শাওন মাহমুদ
আপডেট: ১৮:৪৩, ২৭ জানুয়ারি ২০২২
আলতাফ মাহমুদের শেষ কয়েক ঘণ্টা
আলতাফ মাহমুদের নিজ হাতে লিখা চিঠি
মুখ খোলাবার জন্য আলতাফকে কয়েক ঘণ্টা পর পর টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এক সময় অধৈর্য হয়ে পাকিস্তানি সেনারা তার পা ফ্যানের রডে বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে বেধড়ক পেটায়। আর তখনই হাঁটু, কনুই আর পাঁজর ভাঙে আলতাফের। গরম পানি দিয়ে ঝলসে দিয়েছিল শরীরের বেশির ভাগ অংশ। ফোঁসকা পড়েছিল গায়ে।
ছেলেবেলা থেকেই আমার অদ্ভুত সব প্রশ্ন জাগতো বাবাকে নিয়ে। বাবাকে খুঁজে বেড়ানোর নেশা তখনও ছিল প্রকট। পরিবারের সবাই বাবার জন্য আমার করা প্রশ্নগুলোর উত্তর ধোঁয়াশায় ঢাকা থাকতো। তখনও বুঝতাম না সত্যি সত্যি তারাও জানেন না আলতাফ মাহমুদ কোথায়! তার মৃত্যু হয়েছিল কবে! তার কবর হয়েছিল কিনা!
আমার এসব প্রশ্নগুলোর উত্তর তারা অদ্ভুত অদ্ভুত উপায়ে দিতেন। নানি, মামা, খালা আর মায়ের কাছ থেকে সেসব উত্তর পেতাম। তারা নিজেদের মনকে বুঝ দিয়ে আমাকে বোঝাতেন। বাবার সঙ্গে ধরা পরেছিল আমার চার মামা। তারা দুইদিন পর ছাড়া পেয়েছিল বাবার কারণেই। বাবা কোথাও গিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের বিশ্বাস করাতে পেরেছিলেন যে, এই তরুণ চারজনা একেবারে কিছুই জানে না। পড়াশোনা করে। ক্র্যাক প্লাটুনের সব ধরনের অপারেশন শুধু বাবাই জানতেন এবং সাহায্য করতেন। চারজনের কোন সম্পৃক্ততা ছিল না কোন কিছুতে।
- আরও পড়ুন - ‘চাষাভুষা’, চাষাভুষার সন্তান
বাবার শেষ কয়েক ঘণ্টা তাদের মুখ থেকেই শুনেছি। পাকিস্তানি সেনাদের কাছে বন্দি রয়ে যাওয়া বাবাকে শেষ অবস্থায় তারাই দেখে এসেছিল। শেষ সময়ের কথাগুলো আমি বড় হওয়ার পর বলেছে। ঠিক বলেওনি, আমার প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে বলতে বাধ্য হয়েছে। তারপরও পাকিস্তানিদের নির্মম অত্যাচারের সম্পূর্ণ বর্ণনা তারা আমাকে এখনও বলেনি।
২৯ আগস্ট, ১৯৭১। উদ্ভ্রান্ত, উসখুস, অশান্ত সারাদিন। ক্র্যাক প্লাটুনের অনেক গেরিলা যোদ্ধা আজ ধরা পড়েছে। উঠোনে মাটিচাপা দেয়া অস্ত্রভর্তি ট্রাঙ্কগুলো নিয়ে সবচেয়ে বড় চিন্তা। আগামী অপারেশনে অস্ত্রগুলো কাজে লাগাতে হবে। বাসায় যদি আর্মি রেইড করে তাহলে এগুলোর কী হবে?
- আরও পড়ুন - আমার প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়টি ভালো নেই
সারাদিন কালো মরিস গাড়ি করে কোথায় কোথায় ঘুরেছিল সে, কে জানে! হয়তো বা অস্ত্র রাখবার জন্য নিরাপদ কোন জায়গা খুঁজেছিল। সারাদিন পর রাত ১১টায় বাড়ি ফিরে আসার পর মা বলেছিল, ভাত দেবো? ভাতপ্রিয় আলতাফের খিদে ছিল না, একদম না। তাই জবাবে বলেছিল, পেট ভরা, খাব না। শোবার ঘরে শাওন আর ঝিনু ঘুমিয়ে পড়েছিল। সন্তর্পণে সেই ঘরে ঢুকে কি করেছিল আলতাফ? কেউ জানে না। হয়তো বা নির্ঘুম চোখে সারারাত পরিবারের সবাইকে পাহারা দিচ্ছিল, কে জানে!
আজান দেয়ার পর ৩০ আগস্ট ভোরবেলার কথা সবার জানা। ঘর ছেড়ে যাওয়ার আগে কখনো ভাবেনি সে, এ জীবনে আর ঘরে ফেরা হবে না। একসঙ্গে ভাত খাওয়া হবে না। কখনো না। ৩৭০ আউটার সার্কুলার রোড থেকে সোজা নাখালপাড়া এমপি হোস্টেল-টর্চার সেল থেকে ইন্টারোগেশন চেম্বার। ক্ষতবিক্ষত আলতাফ পানি চেয়েছিল, তার মুখে পেশাব করেছিল পাকিস্তানি সেনারা। অত্যাচারের পালা শেষ হলে ছোট বাথরুমটায় গাদাগাদি করে ঢুকিয়ে দিতো অনেকের সঙ্গে। একটা পানির কল ছিল, শক্তি ছিল না সেটা ছেড়ে পানি খাওয়ার মতো। সঙ্গের সাথীরা একজন অন্যজনের জন্য সাধ্যমতো করত। আজলা ভরে পানি খাইয়েছিল তাদেরই কেউ। রাত ১০টার পর সবাইকে ট্রাকে করে রমনা থানায় পাঠানো হয়। সেখানে সাধারণ কয়েদিরা তাদের ভাগের শুকনো রুটি আর ডাল খেতে দিয়েছিল সে রাতে। সেদিন আর আলতাফের খাওয়া হয়নি, ব্যথায় কোঁকাতে কোঁকাতে জ্বরের ঘোরে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। পরের দিন আবার সকাল ১০টায় এমপি হোস্টেল-টর্চার সেল থেকে ইন্টারোগেশন চেম্বার। মুখ খোলাবার জন্য আলতাফকে কয়েক ঘণ্টা পর পর টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এক সময় অধৈর্য হয়ে পাকিস্তানি সেনারা তার পা ফ্যানের রডে বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে বেধড়ক পেটায়। আর তখনই হাঁটু, কনুই আর পাঁজর ভাঙে আলতাফের। গরম পানি দিয়ে ঝলসে দিয়েছিল শরীরের বেশির ভাগ অংশ। ফোঁসকা পড়েছিল গায়ে।
একটা নাম, শুধু একটা নাম চেয়েছিল ওরা। একেবারেই বেঁকে বসা দীর্ঘদেহী সুঠাম শরীরের আলতাফ মুখ খোলেনি, শেষ পর্যন্ত না। এভাবেই রাত হয়, ১০টায় আবার রমনা থানায় পাঠাবার আগ মুহূর্তে পাকিস্তানি সেনারা ঠিক করে ফেলেছিল কাকে ছাড়বে আর কাকে নয়।
রমনায় বেশ রাতে এক আর্দালি ভাত আর পেঁপে ভাজি খেতে দিয়েছিল কি মনে করে কে জানে। সবাই মিলে ভাগ করে খাবার আগে রক্তাক্ত আলতাফ খোঁড়াতে খোঁড়াতে দেয়াল ধরে হেঁটে হেঁটে গরাদের কাছে গিয়ে ওই আর্দালিকে বলেছিল, একটা কাঁচামরিচ হবে? আর্দালি এনে দিয়েছিল একটা মরিচ।
আমি চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই দীর্ঘদেহী আলতাফ নুয়ে পড়ে টিনের থালায় ভাত আর পেঁপে ভাজিতে কাঁচামরিচ মাখিয়ে লোকমা তুলে তৃপ্তি করে খাচ্ছে। কপালের চামড়া বেয়োনেটের আঘাতে ঝুলে আছে, প্রচণ্ড জ্বরের ঘোরে খোলা মুখের সামনের পাটির দাঁতগুলো ভাঙ্গা। শেষবারের মতো সবাইকে নিয়ে ভাত খাচ্ছে আলতাফ- হাতের আঙুলে জমে থাকা রক্ত দিয়ে সাদা ভাত লাল, সাথে সবুজ কাঁচামরিচ।
শাওন মাহমুদ, শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা
আইনিউজ ভিডিও
`প্রাণ দেবো, তবু ভিসির পদত্যাগ চাই` | কাফন মিছিলে শাবিপ্রবি শিক্ষার্থীরা | Eye News
শিক্ষার্থীরা লড়ছে মৃত্যুর সাথে, অসুস্থদের অ্যাম্বুলেন্সে নেওয়া হচ্ছে হাসপাতালে
মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে আমরণ অনশন চালাচ্ছেন শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা
উত্তাল শাবিপ্রবি, শিক্ষার্থীদেরে মশাল মিছিল
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ