মুক্তাদীর আহমদ মুক্তা
আপডেট: ১৭:৪৪, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২
বিরলপ্রজ প্রতিভা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত
প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত
মন্ত্রী বা মন্ত্রীর পদ মর্যাদায় দায়িত্ব পালন করলেও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সরকারি বাড়ির সুবিধা নেননি। সাত বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েও এমপিদের জন্য সংরক্ষিত প্লট গ্রহণ করেননি। নীতি নিষ্ঠ এই রাজনীতিবিদের ধ্যাণ-জ্ঞান ছিল সংসদীয় রাজনীতির বিকাশ ও কার্যকর জাতীয় সংসদ।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সত্তরের ঐতিহাসিক নির্বাচনেই চমক সৃষ্টি করেছিলেন। বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির হয়ে নির্বাচন করে জয়ী হন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বীর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটিরও সদস্য ছিলেন। এরপর ধীরে ধীরে কেবলই এগিয়ে চলা। আটবার নির্বাচনে জয়ের রেকর্ড আর কারইবা আছে? সংসদে ঝড় তুলেছেন বারবার।
অন্যসব পরিচয় ছাপিয়ে তিনি খ্যাতি পেয়েছেন এক অভিজ্ঞ পার্লামেন্টেরিয়ান হিসেবেই। বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাস যতদিন থাকবে ততদিন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নাম উচ্চরিত হবেই।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভাটি বাংলায় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ৫ নম্বর সেক্টরের, টেকেরঘাট সাব-সেক্টর গঠনে তিনি অসামান্য অবদান রাখেন এবং শুরুর দিকে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি অংশ গ্রহণ করা স্মরণীয় এই রাজনীতিকের অন্যতম পরিচয় হচ্ছে, তিনি একজন সংবিধান এবং আইন বিশেষজ্ঞ।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরপর আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে। অভিজ্ঞ এই রাজনীতিবিদ মানুষের মাঝে বেশি পরিচিত ছিলেন সংসদে তাঁর যৌক্তিক, চাতুর্যপূর্ণ এবং রসাত্মক বক্তব্যের জন্য। রাজনীতিবিদ হিসেবে বিপক্ষের নেতাদেরও সমীহ পেয়েছেন তিনি।
সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের আনোয়ারপাড়া গ্রামে জন্ম নেয়া সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ও পরে ঢাকা সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে আইনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। সত্তরের নির্বাচনের পর স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭৯ সালে একতা পার্টি থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। সামরিক স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে করেছেন কারাবরণ।
- আরও পড়ুন - ‘চাষাভুষা’, চাষাভুষার সন্তান
১৯৮৬ সালে আবারও নির্বাচনে জয়লাভ করেন। ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গণতন্ত্রী পার্টি থেকে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে সংসদে যান। পরে গণতন্ত্রী পার্টি ত্যাগ করে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। সপ্তম সংসদে হবিগঞ্জ-২ আসন থেকে উপনির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এরপর ২০০১ সালে সুনামগঞ্জ-২ আসন থেকে আবারও বিজয়ী হন। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে জয়লাভের পর ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি নির্বাচনের পর আবারও সংসদে যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা।
পঞ্চম সংসদের সদস্য থাকাকালেই আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে প্রথমে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং পরে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন। ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে সুরঞ্জিত ভোটে হেরে গেলেও পরে হবিগঞ্জের একটি আসনে উপ-নির্বাচন করে তিনি বিজয়ী হন। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা নিযুক্ত হন তিনি।
২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচিত হন। দলীয় মনোনয়নে এমপি হলেও ওয়ান-ইলেভেনের পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অন্য চার জন সিনিয়র নেতার সঙ্গে সুরঞ্জিতও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর পদটি হারান। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোটের বিশাল বিজয়ের পর সুরঞ্জিতকে আইন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পান। পরে ২০১১ সালের ২৮ নভেম্বর রেলমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন সুরঞ্জিত। কিন্তু ব্যক্তিগত সহকারীর দুর্নীতির দায় মাথায় নিয়ে পরের বছর (২০১২) ১৬ এপ্রিল মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে দফতরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রীসভায় রেখেছিলেন।
এ সময় নির্দোষ প্রমাণিত না হলে সক্রিয় রাজনীতি করবেন না বলে সুরঞ্জিত ঘোষণা দেন। এপিএস’র অর্থ কেলেঙ্কারীর ঘটনা তদন্ত করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সুরঞ্জিত সেনকে নির্দোষ ঘোষণা করলে আবারও রাজনীতিতে সক্রিয় হন তিনি। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সম্মেলন তিনি পুনরায় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মনোনীত হয়েছেন। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্য। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলে তিনি আবারও আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট, নারকীয় গ্রেনেড হামলার মুহূর্তে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে ঘিরে যে মানববর্ম গড়ে তুলেছিলেন উপস্থিত নেতৃবৃন্দ, তিনি তাঁদের অন্যতম। সেদিনের হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেডের স্প্লিন্টার মৃত্যু পর্যন্ত বহন করেছিলেন।
-
আরও পড়ুন - আলতাফ মাহমুদের শেষ কয়েক ঘণ্টা
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এক বিরলপ্রজ প্রতিভা। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনের পর তিনি প্রধানমন্ত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। তিনিই বাংলাদেশের এমন পদবিধারী প্রথম ব্যক্তি। মন্ত্রীর মর্যাদায় তাঁর জন্য এই পদ সৃষ্টি করা হয়। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে রেল মন্ত্রণালয় পৃথক করে তাঁকে দেশের প্রথম রেলমন্ত্রী করা হয়। এপিএসের অর্থ কেলেংকারীতে প্রশ্ন ওঠায় তিনি দায় মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করেন। বাংলাদেশে মন্ত্রীর পদত্যাগের ঘটনাও এই প্রথম। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে তাঁকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে বহাল রাখেন। তিনিই দেশের প্রথম দপ্তরবিহীন মন্ত্রী।
মন্ত্রী বা মন্ত্রীর পদ মর্যাদায় দায়িত্ব পালন করলেও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সরকারি বাড়ির সুবিধা নেননি। সাত বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েও এমপিদের জন্য সংরক্ষিত প্লট গ্রহণ করেননি। নীতি নিষ্ঠ এই রাজনীতিবিদের ধ্যাণ-জ্ঞান ছিল সংসদীয় রাজনীতির বিকাশ ও কার্যকর জাতীয় সংসদ।
২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি প্রয়াত হন। প্রবীণ রাজনীতিক,প্রজ্ঞাবান জননেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পঞ্চম প্রয়াণদিবসে তাঁকে স্মরণ করি শ্রদ্ধা-ভালোবাসায়। চির প্রশান্তিতে থাকুন হে সংগ্রামী।
মুক্তাদীর আহমদ মুক্তা, লেখক ও সাংবাদিক
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ