নাসির উদ্দিন
কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে প্রয়োজন সামাজিক গণসচেতনতা
যেসব কাজ প্রাপ্ত বয়স্কদের দ্বারা সংঘটিত হলে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়, প্রচলিত আইন ভঙ্গকারী ওই ধরনের কাজ অপ্রাপ্ত বয়স্ক বা কিশোরদের দ্বারা সংঘটিত হলে সেটিকে কিশোর অপরাধ বলা হয়।
কিশোর বয়সের চাহিদা হলো- নিজেকে প্রকাশ করা। আত্মপ্রকাশের চাহিদা তাদের মাঝে কৌতূহলপ্রিয় করে তুলে। কৌতূহলের বশে নতুন কিছু জানতে চায়, শিখতে চায়। এ স্বতঃস্ফূর্ত আকাঙ্খাকে যদি মাতা-পিতা, শিক্ষক, অভিভাবক সঠিক পথে পরিচালনা করতে পারেন তবে এ ছেলেমেয়েরা ভবিষ্যৎ জীবনে, কর্মক্ষেত্রে, সমাজে সফল মানুষ হয়।
এ ছাড়া কিশোরদের অপরাধী হওয়ার নেপথ্যে আরও কিছু স্বভাবগত কারণ রয়েছে যেমন- মাতা পিতার অযত্ন-অবহেলা, উদাসীনতা, স্নেহীনতা, সন্তানকে প্রয়োজনীয় ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাদানে অমনোযোগিতা, পারিবারিক পরিমণ্ডলের ঝগড়া-বিবাদ, দারিদ্র্য, সুষ্ঠু বিনোদনের সঙ্কট, সামাজিক অসাম্য, দুঃখ দুর্দশা, যথাযথ তদারকির ঘাটতি, অবিচার, অশৈশব দুর্ব্যবহার প্রাপ্তি, কুসংস্কার ও কুসঙ্গ, অতি আদর, আর্থিক প্রাচুর্য ও অনিদ্রার মতো বিষয়গুলো কিশোরদের অপরাধী করে তোলে।
কিশোর অপরাধী হলো সেই সকল কিশোর-কিশোরী যারা সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় সামাজিক রীতিনীতি ও প্রথা অনুকরণ করতে না শিখে সমাজবিরোধী চিন্তা ও কাজে অংশ নেয়। বয়সের দিক থেকে সাধারণ ৭ থেকে ১৬ বছর বয়সি কিশোর কিশোরী দ্বারা সংঘটিত অপরাধই কিশোর অপরাধ। বাংলাদেশে ১৮ বছরের কেউ অপরাধ করলে কিশোর অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে। কিশোর অপরাধীদের আচরণ ও কাজকে কম অপরাধমূলক ভাবা হয় ও অপরাধের কারণকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
কিশোর অপরাধের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, মা-বাবার সঠিক নজরদারির অভাবে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণহীন জীবনযাপনের ফলে ছেলেমেয়েরা বখে যাচ্ছে। ফলে ছোটো ছোটো ভুলভ্রান্তি এবং অপরাধ করতে করতে পরবর্তীতে তারা বড়ো অপরাধ করে বসছে। আবার বন্ধুবান্ধবের সাথে চলতে চলতে মজার ছলে কিছু একটা করে বসে যা পরবর্তীতে বিরাট আকার ধারণ করে। এই সমস্ত ছোটো ছোটো অপরাধ যদি শুরুতে সাবধান করা যেত তাহলে অপরাধের মাত্রা অনেকাংশে কমে আসত। সামাজিক সমস্যা হিসেবে এবং অপরাধ জগতে কিশোর অপরাধ ক্রমবর্ধমানশীল। গ্রাম অপেক্ষা শহরে কিশোর অপরাধের ব্যাপকতা ও গভীরতা বেশি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তথ্য অনুযায়ী করোনা পরিস্থিতিতেও ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসে সারাদেশে কিশোর গ্যাংদের হাতে ৮ জন হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে। সর্বশেষ নারায়নগঞ্জ ও গাজীপুরের ঘটনা তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ঢাকা শহরের ১০টি থানায় ৩২টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় আছে এবং ৫০০-৫৫০ জন সক্রিয় সদস্য ঢাকা শহরে নানারকম অপরাধ সংগঠিত করছে। তাদের মধ্যে উত্তরায় আদনান হত্যা, দক্ষিনখানে মেহেদী হত্যা এবং শেওড়াপাড়ায় সজিব হত্যা বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। চুরি-ছিনতাই বা ঘর পালানোর মতো অপরাধ পেছনে ফেলে কিশোরদের খুন ও ধর্ষণের মতো ভয়ংকর অপরাধে জড়ানোর প্রবণতা বাড়ছে। দেশের দুটি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী সেখানে থাকা কিশোরদের ২০ শতাংশ খুনের মামলার আর ২৪ শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলাগুলোর বেশির ভাগই ধর্ষণের অভিযোগে করা। কিশোর অপরাধের ধরন পাল্টাচ্ছে। বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে আসা এসব কিশোরের মধ্যে দরিদ্র পরিবারের সন্তান যেমন আছে, তেমনি আছে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানও। বিভিন্ন গবেষণায় এসেছে, ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সিরা অপরাধে বেশি জড়াচ্ছে।
আমাদের দেশে শিশুদের জন্য পৃথক বিচারব্যবস্থার সূচনা ১৯৭৪ সাল থেকে। ১৯৭৪ সালের শিশু আইন ও ১৯৭৬ সালের শিশুনীতিই আমাদের প্রথম আইন ও বিধি। এরপর থেকে বিভিন্ন আইনে শিশুদের কথা বলা আছে। কিন্তু শিশুদের জন্য পূর্ণাঙ্গ আইন ১৯৭৪ সালের আইনটিই। এটি ২০১৩ সালে সংশোধিত হয়ে আরও পূর্ণাঙ্গরূপ ধারণ করে। বাংলাদেশ মূলত ১৯৮৯ সালের শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষর করার মাধ্যমে শিশু বা কিশোর অপরাধ ও বিচারব্যবস্থার ওপর জোর দেয়। বাংলাদেশের ২০১৩ সালের শিশু আইন অনুযায়ী, ৯ থেকে অনূর্ধ্ব ১৮ বছরের কোনো ছেলেশিশু অপরাধে জড়ালে তাদের গাজীপুরের টঙ্গী ও যশোরের পুলেরহাটের কিশোর (বালক) উন্নয়ন কেন্দ্রে রাখা হয়।
সমাজসেবা অধিদফতরের প্রতিষ্ঠান শিশু (কিশোর/কিশোরী) উন্নয়ন কেন্দ্রসমূহ পরিচালনা করে। পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) এর নেতৃত্বে অতিরিক্ত পরিচালক, উপপরিচালক, সহকারী পরিচালক সদর দপ্তর পর্যায়ে এবং মাঠপর্যায়ে ৩ জন তত্ত্বাবধায়ক শিশু (কিশোর/ কিশোরী) উন্নয়ন কেন্দ্র পরিচালনার সাথে সংশ্লিষ্ট। জেলা পর্যায়ের ৩ জন উপপরিচালক ও সহকারী পরিচালক মাঠ পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান তদারকি এবং মাঠ পর্যায় ও সদর দপ্তরের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে থাকেন। মাঠ পর্যায়ে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে একটি ব্যবস্থাপনা কমিটি শিশু (কিশোর/ কিশোরী) উন্নয়ন কেন্দ্র পরিচালনা কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্ট শিশু (কিশোর/কিশোরী) উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক উক্ত কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে কাজ করেন। বাংলাদেশের গাজীপুরের টংগীতে বালকদের জন্য ৩০০ আসনের জাতীয় কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র, কোনাবাড়ীতে বালিকাদের জন্য ১৫০ আসনের জাতীয় কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্র এবং যশোরের পুলেরহাটে বালকদের জন্য আরও ১৫০ আসনের কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র আছে।
কিশোর অপরাধ দমনে সরকার বেশ কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়েছে। অপরাধের ধরন বিবেচনায় বিভিন্ন নিয়ন্ত্রনকারী সেল গঠন করা হয়েছে। যেন অতি দ্রুত প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়া যায়। এছাড়া বিভিন্ন গণমাধ্যমে অপরাধের শাস্তি এবং প্রতিকারে কী করণীয় তা প্রচারের।
(২)
ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের গণযোগাযোগ অধিদপ্তর ভ্রাম্যমান যানবাহনে নৈতিকতার শিক্ষা প্রচার করা যেতে পারে। এছাড়া স্কুল কলেজের সামনে বিভিন্ন বিলবোর্ডের মাধ্যমেও তা প্রচার করা যেতে পারে।
আমাদের বর্তমান সমাজে পাঠাগার, বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কার্যক্রম কমে গেছে এবং তাকে দখল করে নিয়েছে মোবাইল ফোন ও আধুনিক প্রযুক্তি। ফলে বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকান্ড বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই আমাদের সমাজব্যবস্থায় বিভিন্ন সৃজনশীল ও সাংস্কৃতিক আয়োজন বাড়াতে হবে। কিশোর কিশোরীদের সামাজিকীকরণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকার কারণে কিশোর অপরাধ রোধ করার দায়বদ্ধতার একটি বড়ো অংশ স্কুলব্যবস্থার উপর পড়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা দরকার যা বিদ্যালয়গুলোকে কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে আরও কার্যকর ভূমিকা পালনে সহায়ক হবে।
- আরও পড়ুন- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেট, পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন মোবাইল, ফেসবুক, টুইটার, ব্লগ, ইউটিউবের ন্যায় গণমাধ্যমগুলো শিশু কিশোরদের দারুণভাবে প্রভাবিত করে। তাই উক্ত গণমাধ্যমগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অভিভাবকরা যথেষ্ট সচেতন না হলে কোমলমতি শিশু কিশোররা অপরাধে লিপ্ত হতে পারে। বিশেষ করে কুরুচিপূর্ণ যৌন আবেগে ভরপুর ম্যাগাজিন ও পত্রিকা কিশোর কিশোরীদের মনমানসিকতার ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তাই সন্তানের অবসর সময় কিভাবে কাটছে তা অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে। তবেই কিশোর অপরধের মাত্রা অনেকাংশে কমে যাবে।
নাসির উদ্দিন, সহকারী তথ্য কর্মকর্তা, তথ্য অধিদপ্তর।
- খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ