মিহিরকান্তি চৌধুরী
আপডেট: ২০:২২, ৯ ডিসেম্বর ২০২১
শ্রদ্ধা ও স্মরণ : সিএম তোফায়েল সামি
প্রয়াত সিএম তোফায়েল সামি
সিএম তোফায়েল সামির মতো একজন রুচিশীল ব্যক্তি সচরাচর দেখা যায় না। কথাবার্তায়, বোধে, ভাবনায়, বেশভূষায় ছিলেন অনন্য। তাঁর বয়েসি যুবকের সংখ্যা সমাজে নিতান্তই কম। সব বিষয়ে ছিলেন চোস্ত, দুরস্ত। এক কথায় অনুসরণীয়, অনুকরণীয়।
বিগত কয়েকদিন ধরে ব্যস্ত ছিলাম বলে ফেসবুকে বেশি আসতে পারিনি। বিগত সোমবার ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ফেসবুক খুলে হতভম্ব হয়ে যাই। জানতে পারি, আমার ও আরও অনেকের পরম শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব জনাব সিএম তোফায়েল সামি বেলা দুইটার দিকে রাজধানী ঢাকার একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পুরো রাতটা ভালো কাটেনি। কাটার কথাও নয়।
সিএম তোফায়েল সামি ছিলেন আমাদের অত্যন্ত প্রিয়জন। তাঁর মৃত্যুতে সিলেট অঞ্চল তথা সারা দেশ এক যোগ্য সন্তানকে হারালো। এই শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
জানা যায়, সিএম তোফায়েল সামি ৬ ডিসেম্বর সোমবার সকালে রাজধানীতে একটি সেমিনারে যোগ দেন। সেখানে যাওয়ার পথে গাড়িতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেমিনারে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে স্পেলাজাইড হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেই তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
জনাব সিএম তোফায়েল সামির বাবা প্রয়াত আবদুস সামি চৌধুরী জেলা জজ ছিলেন। বাবার চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জেলা সদরে, সাব জজ থাকাকালীন মহকুমা সদরে থাকার সুযোগ হয়েছিল। ওইসব জায়গার স্কুলকলেজে পড়েছেন, ওইসব জায়গার লোকজনের সাথে মিশেছেন, ওইসব স্কূল কলেজের সহপাঠীদের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে। নানা প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষক তাঁর প্রতি সহমর্মী, সহানিুভূতিশীল ও সদাশয় ছিলেন যাঁরা তাঁর ব্যক্তিত্বের নির্মাণে প্রভূত ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর লেখালেখিতে স্কুলকলেজ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত তাঁর সকল সহপাঠী বন্ধু ও শিক্ষকদের গুণ ও জ্ঞানের কথা, সহযোগিতার গল্প, পড়াশোনায় উচ্চ মানের গল্প সবই তরতাজা, টাটকা ছিল তাঁর স্মৃতিপটে। তাঁর ক্ষুরধার লেখায় সেগুলো উঠে আসত। ভালো লিখতেন, যেমন বাংলা তেমন ইংরেজি। বইপুস্তক পড়তেন। সিরিয়াস পাঠক যাকে বলে। অনেক বইয়ের নাম জেনেছি তাঁর কাছ থেকে। আবার অনেক বইয়ের সারকথাও জানিয়েছেন। ফেসবুকে নিয়মিত লিখতেন। তাঁর আত্মস্মৃতি উৎস প্রকাশন থেকে বের হওয়ার কথা।
সিএম তোফায়েল সামি ব্যাংকার ছিলেন। পেশাগত জীবনে দিয়েছেন দক্ষতার পরিচয়। সেই পাকিস্তান আমলেই ব্যাংকের চাকরিতে যশ কামিয়েছিলেন। ছিলেন জালালাবাদ এসোসিয়েশনের সভাপতি। জালালাবাদ এসোসিয়েশনের অনেক প্রকল্প তাঁর হাত ধরে এগিয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানে ও এর বাইরে অনেক প্লাটফর্ম থেকে সমাজ সেবা করেছেন। সমাজসেবক হিসেবে তিনি সাধারণ মানুষের কল্যাণে কাজ করে মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেছেন। তাঁর সামাজিক দায়িত্ব পালনের মানুষ দীর্ঘদিন স্মরণ রাখবে।
সিএম তোফায়েল সামির গ্রামের বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার লাউতা ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামে। আমাদের প্রায় একই এলাকা। আমাদের বাড়ি শাহবাজপুরের শ্রীধরপুরে। আগের প্রজন্মে আমাদের বাড়ির সাথে বাহাদুরপুরের জনাব সামির পরিবার ও অন্য পরিবারের সাথে আসাযাওয়া ছিল, যোগাযোগ ছিল। আমাদের এলাকার ভূগা গ্রামের চৌধুরী ও আমাদের শ্রীধরপুরের প্রয়াত বিচারপতি বদরুল ইসলাম চৌধুরীর পরিবারের সাথে তাঁদের আত্মীয়তা ছিল। তাঁর পরিবার কয়েক দশক থেকে পরিবার নিয়ে ঢাকায় বসবাস করে আসছিলেন।
সিএম তোফায়েল সামিরা চার ভাই ও এক বোন। মান্যবর সিএম শফি সামি ছিলেন রাষ্ট্রদূত, সচিব ও ২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, বর্তমানে এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান। সিএম শফি সামি স্যারের সাথে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা ২০০৩ সালে। ওই বছর আমার পরিচালিত প্রতিষ্ঠান একাডেমি অব টু আরস থেকে সিলেটের দশজন গুণির সাথে যুগপৎ সংবর্ধিত হয়েছিলেন। এই উপলক্ষে সিএম তোফায়েল সামি মহোদয়ের সাথেও আমার পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা ও পরবর্তীকালে ফেসবুক ফ্রেন্ড। মান্যবর সিএম শফি সামিকে স্যার সম্বোধন করি বলে তাঁর বড়ো ভাই সিএম তোফায়েল সামি মহোদয়কে স্যার ডাকতাম। স্যারের বড়ো ভাই তো অটোমেটেড স্যার। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সূত্র সর্বত্রই বিরাজমান। তাছাড়া আমার চেয়ে আঠারো ঊনিশ বছরের বড়ো যা রবীন্দ্রনাথ বা তাঁর বাবার আমলের বাবার বয়স। আমরা একজন ব্যক্তিকে সেই বিবেচনায়ও সম্মান করতে পারি।
তাঁর ভাই খ্যাতিমান ব্যাংকার জনাব সিএম কয়েস সামিকে চিনি তবে তাঁর আরেক ভাই জনাব সিএম হায়াত সামি ও বোন মিসেস ফৌজিয়া সামির অনেক গল্প তাঁর কাছ থেখে শুনলেও তাঁদের সাথে আমার পরিচয় ঘটেনি। সিএম তোফায়েল সামি আমাকে ছোটো ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন। আমিও তাঁকে নিজের বড়ো ভাই ও স্যারের (সিএম শফি সামি স্যার) বড়ো ভাইয়ের ব্লেন্ডেড মর্যাদা দিতাম। তিনি আমাদের সেজ দাদার সম বয়েসি ছিলেন । সেটাও একটা বিয়য় ছিল। প্রায় তিন সপ্তাহ আগে আমরা তিনি ও আমি বিশ্ব সিলেট সম্মেলনের এক অনলাইন সেমিনারে আলোচক ছিলাম। সেমিনারের আগের দিন কথা হয়েছে ফোনে। অনুষ্ঠানের পর আমাকে মেসেজ দিয়েছেণ, ‘থ্যাংকস্ মিহির, ইউ কভারড এভরিথিং’। এর পর আর কথা বলা বা মেসেজ আদান প্রদান হয়নি। সে সুযোগও দিলেন না, চলে গেলেন।
সিএম তোফায়েল সামির পুরো পরিবার অত্যন্ত অসাম্প্রদায়িক। কয়েক পুরুষ আগে তাঁরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী পালবংশীয় ছিলেন। বিয়ানীবাজার এলাকায় পালদের এক সময় ঠাটবাট, খ্যাতি, ঐশ্বর্য সবই ছিল। কালের গতিতে অনেক জল গড়ালেও শিক্ষাদীক্ষা, আধুনিকতাসহ সার্বিক যোগ্যতার মানদণ্ডে তাঁরা আগের দিনের সমসাময়িক জমিদার, মিরাসদারদের চেয়ে এগিয়ে আছেন। তাঁদের পূর্বপুরুষ ইসলামকে ভালোবেসে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। এই উপমহাদেশে এটাই ধর্মান্তরের সবচেয়ে প্রশস্ত কারণ। ধর্মান্তরের বাকি তিনটি ক্যাটাগরির মধ্যে রয়েছে : (১) ব্রাহ্মণ্যবাদের নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেতে, (২) বৈষয়িক প্রলোভনে ও (৩) মুসলমান মেয়েকে বিয়ে করার জন্য। তাত্ত্বিকভাবে শক্তিশালী কারণটি তাঁদের সাথে ছিল।
সিএম তোফায়েল সামির মতো একজন রুচিশীল ব্যক্তি সচরাচর দেখা যায় না। কথাবার্তায়, বোধে, ভাবনায়, বেশভূষায় ছিলেন অনন্য। তাঁর বয়েসি যুবকের সংখ্যা সমাজে নিতান্তই কম। সব বিষয়ে ছিলেন চোস্ত, দুরস্ত। এক কথায় অনুসরণীয়, অনুকরণীয়।
মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে ও দুই মেয়ে, ভাই-বোন, নাতি-নাতনিসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন, শুভাকাঙ্খী রেখে গেছেন।
স্যার, আপনি যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন।
মিহিরকান্তি চৌধুরী, লেখক, অনুবাদক ও নির্বাহী প্রধান, টেগোর সেন্টার, সিলেট।
- খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
দেখুন আইনিউজের ভিডিও সংবাদ
মৌলভীবাজারের বিস্ময় বালিকা : ১৯৫ দেশের রাজধানীর নাম বলতে পারে
মৌলভীবাজারের সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী ভারত সরকারের পদ্মভূষণ পদকে ভূষিত
প্রকৃতির সন্তান খাসি - খাসিয়া জনগোষ্ঠী
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ