কবির য়াহমদ
বিদায়ই অগ্রাধিকার
কবির য়াহমদ
১৬৩ ঘণ্টার দীর্ঘ সময় পর বরেণ্য শিক্ষাবিদ, লেখক এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের অনুরোধে আমরণ অনশন থেকে সরেছে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। জাফর ইকবাল অনশনকারীদের আশ্বস্ত করতে পেরেছেন যে তাদের দাবি যা প্রধানত ছিল উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ অথবা অপসারণ তা আদায় হবে, তাদের দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধান হবে। উপাচার্যের অনড় অবস্থান, সরকারের দৃশ্যমান কঠোর অবস্থানে মৃত্যুর দিকে ক্রমে এগিয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীরা শেষ পর্যন্ত এই একটা আশ্বাসে আস্থা স্থাপন করেছে। জাফর ইকবাল বলেছেন তিনি ‘সরকারের উচ্চমহল’ থেকে দাবি আদায়ের আশ্বাস পেয়েছেন, শিক্ষার্থীরা যেন তাকে বিশ্বাস করে।
এখানে জাফর ইকবাল সরকারের ‘দূত’ হিসেবে কাজ করেছেন ঠিক, কিন্তু তিনি এও বলেছেন সমস্যা সমাধানের আশ্বাস না পেলেও তিনি শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়াতেন। তখন হয়ত দেখা যেত আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে তিনিও অনশনে বসে গেছেন। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ না হলেও হয়ত ভিসি বাসভবনের সামনে বসা হতো না তার, তবে তিনি যে তার মত করে সেটা করতেন; এটা তার প্রতি প্রবল ব্যক্তিগত অনুরাগ থেকে বলছি না, বলছি তার চিরায়ত আবেগী চারিত্রিক কারণেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগে তিনি গণমাধ্যমে লিখিত এক নিবন্ধে আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করেছেন। শাবি ক্যাম্পাসে ঢুকে শিক্ষার্থীদের মুখ থেকে তাদের দুর্দশার কথা শুনে, সরকার-প্রশাসনের নিষ্ঠুরতার কথা জেনে তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, আবেগে কেঁদেছেনও। দৃশ্যত তিনি সমস্যা সমাধানে ‘দূতিয়ালি’ করেছেন ঠিক, তবে এ দূতিয়ালিতে তিনি শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করেছেন।
- আরও পড়ুন - ‘চাষাভুষা’, চাষাভুষার সন্তান
একটা ছাত্রী হলের অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে রূপান্তরিত আন্দোলনে শেষ পর্যন্ত নির্বিকার ছিলেন ফরিদ উদ্দিন আহমেদ, সরকারের দায়িত্বশীলদের উপাচার্যের পক্ষে অবস্থান, আন্দোলনকে বিতর্কিত করতে ‘তৃতীয় পক্ষের ইন্ধনের’ চিরচেনা অথবা অমানবিক অভিযোগ, শিক্ষামন্ত্রী- শিক্ষা উপমন্ত্রীর আন্দোলন সম্পর্কে নির্বিকার অথবা সময়সুযোগে এর বিরোধিতার ঘটনা, উপাচার্যদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের’ অবস্থান, শাবির শিক্ষকদের অবস্থান- সবকিছুই শিক্ষার্থীদের পক্ষে ছিল না। রাজনৈতিক বিবেচনায় উপাচার্য নিয়োগের সংস্কৃতিতে যেকোনো উপাচার্যের পক্ষে সরকারের অবস্থান নেওয়ার ঘটনাও সিলেটে ঘটেছে, এখানেও আন্দোলনের মুখে উপাচার্যের সরে যাওয়া, সরিয়ে দেওয়ার ঘটনাকে সরকার নিজেদের ব্যর্থতা হিসেবে ভেবেছে। এমন অবস্থা যখন একদিকে তখন দীর্ঘ অনশনজনিত অসুস্থতা, শিক্ষার্থীদের একে একে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া, সেখান থেকে সামান্য সুস্থ হয়ে ফের আন্দোলনে যোগ দেওয়ার মত ঘটনা ঘটছিল। আবার একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া চিকিৎসক দলের সরে যাওয়া কিংবা সরিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। আন্দোলনে আর্থিক সহায়তা দেওয়া সাবেক শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে সারাদেশে ধরপাকড় চলছিল, মামলা দেওয়া হচ্ছিল, হুমকি দেওয়া হচ্ছিল আন্দোলনকারীদের আন্দোলন থেকে সরে যেতে, শিক্ষার্থীদের লেনদেনের যত মাধ্যম তার সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
এত এত ঘটনা যার সবকিছু যাচ্ছিল আন্দোলনকারীদের বিপক্ষে, তখন জাফর ইকবালের শাবিতে আসা, শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করা, তাদেরকে অনশন ভাঙানোর মত ঘটনা ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যেখানে আশ্বস্ত করতে পারেনি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যেখানে শিক্ষার্থীদের ওপর চরম নির্যাতনের প্রতিবাদ করেনি, প্রতিরোধ করেনি সেখানে তিনি বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ নন। সরকার ও সরকারি দলের লোকজনের অভিযোগের ভাষায় তিনিও এখানে ‘তৃতীয় পক্ষ’। চেনাজানা ভাষায় ক্যাম্পাসে ‘বহিরাগত’। আন্দোলন চলাকালে গণমাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে লেখায় তিনি রীতিমত ‘তৃতীয় পক্ষের ইন্ধনের’ সঙ্গেও যুক্ত! হ্যাঁ, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক শিক্ষক। শিক্ষকজীবনের দীর্ঘ সময় তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়ে বর্তমানে অবসরযাপনে। তিনি যেমন শাবিপ্রবির দায়িত্বশীল কেউ নন, তেমনি নন সরকারের দায়িত্বশীলও। হতে পারেন তিনি সরকারঘনিষ্ঠ, তবে সরকারের অন্যায়কে ন্যায় বলে বলে বক্তৃতা-বিবৃতি-লেখালেখি করার কেউ নন। তিনি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি কিংবা শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর মতোও অবস্থানে নেই, দায়িত্বেও নেই; তবু তাকে আসতে হয়েছে। কারণ একদিকে শিক্ষার্থীদের প্রতি প্রগাঢ় মমতা তার, অন্যদিকে সমস্যা সমাধানে সরকারের উচ্চমহলের আশ্বাস ও তাকে করা অনুরোধ।
তিনি তার কাজ করতে সফল হয়েছেন। তার এই সাফল্য একদিকে যেমন প্রতিবাদে স্বেচ্ছা-মৃত্যুতে হলেও যাওয়া শিক্ষার্থীদের জীবনকে বাঁচিয়েছে, অন্যদিকে সরকারকেও রক্ষা করেছে। সমস্যা সমাধানে সরকারি ব্যর্থতায় যখন শিক্ষার্থীরা ক্রমে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছিল তখন যদি সত্যি সত্যি কেউ মারা যেত ওখানে তখন কী হতো দেশের? বহির্বিশ্বে তখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াত দেশের ভাবমূর্তি? অপ্রত্যাশিত হলেও এমন কিছু হলে সারাদেশের শিক্ষার্থীদের কি আটকানো যেত? ভাগ্যিস, একজন জাফর ইকবাল ও তার সহধর্মিণী ড. ইয়াসমিন হক ছিলেন! তাই তাদেরকে ঢাল বানিয়ে এ যাত্রায় রক্ষা! এটা একদিকে যেমন ২৮ শিক্ষার্থীর মৃত্যুপথযাত্রা রুখেছে, অন্যদিকে বাঁচিয়ে দিয়েছে সরকারকে।
এখন সরকারের উচিত হবে জাফর ইকবাল দেওয়া সরকারের উচ্চমহলের আশ্বাসের বাস্তবায়ন। তিনি বারবার বলেছেন সরকারের আশ্বাসের কথা। আবার আশঙ্কায় এও বলছেন, ‘সরকার যদি তাদের আশ্বাস বাস্তবায়ন না করে তবে এটা হবে শিক্ষার্থী ও তার প্রতি সরকারের প্রতারণা।’ অনশন ভাঙাতে এসে ‘সরকারের একটা মাধ্যম’ হয়ে এসে প্রতারণার যে আশঙ্কা জাফর ইকবালের এটাও কিন্তু থেকে যাচ্ছে; যতক্ষণ পর্যন্ত দাবি আদায় না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত অনিশ্চয়তায় থাকতেই হচ্ছে সকলকে। কারণ ফরিদ উদ্দিন আহমেদ সরকারের ‘গুডবুকে’ থাকা একজন উপাচার্য। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক না হলেও চার বছর আগে সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপাচার্য হিসেবে এখানে তাকে এনেছে। প্রথম দফা দায়িত্ব শেষে দ্বিতীয় দফায় আরও চারবছরের জন্যে তাকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে আন্দোলনকে, এমনকি ২৮ শিক্ষার্থীর জীবন উৎসর্গের সংকল্পকে তোয়াক্কা না করে শিক্ষামন্ত্রী উপাচার্যের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছিলেন। এত এত শিক্ষার্থীর জীবনের মূল্যের চাইতে উপাচার্য-রক্ষাই মূল্যবান ছিল তাদের কাছে। এখানে আপাত ক্ষীণ জাফর ইকবালের যে শঙ্কা সেটা আমাদেরও অন্তত উপাচার্যের বিদায় না হওয়া পর্যন্ত!
আমরা আশা করি জাফর ইকবালকে দেওয়া সরকারের উচ্চমহলের আশ্বাসের বাস্তবায়িত হবে। উপাচার্যের পদত্যাগ হোক, অপসারণ হোক কিংবা তাকে ছুটিতে পাঠিয়ে দিয়ে হলেও তার শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ নিশ্চিত করবে।
-
আরও পড়ুন - আলতাফ মাহমুদের শেষ কয়েক ঘণ্টা
শিক্ষার্থীদের অনশন ভঙ্গের পর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা উপাচার্য ভবনের তালা খুলে দিয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনপর্বের সমাপ্তি ঘটেছে। শাবি পরিস্থিতি যখন এমন তখন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, ‘কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমরা আলোচনা করব। উপাচার্য থাকলেন কি থাকলেন না, তাতে শিক্ষার্থীদের সমস্যার সমাধান হবে না। আমরা সমস্যার সমাধান করব। এটার অন্য পদ্ধতি আছে। রাষ্ট্রপতি আমার ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত করেছেন। আমরা দেখব এ ব্যাপারে আমাদের পক্ষে কী করা সম্ভব।’ শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘শিক্ষার্থীরা যখন চাইবেন আমার সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারবেন। তারা চাইলে আমি সিলেটে যেতে পারি। অনশন ভেঙেছেন। এখন তাদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের দাবি বাস্তবায়নের মাধ্যমে আন্দোলন শেষ করা হবে। শুধু শাবিপ্রবিতে নয়, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আবাসন হলসহ বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করা হবে।’
মন্ত্রীর এসব বক্তব্যকে ইতিবাচকভাবে নিতে চাই। কিন্তু চাইলেই কী সম্ভব? অন্তত নিকট অতীত যা বলে তাতে এখানেও যে তাদের রাজনৈতিক কৌশলধর্মী অবস্থান নেই তাও একবাক্যে বলা যাচ্ছে না। তবে ওই রাজনৈতিক কৌশল এখানেও নেওয়া হবে না এমনটা বিশ্বাস করতে চাই। যদি শিক্ষার্থীদের মূল দাবিকে উপেক্ষা করা হয়, অথবা দাবি বাস্তবায়নে কালক্ষেপণ করা হয় তবে সবচেয়ে বেশি হতাশায় পুড়বে শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে একটা অসহনীয় অবস্থা থেকে উত্তরণে মুখ্য ভূমিকা পালন করা ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকেও অসম্মানিত করা হবে, তার সঙ্গেও প্রতারণা করা হবে।
রাজনৈতিক বিবেচনায় উপাচার্য-শিক্ষক নিয়োগসহ বিশ্ববিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সমস্যা সেটা অস্বীকার করার উপায় নাই। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় জাফর ইকবাল বলেছেন, এই আন্দোলনের ওসিলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ সুন্দর হবে। আমরাও চাই তেমনই কিছু হোক, বিশ্বাস রাখতে চাই শিক্ষামন্ত্রীর ওপরও। তবে এই বিশ্বাস অটুট রাখার প্রথম ধাপ হবে শাবিপ্রবির আন্দোলনকারী ও জাফর ইকবাল দম্পতির প্রতি সম্মান রেখে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উপাচার্য ফরিদ আহমেদ বিষয়ে সিদ্ধান্ত।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমস্যার সমাধান দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এটা গুরুত্বপূর্ণ নিঃসন্দেহে। তবে শিক্ষার্থীদের আস্থায় রাখতে অগ্রাধিকার হোক ফরিদ উদ্দিনকে প্রত্যাহার। আমরা সে উদ্যোগের অপেক্ষায়, অপেক্ষায় পুরো দেশ!
কবির য়াহমদ, প্রধান সম্পাদক, সিলেট টুডে টূয়েন্টি ফোর
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ