আবুল ফতেহ ফাত্তাহ
আপডেট: ২১:৩১, ১৭ মার্চ ২০২২
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও শেরপুর জনযুদ্ধ
আবুল ফতেহ ফাত্তাহ (লেখক)
১৯৭১। মার্চের শেষ দিনগুলো আবেগ-উৎকণ্ঠায় কাটলো। যুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বটা ঠিক কোনদিকে মোড় নিচ্ছে বুঝে উঠতে পারছিলাম না। রেডিওকে একমাত্র সম্বল করে আমরা তখন রণাঙ্গনের খবর সংগ্রহ করছি। এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে জানা গেলো মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছে। কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি করে বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয় এবং এভাবেই সে সময় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার কর্মপন্থা নির্ধারিত হয়।
প্রাককথন
বঙ্গবন্ধুর নামের সঙ্গে যেদিন থেকে পরিচিত, সেদিন থেকেই তাঁকে দেখার এক উদগ্র চিন্তাস্রোত আমার মধ্যে কাজ করছিল। ১৯৭০ সাল। আমি তখন নবীগঞ্জ জে কে হাইস্কুলের সপ্তমশ্রেণির ছাত্র। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাপ এসে লেগেছিল আমাদের স্কুলেও। ছাত্ররাজনীতির কিছু না-বুঝলেও পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী যে বাঙালিদের প্রতি শোষণ-নিপীড়ন করছে এর অনেকটা আমরা টের পেতাম বড় ভাইদের কথাবার্তা ও বক্তৃতা শুনে শুনে। তখনকার সময়ের দু-একটা স্লোগান আমার মনে পড়ে। একটা ছিল ‘চর্যাপদর বাংলা/জেগেছে জেগেছে’। অপর স্লোগান ছিল- ‘আয়ুব-মুনায়েম ভাই ভাই/ এক রশিতে ফাঁসি চাই।’
আবার এ-ও শুনেছি এবং আমরা মিছিলে উচ্চারণ করেছি : ‘তোমার নেতা আমার নেতা/ শেখ মুজিব শেখ মুজিব’। ঊনসত্তরের উন্মাতাল দিনগুলোতে ঢাকাসহ দেশজুড়ে আয়ুব-বিরোধী আন্দোলনের প্রচণ্ড উত্তাপ। এ-সময়েই আমার জানামতে আমাদের এলাকায় প্রথমবারের মতো ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীরাও মিছিলে অংশ নেয়। স্লোগানে স্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখর হয় ওঠে। সে সময় ‘চর্যাপদ’ কী জানতাম না। তবে অনুভব করতাম হয়তো বা বাঙালিদের গর্ব করার মতো কিছু হতে পারে। সামরিক শাসক আয়ুব খান এবং তার দোসর গভর্নর আবদুল মুনায়েম খান সম্পর্কে ছাত্রনেতাদের মুখে অনেক কথা শুনেছি। তাই বাঙালি-ব নার মূল হোতা হিসেবে ছাত্রসমাজ তাদের দুজনার ফাঁসি দাবি করছে। আমরা এটাও জানলাম পূর্ব বাংলার প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ ও বৈষম্যের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অবলম্বনে আওয়ামীলীগ একটি পোস্টার প্রকাশ করে। এর শিরোনাম ছিল ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’। তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে উৎপাদিত পণ্যদ্রব্যের তুলনামূলক মূল্যতালিকা এই পোস্টারে খুব সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়। একজন সাধারণ পাঠকেরও এর মর্ম উদ্ধার করতে কষ্ট হয়নি। ব্যক্তিগতভাবে কিশোর বয়সে এই বৈষম্যমূলক অবিচারের কথা উল্লিখিত পোস্টারে দেখতে পেয়ে মনোজাগতিকভাবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রচণ্ড একটা আকর্ষণ অনুভব করতাম। এরই মধ্যে আমার বাবার সুবাদে আওয়ামীলীগ প্রচারিত ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ঐতিহাসিক ছয়দফাকেন্দ্রিক একখানা সুদৃশ্য পোস্টার সাইজ প্রচারপত্র আমার পড়ার ঘরের একটি ক্যালেন্ডারের স্থান দখল করে। প্রায় প্রত্যেক দিন এই প্রচারপত্রের দিকে আমার নজর পড়তো। প্রচারপত্রের মধ্যিখানে বঙ্গবন্ধুর একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছিল। যদ্দুর মনে পড়ে (হয়তো কিছু ভুল হতে পারে) লেখা ছিল- ‘প্রয়োজন হলে সারাজীবন কারাগারে কাটাব, কিন্তু ছয় দফার ‘দাঁড়ি, ‘কমা’ কম হলে আমি মানবো না।- শেখ মুজিব’। লাইনটি বারবার পড়তাম আর বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে ছয়দফার প্রত্যেক দফা প্রায়শই আওড়াতাম। এভাবে ১৯৬৬ সালের ছয়দফা আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। ছাত্রদের ১১ দফা আর আওয়ামী লীগের ছয়দফা যুগপৎ কর্মসূচির মাধ্যমে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের স্রোতধারাকে বেগবান করে তোলে।
শৈশবস্মৃতি : কৃষ্ণচূড়াদিন ও বঙ্গবন্ধু
শৈশব থেকে ক্লাসের পড়ার বাইরেও আমার একটা পড়াশোনার জগৎ ছিল। সেই জগৎটাতে বাবাই ছিলেন আমার পথপ্রদর্শক। অর্থাৎ বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই আমি কবিতা, গল্প, বিজ্ঞান-কল্পকাহিনী, উপন্যাস ইত্যাকার বিষয় পঠন-পাঠনে আগ্রহী হয় উঠি। বন্ধুবান্ধব-বিশেষত সিনিয়র ভাইদের সহায়তা পেয়েছি প্রচুর। আমাদের স্কুলের কয়েকজন শিক্ষক এবং বড় ক্লাসের ভায়েরা সবাই মিলে একটা স্টাডি সার্কেল গড়ে তুলেছিলাম, অবলীলায়। আজকের দিনে বসে সেদিনকার দৃশ্যগুলো মনে পড়লে অবাক হতে হয়।
একদিন (১৯৭০) বড় ভাইদের মুখে জানতে পারলাম হবিগঞ্জে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দেবেন। কথাটা শুনেই মনটা অজানা এক শিহরণে মেতে ওঠে। কীভাবে হবিগঞ্জে যেতে পারি তাই নিয়ে না-না জল্পনা-কল্পনা। আমাদের বাড়িতে আমার এক আত্মীয় চাচা থাকতেন। তিনি আমার চেয়ে দু ক্লাস সিনিয়র। মহাম্মদ মিন্নত তাঁর নাম। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। প্রাইমারি ও জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় ট্যালেন্টফুল বৃত্তিধারী। আমরা দুজন পরামর্শ করলাম যেকোনো ভাবে হোক বঙ্গবন্ধুকে দেখতে হবে। মায়ের কাছে প্রথমে বিষয়টি বললাম। মা সময়-সুযোগ মতো বাবাকে বললেন। এবং বাবাও শেষ পর্যন্ত সম্মত হন। আমরা দুজন নবীগঞ্জ থেকে হবিগঞ্জের উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করি। উল্লেখ্য যে, নবীগঞ্জ-হবিগঞ্জের দূরত্ব প্রায় ১৪ মাইল। জায়গাটার নাম বলতে পারবো না তবে যে হোটেলে আমরা উঠলাম তার নাম ছিল ‘হোটেল শান্তিবাগ’ (এখন আছে কিনা জানি না)। সৌভাগ্যবশত ঐ হোটেলের পাশে ছাত্রলীগের নতুন কার্যালয় বেলা ১০/১১টা নাগাদ উদ্বোধন করার কথা এবং সেটা উদ্বোধন করবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। আমিতো আনন্দে আত্মহারা-মেঘ না-চাইতেই জল। হোটেলের বারান্দার পাশ ঘেঁষে ‘শেখ মুজিবতোরণ’ নামে একটি সুদৃশ্য তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে। যথাসময়ে তোরণের অদূরে একটি গাড়ি থেকে একজন দীর্ঘাঙ্গি ভদ্রলোক নামলেন। তাঁর পরণে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি। মুহূর্তেই চতুর্দিকে স্লোগান উঠলো- তোমার নেতা আমার নেতা...। বুঝতে বাকি রইলো না তিনিই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা অবলোকন করছি ঠিকই, কিন্তু প্রচণ্ড এক আবেগে আমার শরীর কাঁপছে। হোটেলের দোতলার সিঁড়ি দিয়ে খুব দ্রুত নিচে নেমে আসি। যে কোণ ঘেঁষে তোরণ নির্মিত হয়েছে সেখানটাতে গিয়ে দাঁড়াই। প্রাণের আকর্ষণে আমি তাঁকে দেখলাম অপার বিস্ময় নিয়ে। তারপর তিনি ফিতা কেটে ছাত্রলীগ কার্যালয়ের শুভ উদ্বোধন করলেন। সেখানে যাওয়ার মতো সাহস ও যোগ্যতা সেদিন আমার কোনোটিই ছিল না। তবু প্রাণের আকুতি আর মুগ্ধতা নিয়ে আমি সে দৃশ্যগুলো সেদিন অবলোকন করেছিলাম।
বিকেলবেলা হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজের অদূরে চিলড্রেন পার্কে জনসভা-অনুষ্ঠান। আমরা যথাসময়ে সেখানে উপস্থিত হলাম। লোকে লোকারণ্য সভাস্থল। মাইকে বারবার ঘোষিত হচ্ছিল এখোনি বঙ্গবন্ধু সভাস্থলে এসে পৌঁছবেন। এবং খানিকক্ষণ পরে তিনি এলেন। তাঁর হাতে তাঁর চিরচেনা কাল পাইপ শোভা পাচ্ছে। দাঁড়ালেন জনগণকে সম্ভাষণ জানিয়ে। চারদিকে মুহুর্মুহু স্লোগান। তারপর তিনি শুরু করেন। শুধু একটি বিষয় আমার এখনো মনে আছে। তিনি বলছিলেন, ‘সিলেটের ভাইবোনদের কাছে আমি ঋণী। বিশেষত আপনাদের হবিগঞ্জের আবদুল মন্নান সাহেবের কাছে আমি বেশি ঋণী। তিনি যদি লন্ডন থেকে আমার জন্যে ইংরেজ আইনজীবী ব্যারিস্টার টমাস উইলিয়াম কিউসি-কে না-পাঠাতেন, তাহলে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আমাকে কারাগারেই মৃত্যুবরণ করতো হতো।’
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ : প্রস্তুতির আগামবার্তা
বলছিলাম, বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখা এবং তাঁর অভিভাষণের কথা। ওইদিন সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ভাষণের ওপর পাকিস্তান রেডিও থেকে সংবাদ পরিবেশিত হয়। যেহেতু সাধারণ নির্বাচনের পুর্বমুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ স্বভাবতই বাঙালিব নার কথামালা তাঁর ভাষণের মধ্যে যেমনটি ছিল সেদিনের পাকিস্তান রেডিও অনেকটাই প্রচার করেছিল। শুনে শুনে মনে হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আর অগ্রাহ্য করতে পারবে না। কিশোর বয়সের এই অনুভূতি কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল জানি না। তবু সেদিন (১৯৭০) অন্তরের ভেতর এক পুলক-আভা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এবং তাঁর প্রিয় মুখ দেখে আমরা সভাস্থল ত্যাগ করি। তাঁর ভাষণে যে বলিষ্ট কণ্ঠস্বর, পূর্ববাংলার মানুষের প্রতি অপরিসীম দরদ ও শোষণ-ব নার কথা শুনেছিলাম, আমার কানে আজো তার প্রতিধ্বনি শুনি। সচকিত হই মুগ্ধ আকর্ষণে।
শেরপুরের জনযুদ্ধ : মিছিলে মিছিলে শেরপুর
১৯৭১। মার্চের শেষ দিনগুলো আবেগ-উৎকণ্ঠায় কাটলো। যুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বটা ঠিক কোনদিকে মোড় নিচ্ছে বুঝে উঠতে পারছিলাম না। রেডিওকে একমাত্র সম্বল করে আমরা তখন রণাঙ্গনের খবর সংগ্রহ করছি। এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে জানা গেলো মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছে। কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি করে বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয় এবং এভাবেই সে সময় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার কর্মপন্থা নির্ধারিত হয়।
এরই মধ্যে শেরপুরে বিরাট আকারের এক জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়। হবিগঞ্জ থেকে কর্নেল এম এর রব, মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত, কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী, মৌলভীবাজার থেকে আজিজুর রহমান, মোহাম্মদ ইলিয়াস, ডা. আবদুল আলী প্রমুখের যৌথ প্রচেষ্টায় অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর সদস্য, পুলিশ-ইপিআর ও উৎসাহী যুবকরা শেরপুরে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করেন। প্রচুর গুলি বিনিময়ের পরও পাকিস্তানি ঘাঁটি থেকে তাদের সরানো যাচ্ছিল না।
এই ঘটনার সম্ভবত দিন কয়েক আগে শেরপুরের তিনদিক থেকে স্বতঃস্ফুর্ত জনতা দেশীয় অস্ত্র বিশেষত দা-কুড়াল, সুলফি-ঝাটা, লাঠি, রামদা, এমনকি ছুরি-চাকু নিয়েও অনেকে পাঞ্জাব সেনাদের তাড়ানোর জন্যে অদম্য সাহসে জড়ো হন। নবীগঞ্জ, মৌলভীবাজার, জগন্নাথপুর প্রভৃতি এলাকা থেকে দলে দলে সবাই দেশীয় অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করতে ছুটে আসেন শেরপুর অভিমুখে। সে-সময়কার নবীগঞ্জ থানার বাউশা ইউনিয়নের ছাত্র-যুবকদের নিয়ে গঠিত ‘বাউশা ইউনিয়ন ছাত্রলীগ সংগ্রাম পরিষদ’ সভাপতি মির্জা ইলিয়াস বশির, সাধারণ সম্পাদক মহাম্মদ মিন্নত, অন্যতম সদস্য মোহাম্মদ আলী, কাওসার আহমদ, মৌলুদ হোসেন, বিধু দাশগুপ্ত, বশীর আহমদ প্রমুখ প্রত্যেক গ্রাম থেকে লোকজন জড়ো করে দেশীয় অস্ত্রসমেত শেরপুর অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। সবাই যখন নানা স্লোগান উচ্চারণ করে যাচ্ছিলেন এ পরিষদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে আমি আর ঘরে থাকতে পারলাম কই! মিছিলে যোগ দিলাম। ‘জয় বাংলা’, স্বাধীন বাংলা, স্বাধীন বাংলা অমর হোক অমর হোক, বাঁশের লাঠি তৈয়ার কর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ প্রভৃতি স্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত হলো। আমাদের মিছিল বাউশা বাজার হয়ে রতনপুরের গাঁ ঘেঁষে (বর্তমান বাংলাবাজার) এনাতাবাদ গ্রামের পূর্ব প্রান্তে যেতেই দেখা গেল নবীগঞ্জ থেকে বিরাট এক জঙ্গি মিছিল প্রবীন নেতা মিম্বারুর রহমান চৌধুরী ও আবদুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে এগিয়ে আসছে।
স্লোগানের তালে তালে সবার হাত উত্তোলিত হচ্ছে শূন্যে। মিম্বারুর রহমান চৌধুরী তাঁর নিজের বন্দুক নিয়ে মিছিলে শরিক হয়েছেন। উভয় দিক থেকে মিছিল মিলিত হয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে আউশকান্দির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। সেখানে পৌঁছতে না পৌঁছতে মিছিলের আকার দ্বিগুণ বেড়ে যায়। কারণ আশপাশ গ্রাম থেকে মানুষের ঢল শেরপুর অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছে। আমাদের প্রত্যেকের ধারণা ছিল এই বিরাট জনস্রোত দেখে হানাদার বাহিনী পালিয়ে যাবে এবং জনতার তীব্র রোষ প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে বাঙালিরা তাদের তেজোদ্দীপ্ত প্রাণের পরিচয় দেবে।
এত মানুষের ঢল, মিছিল, স্লোগান কীসের টানে শেরপুর অভিমুখে এই অভিযাত্রা! বাঙালিদের বাঁধভাঙ্গা ঢেউ সেদিন উপছে পড়ছিল আর প্রাণের উন্মাদনা প্রচণ্ড আবেগে ঝড়ে পড়ছিল নদী-প্রান্তরে। বাঙালি জীবনে এ-এক অপূর্ব রূপ, অভূতপূর্ব জাগরণ! তখনো কি আমরা জানতাম কী ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে এই নিরস্ত্র মানুষগুলো মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি! শুধু প্রাণের শিহরণে, দেশমাতার টানে, আবালবৃদ্ধবণিতা সবাই সেদিন একাট্টা হয়ে শত্রুর মোকাবেলা করেছিলাম। শেরপুরে সংগ্রামী মানুষের মিছিল সেদিন একটি সত্যই জানান দিচ্ছিল যে দেশপ্রেমের কাছে সমস্ত বিপদ বিশেষত মৃত্যুভয় তুচ্ছ হয়ে যায়। সেদিনকার সাধারণ মানুষের জাগরণ এবং প্রতীতি এটাই প্রমাণ করে যে দেশপ্রেমের চাইতে বড় শক্তি ও বল পৃথিবীতে নেই। মরণজয়ী সাহসে বলীয়ান বাঙালিরা এভাবেই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার প্রমাণ আমরা দিন-কয়েক পরে ‘শেরপুর অপারেশনে’ পেয়েছিলাম।
মুক্তিযুদ্ধ : শেরপুর অপারেশন
মুক্তিপাগল মানুষের এই অভূতপূর্ব জাগরণ জনযুদ্ধেরই নামান্তর। কারণ, সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফুর্ত চেতনা রণকৌশলের বিধিবদ্ধ পন্থায় যাঁরা পরিচালিত করেন তাঁদের মাধ্যমেই পাকিস্তানি সেনাদের ‘শেরপুর ঘাঁটি’ মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্বার আক্রমণে মুক্ত হয়। আর সেই অভূতপূর্ব সাফল্যের স্মারকস্তম্ভ শেরপুরের কেন্দ্রস্থলে আজ দাঁড়িয়ে আছে। এই সাহসী অভিযান- ‘শেরপুর অপারেশন’ যাঁদের মাধ্যমে সেদিন পরিচালিত হয় তার একটু বর্ণনা নতুন প্রজন্মের জন্যে অবশ্যই অনুসন্ধিৎসার বিষয়।
একাত্তরের রণাঙ্গনে কর্নেল (পরবর্তীতে জেনারেল) এমএজি ওসমানীর পরে চীফ অব স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কর্নেল (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) এম এ রব। তাঁরই নির্দেশনায় এবং মেজর চিত্তরঞ্জন দত্তের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ৫ এপ্রিল ভোরবেলা পাকিস্তানি সেনাদের শেরপুর ঘাঁটি আক্রমণ করেন। তিনি সৈন্যদের কুশিয়ারা নদী অতিক্রমণের জন্য বিশটি নৌকা সংগ্রহ করেন। তাঁর নির্দেশ মতো ১০টি নৌকা শেরপুর ফেরিঘাট থেকে দেড়মাইল ডানে এবং অন্য ১০টি নৌকো শেরপুরের বাঁ দিকে দেড়মাইল দূরত্বে রাখা হলো। মুক্তিযোদ্ধাদের অতি সন্তর্পণে রাতের অন্ধকারে এই নৌকোগুলো দিয়ে পার করা হয়। শুরু হয় গুলিবিনিময়। বেলা যত বাড়তে থাকে গুলির আওয়াজ ততো বেশি শোনা যায়। মাঝে মাঝে ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি আকাশ কাঁপিয়ে তুলছিল। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দেখা গেল পাকিস্তানি সেনারা বাংকার ছেড়ে পালাচ্ছে। এভাবেই শেরপুর মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। পাকিস্তানি সেনারা তখন সাদিপুর অবস্থান করে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে গুলি ছুঁড়তে থাকে। শেরপুর যুদ্ধে ১২ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয় এবং ৩ জন আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের ৩ জন শহীদ হন। স্থানীয় জনসাধারণ শেরপুর যুদ্ধ পরিচালনায় যে অপরিসীম শ্রম, আত্মত্যাগ এবং সহযোগিতা করেছেন মেজর চিত্তরঞ্জন দত্তের একটি লেখা থেকে এ তথ্য জানা যায়। [সূত্র : কৃষ্ণকুমার পালচৌধুরী সম্পাদিত সিলেটকথা (১৯৮৬) গ্রন্থের প্রবন্ধ ‘স্বাধীনতা যুদ্ধে সিলেট ও সিলেটে স্বাধীনতা যুদ্ধ’ : চিত্তরঞ্জন দত্ত] পরবর্তীতে শেরপুরের ন্যায় সিআর দত্তের নেতৃত্বে সাদিপুরও মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। পাকিস্তানি সেনারা ক্রমান্বয়ে সিলেট অভিমুখে যাত্রা শুরু করে।
স্বাধীন বাংলা : নেপথ্যকথা
হবিগঞ্জে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর অভিভাষণে (১৯৭০) আবদুল মন্নান চৌধুরীর প্রসঙ্গ এসেছে। সেই আবদুল মন্নান চৌধুরী ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নবীগঞ্জ এলাকা থেকে আওয়ামীলীগ মনোনীত সদস্য নির্বাচিত হন। লন্ডনে তাঁর হোটেলে মৌলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধুসহ দেশবরেণ্য নেতারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অবস্থান করতেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে এ সময় তাঁরা একটি হোটেল ভাড়া করে থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। উল্লেখ্য যে, আবদুল মন্নান চৌধুরী এক সময় লন্ডন আওয়ামীলীগের সভাপতি ছিলেন। ১৯৮০-র দশকে একবার তাঁর গ্রামের বাড়ি নবীগঞ্জের ঘোলডোবা গ্রামে আমরা তিন বন্ধু তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনি তখন লন্ডন থেকে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। আমরা তাঁর কাছে বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় নেতাদের ইংল্যান্ডে অবস্থানের কথা জানতে চাই। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তিনি এক মন্তব্যে উল্লেখ করেন, ১৯৭০-এর আগে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মৌলানা ভাসানীকে জাতীয় নেতা হিসেবে আমরা বেশি মূল্যায়ন করতাম।
কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মধ্যে যে প্রাণশক্তি, দেশপ্রেম ও সাংগঠনিক ক্ষমতা দেখেছি সেই থেকে আমার ধারণা হয়েছিল যে, তিনি একদিন আমাদের জাতির নেতৃত্ব দেবেন। ওইদিন আমরা তাঁর (জনাব মন্নান) নিকট থেকে মৌলানা ভাসানী, তাজউদ্দিন আহমদ প্রমুখের কয়েকটি গুরুত্বপুর্ণ চিঠি সংগ্রহ করি। দুঃখের বিষয় চিঠিগুলো এখন আর আমাদের সংগ্রহে নেই। আবদুল মন্নান চৌধুরী প্রমুখের আতিথ্যে পূর্ববাংলার অনেক রাজনৈতিক নেতা ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে যেসব কর্মকাণ্ডে শরিক হন বিশেষত মৌলানা ভাসানীর ইউরোপ সফরকে কেন্দ্র করে খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস প্রণীত ‘ভাসানী যখন ইউরোপে’ গ্রন্থে মন্নান চৌধুরীর হোটেলে অবস্থানকারী নেতাদের বিষয়টি আন্তরিকতার সঙ্গে ফুটে উঠেছে।
অতঃপর
বঙ্গবন্ধু নামের সঙ্গে বাঙালি জাতির স্বপ্ন ও অভিযাত্রা সমান্তরাল এগিয়ে চলে। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে জাতির জনক ও তাঁর পরিবারবর্গের নির্মম হত্যাদৃশ্য জাতিকে হতবাক করে। উলটোপথে বাঙালির চিন্তা-চেতনা একদল মানুষ জোর করে নিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের অভিভাষণ, তাঁর ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বদানের সক্ষমতা বিশ্ববাসীর জন্য অপার বিস্ময়। সেই শক্তি ও সাহসে বলীয়ান হয়ে বাঙালিরা আবার বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্যে বদ্ধপরিকর হয়। এই ধারাবাহিকতায় জাতি হিসেবে আমরা আজ বিশ্বের বুকে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছি। শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-অর্থনীতি ও জীবনমান উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতা বিশ্বস্বীকৃতিলাভে সমর্থ হচ্ছে। পাকিস্তানি দোসরদের ছত্রছায়ায় গোটা জাতিকে উলটোপথে পরিচালনার ক‚টকৌশল বেশিদূর স্থায়ী হয়নি। কিন্তু তাঁদের গভীর ষড়যন্ত্র প্রতিনিয়ত লেগেই আছে। এজন্যে স্বাধীনতার মর্মবাণী যাদের অন্তরে প্রজ্জ্বলিত তাদের ঐক্যপ্রয়াস ও নির্ভীক উচ্চারণই পারে নেপথ্যশক্তিকে পেছনে ফেলে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়া। ভাইয়ে-ভাইয়ে বিরোধ থাকতেই পারে। কিন্তু যদি সেটা আত্মঘাতি হয়ে দাঁড়ায় তবে তা বিপত্তির কারণ। গোটা জাতি আজ যেভাবে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে এই যাত্রাপথ সুগম ও সংহত রাখার স্বার্থে এই মুহূর্তে হিংসা-দ্বেষ ভুলে আমাদের একাত্তরের মতই একাট্টা হতে হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা এই ঐক্যপ্রচেষ্টার স্মারক হতে পারে।
অধ্যাপক ড. আবুল ফতেহ ফাত্তাহ, কবি, শিক্ষাবিদ ও গবেষক
- খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আইনিউজে দেখুন আরও ভিডিও খবর
মনে আছে অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের কথা? (ভিডিও)
বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মহসিন আলী
ঘুরে আসুন মৌলভীবাজারের পাথারিয়া পাহাড়
মৌলভীবাজারের বিস্ময় বালিকা : ১৯৫ দেশের রাজধানীর নাম বলতে পারে
মৌলভীবাজারের সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী ভারত সরকারের পদ্মভূষণ পদকে ভূষিত
এছাড়াও যে কোনও ভিডিও সংবাদের জন্য ভিজিট করুন আইনিউজের ভিডিও আর্কাইভস।
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ