মাসকাওয়াথ আহসান
কাওসার আহমেদ চৌধুরী: ফেরারি পাখিরা
মাসকাওয়াথ আহসান
নীলক্ষেত বইপাড়ায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলছিলো। আগুনের লেলিহান শিখা দেখে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপর নির্মিত ছবিতে হিটলারের বই পোড়ানোর দৃশ্য মনে উঁকি দিচ্ছিলো। বই কি পোড়ে, বই কি পোড়ানো যায়; পোড়েন শুধু বই দোকানি ভাই; যে আমাকে ইংরেজি সাহিত্য আর বিশ্বসাহিত্যের বইগুলো দিতো নামে মাত্র দামে। কখনো নতুন কোন বই এলে এমনিই পড়তে দিতো।
এই মন খারাপের সাঁঝে 'আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে মনে পড়লো তোমায়। আমাদের প্রিয় গীতিকবি; নাট্যকার, আঁকিয়ে আর ছুটির দিনের রম্যভাগ্যের ডাক্তার; লম্বা চুল, মুখে দাড়ি, কালো ফ্রেমের চশমা, মাথায় ক্যাপ, কাঁধে ঝোলা নিয়ে আনন্দ খুঁজে বেড়ানো দীর্ঘকায় মানুষটা নিঃসীম সুখের খোঁজে বললেন, আমায় ডেকো না; ফেরানো যাবে না।
ঢাকার সোনালী যুগের প্রত্ন নিদর্শনের মতো কিংবদন্তির মানুষদের শোকগাথা লিখে লিখে এই মড়কে সর্বোনেশে কালের প্রতিটি দিন আসে; কাউকে হারানোর শঙ্কা নিয়ে।
নীলক্ষেত আর ভাগ্যের রম্যডাক্তারের একটা স্মৃতি জ্যামিতিক যোগাযোগ আছে। আমাদের তারুণ্যে যখন এই বিষণ্ণতার শহরে মন খারাপের হাওয়া দুলে দুলে উঠতো; কবি হুমায়ূন রেজা বলতো, পাভেলরে কী হবে রে কী হবেরে আমাদের! নীলক্ষেতে মুনির রানা তখন খুঁজছিলো রহস্য গল্প; আঁতিপাঁতি করে রূপকথার গল্প; রিডার্স ডাইজেস্ট; আরও কত কী! প্রথম আলোর ছুটির দিনে সাপ্তাহিকীর জন্য আইডিয়া জেনারেট করতে হতো তাকে। হুমায়ূন রেজা আইডিয়া খুঁজতো ভোরের কাগজের অবসর সাপ্তাহিকীর জন্য। ফলে ইউনিভার্সিটি লাইফ চলে গেলেও নীলক্ষেতের বায়েস্কোপের নেশা ছাড়েনি। আমার আর রেজার সারাক্ষণ কী হবেরে হবেরে শুনতে শুনতে বিরক্ত মুনির রানা বললো, চল কাওসার ভাইয়ের বাসায় যাই। উনি তোদের বলে দেবেন কী হবে!
রিকশা চেপে আজিমপুর সরকারি কোয়ার্টারে কাওসার ভাইয়ের বাসায় গেলাম আমরা। ছয় ফুট লম্বা লোকটি দরজা খুলে আমাদের বসতে দিলেন। মুনির রানা বললো, আপনার ভাগ্য লেখা হয়েছে ভাবলাম; এসেছিলাম নীলক্ষেতে; তাই এসে পড়লাম কাওসার ভাই। লেখা না হলেও অসুবিধা নাই।
মুনির রানা এরপর আসল কথাটা পাড়লো। বললো রেজা আর পাভেল ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন। কিছু একটা করেন স্যার। কাওসার ভাই দুজনকে আপাদমস্তক দেখে বললেন, ওদের দেখে কিন্তু বোঝার উপায় নাই; এতো দুঃশ্চিন্তা কিংবা দুঃখ ওদের। রানা বললো, রেজা সবসময় সেজেগুজে থাকে; তাই ভেতরের দুঃখ বোঝা যায় না। আর পাভেল তো বিষণ্ণতার শহর লেখে। ফলে ও তো বিষণ্ণ; রেজার কবিতায় নৈরাশ্য ঘুরে ফিরে আসে।
কাওসার ভাই একবার কী মনে করে বুকশেলফের দিকে তাকিয়ে বললেন, ওদের দেখে তো কোন সিম্প্যাথি আসেনা; কী করা যায়!
রানা বললো, ওদের ভাল্লাগেনা রোগ। শ্যালেতে গেলেও দুঃখ করে; কোথাও ঘুরতে গেলে একটু পরে মন খারাপের হাওয়া দুলে দুলে ওঠে।
কাওসার ভাই আমাদের বললেন, আমি তো রসিকতা করে লিখি; সিরিয়াস কিছু নয় ওটা।
রেজা অস্ফুট কন্ঠে বললো, তবুও কাওসার ভাই; তবুও। উনি আমাদের চা-নাশতা খাইয়ে বিদায় করলেন। আমাকে বললেন, অবসরে লিখছো বিষণ্ণতার শহর, ছুটির দিনে 'তির্যক রচনা'; তোমার মনের কূল পাওয়া কঠিন। তারপর বললেন, অবশ্য আনন্দ-বেদনা দুটোই হিউমার। দুরকম হিউমার।
রেজাকে বললেন, এতো হ্যান্ডসাম ছেলের তো প্রেম পেতে অসুবিধা হবার কথা নয়। কীসের এতো দুঃখ কবি!
ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলাম। এরপর প্রথম আলোর ফিচার বিভাগে উনি এলে; আমি মন দিয়ে উনার কথা শুনতাম। উনি নিজে হাসতেন না। কিন্তু কিছু একটা বললেই আরেক ছয় ফুট অরুণদা অট্টহাসি দিতেন।
বাংলাদেশ বেতারের লবিতে দেখি একদিন কাওসার ভাই; সুরকাররা তাকে চা খেতে নিয়ে যাবার জন্য টানাহ্যাঁচড়া করছে। আমাদের জাভেদ আখতার উনি; গান লিখলেই হিট; সুরকার তো তেলাঞ্জলি দেবেনই। আমাকে দেখে বিস্মিত হলেন। সংগীত পরিচালকরা বিসিএস অফিসার বলে পরিচয় করিয়ে দিতেই উনি একটু জোরে হেসেই বললেন, একই অঙ্গে এতো রূপ। উনাকে দপ্তরের সোফায় বসালাম। আমার ফিমেল কলিগরা এসে একটু হাত দেখে দেবার জন্য কাকুতি মিনতি করছিলেন। উনি বললেন, বিপদে পড়া গেলো তো। সবশেষে লাঞ্চ করে তবে উনাকে রেডিওর গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলাম। এরপর পাঁচ বছর দেখা নেই উনার সঙ্গে। কিন্তু আমি ঠিকই কোলনে উনার রাশিচক্র পড়ে সপ্তাহের প্ল্যান করি। সুযোগ পেলে উনার লেখা গান ডয়চেভেলেতে প্রচার করি। একবার উনাকে আর কলকাতার জ্যোতিষীকে ফোনে আমন্ত্রণ জানিয়ে নববর্ষের শো করলাম। প্রচুর চিঠি পেলাম আমরা শ্রোতাদের কাছ থেকে।
২০০৯ সালে একুশে বইমেলায় উনার সঙ্গে দেখা; জনান্তিকে নিয়ে গিয়ে ইংরেজি গল্প গ্রন্থ মঙ্গা ক্যারাভান গিফট করলাম। উনি আমার বিষণ্ণতার শহর গ্রন্থটি দেখে বললেন, এটা তো আগেই কিনেছি হে।
এরপর বললাম; আমি ইতস্তত বর্ধমান হাউজের সামনে ঘুরি দ্য-এডিটরের লাইভকাস্টের জন্য গেস্ট ধরতে। জার্মানিতে একটু অনলাইন মিডিয়া ট্রেনিং করেছিলাম। সেটা পরীক্ষা করে দেখতে এসেছি। আসবেন কি কাওসার ভাই? উনি বললেন, মেলাটা একবার চক্কর দিয়ে আসছি।
আমি বর্ধমান হাউজের সামনে মাসুদা ভাট্টি আর লুৎফর রহমান রিটন ভাইয়ের সঙ্গে গপ্পো করছিলাম। হঠাত দেখি কাওসার আহমেদ চৌধুরী দ্য এডিটর মোবাইল নিউজরুমের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। আমি ছুটে গেলাম। অনুজ প্রতিম সাংবাদিকেরা তার জমজমাট কফির আড্ডা সম্প্রচার শুরু করলো। আমি ক্যামেরার বাইরে সামনে বসলাম উনার কথা শুনতে। উনি গল্প করতে করতে ইএসপি নিয়ে কথা তুললেন। তারপর সবাইকে আমাকে দেখিয়ে বললেন, ওর ইএসপি আছে। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখো। ও জানে ভবিষ্যতে কী ঘটবে ওর জীবনে! তারপর আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন, কি ঠিক বলেছি কিনা!
আড্ডা শেষ হলে উনার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে টিএসসি পর্যন্ত হেঁটে গেলাম, বিদায়বেলায় বললেন, আর তো দেখা হবে না। ফেরারি পাখি; যেখানেই থাকো আনন্দে থাকো। উনার রিকশাটা নীলক্ষেতের দিকে যেতে যেতে দৃষ্টিসীমা থেকে হারিয়ে গেলো!
মাসকাওয়াথ আহসান, লেখক ও সাংবাদিক
- খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ