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করার মত কোনো সংস্থা বা দপ্তর বাংলাদেশে কখনো তৈরি হয়নি। কখনো হবে কিনা কারোর জানা নেই। মাঝে মাঝে হয়তো আমরা ফাটাকেষ্টদের রোড শো দেখব, হয়তো কখনো আনিসুল হকের মত মেয়ররা এসে ঢাকাকে বদলাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাবেন; কিন্তু প্রকৃতির কিছু অমোঘ বিধানের কারণে তা আবার থমকে যাবে। ফল হিসেবে, সড়কে পাখির মত মানুষ মরবে, এবং এই ভাগ্যকেই বরণ করে নিতে হবে আমাদের। কখনো আমরা হতাহতের স্বজনের ভূমিকায় থাকব, কখনো আন্দোলনে অংশ নেব, কখনোবা রাস্তায় পড়ে থাকব লাশ হয়ে।
সৈয়দ তাওসিফ মোনাওয়ার, সাংবাদিক
- খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
দেখুন আইনিউজের ভিডিও খবর
হাতির আক্রমণে হাতি হত্যা মামলার আসামির মৃত্যু
ওমিক্রন এক চেনা উদ্বেগ, করোনাভাইরাসের `ভয়াবহ` ভ্যারিয়েন্ট
লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত খালেদা জিয়া, দেশে চিকিৎসা নেই
নির্বাচন এখন কবরে : রুমিন ফারহানা
কোথায় কত বাড়লো বাস ভাড়া
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ