Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ১০ এপ্রিল ২০২৫,   চৈত্র ২৭ ১৪৩১

দীপংকর মোহান্ত

প্রকাশিত: ২৩:০৯, ২৪ মার্চ ২০২২
আপডেট: ২৩:২০, ২৪ মার্চ ২০২২

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর

একাত্তরের বীরাঙ্গণা: সিঁথির সিঁদুর মুছে যাওয়া এক ‘হরি দাসী’র কথা

একাত্তরের বীরাঙ্গণা হরিপ্রিয়া দাস

একাত্তরের বীরাঙ্গণা হরিপ্রিয়া দাস

...চোখের সামনেই প্রিয়তম স্বামী নরেশ দাসকে হত্যা করা হয়। তিনি দৃশ্য দেখে চোখ বন্ধ রাখেন। ছোট শিশুটি মাকে আকড়ে ধরে লুকিয়ে থাকে বুকে। রাজাকার ও খান সেনা এসে ছেলেটাকে বুক থেকে টেনে ফেলে ছুড়ে দেয় নদীতে।

প্রিয় পাঠক, কবি শামসুর রাহমানের সেই বিখ্যাত ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ কবিতার একটি পংক্তি ‘সিঁথির সিঁদুর গেল হরি দাসীর’ কথা নিশ্চয় মনে আছে। কবি একটি লাইনের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের হায়নাদের নির্মম গণহত্যা ও নিঠুর অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরেছেন। কবির কল্পনার হরি দাসী হয়তো লাখো-লাখো কপাল ভাঙা ‘হরি দাসী’র প্রতিনিধি হয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ছে।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর অবহেলিত হরিদাসীদের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। তাঁদের খবরাদি সমাজ-রাষ্ট্র-পরিবার কেউ-ই কখনো রাখার প্রয়োজনবোধ করেনি। উন্নয়নের সড়ক পথে আমরা কেবল-ই হাঁটছি। কোন্ হরিদাসীর কে খরব রাখে? বিশ্বায়নকালে সময় বা কই? আমাদের ‘হরি দাসী’র নামের মধ্যে সামান্য পার্থক্য আছে। তাঁরও কপাল ভাঙা; খবর রাখেনি কেউ। শামসুর রাহমান বেঁচে থাকলে তাঁর সামনে হাজির করা যেত।

বীরাঙ্গণা হরিদাসীর পুরো নাম হরিপ্রিয়া দাস। একাত্তরের ভাগ্য বিড়ম্বনায় এখন তিনি একটি আখড়ার দাসী হয়ে বেঁচে আছেন। তাঁর বুকের ভেতরের চাপা আগুন দাউ-দাউ করলেও আজ তা ছাই হয়ে ভগবৎ প্রেমের সাথে যেন একাকার হয়ে গেছে। প্রিয় পাঠক, ছবিতে এই হরি প্রিয়ার কপালে যে লম্বা তিলক দেখছেন (গৌড়ীয়) একাত্তর সালের ভাদ্র মাস পর্যন্ত এই কপালে ছিল রাজটিকার মতো রক্তিম আভার সিঁদুরের ফোঁটা। সাথে একমাত্র ছোট ছেলে থাকতো। লম্বা ছিপছিপে গঠন; কাঁচাসোনা রং। টিকরে পড়তো যৌবণের লাবণ্যরূপ। অল্প বয়সে বিয়ে। একেবারে রাধারমণের সাধন স্থান নলুয়ার হাওর পাড়ে। তবে  ছোট বেলা থেকে সংগ্রাম করে আসছেন। পিতার বাড়ি হবিগঞ্জের বানিয়াচঙ হলেও বড় হয়েছেন নবীগঞ্জ থানায় মামার বাড়িতে।

হরিপ্রিয়া দাসের স্বামীর নাম নরেশ দাস। গ্রামের বাড়ি - নলোয়া-নোয়াগাঁও (দাস নোয়াগাঁও), ইউনিয়ন: চিলাউড়া-হলদিপুর, উপজেলা: জগন্নাথ পুর, সুনামগঞ্জ। পাকসেনারা যখন জগন্নাথপুর, রাণিগঞ্জ, সিরামিশি প্রভৃতি জায়গায় আক্রমণ চালায়- তখন প্রাণ ভয়ে লোকজন নৌকাযোগ সীমান্তে ভিড়ার চেষ্টা করে। সুনামগঞ্জে তখন নৌকার বিকল্প  কোনো যাতায়াত ব্যবস্থা ছিলনা। ফলে নৌকায় যাতায়াতে সময় লাগে বেশি। আমাদের অনুসন্ধানে ধরা পড়েছে যে, হবিগঞ্জ-কিশোরগঞ্জ-নেত্রকোণা-ময়মনসিংহ থেকে হাজার হাজার শরণার্থী পরিবার নৌকা যোগে সুনামগঞ্জ হয়ে মেঘালয়- আসাম প্রভৃতির দিকে প্রাণ বাঁচাতে পথ ধরেছিল। কিন্তু পথিমধ্যে পাককবাহিনী ও তাদের সহকারি রাজাকার হিসেবে সুনামগঞ্জের আব্দুল খালিক বাহিনী  (দৌলতপুর, শাল্লা), ফকির চেয়াম্যানের বাহিনী (ছাতক), লাল মিয়ার বাহিনী (জামালগঞ্জ), সাত্তার বাহিনী (জয়কলস) প্রভৃতি অসংখ্য শরণার্থীকে হাওরে ও নদীপথে হত্যা করে, মালামাল লোট করে এবং নারীদের অপহরণ করে নিয়ে যায়। তখন তাদের জয়জয়কার অবস্থা। নিয়ন্ত্রণহীন রাজাকাররা নিজের ইচ্ছে মতো যা খুশি তাই করেছে।

সুনামগঞ্জে যে পরিমান শরণার্থী হত্যা করা হয়েছে তা অন্য জায়গায় হয়েছে বলে মনে হয় না। সুনামগঞ্জ দিয়ে ভারতে পৌঁছাতে অনেক সময় লাগতো। পথে মধ্যে খাপটি মেরে থাকা রাজারের জালে তারা আটকা পড়তো। প্রথম দিকে নদী-হাওরে রাজাকারের আদিপত্য ছিল বেশি। যে কারণে হাওর অঞ্চলে শহিদের নাম যেমন পাওয়া যায় না তেমনি বধ্যভ‚মি চেখে পড়ে না। সকলের সলিল সমাধি হয়েছে।

ভয়ে ভীত নলুয়ার লোকজন ভাদ্র মাসে ধান পরিবহনের নৌকায় ওঠে যাত্রা করেন।  সেই নৌকায় ছিলেন হরিপ্রিয়া দাস ও তার স্বামী এবং সন্তান। তাদের উদ্দেশ্যে ছিল টেকের ঘাট যাওয়া। যাত্রী সংখ্যা হবে প্রায় পঞ্চাশ জন।  মেয়েরাও ছিল। নৌকাটি হাওর পথ ধরে চুপি সারে চলে এসে যখন সাচনা বাজরের দিকে সুরমা নদতে পড়েছে (স্থানীয়ভাবে অনেকে বলে ধনু নদী) তখন-ই শকুণিদের চোখ পড়ে নৌকার ওপর। নদীর তীর থেকে গুলি গুলি ছুঁড়ে মাঝিকে প্রথমে হত্যা করা হয়। তার লাল রক্তে নদীর পানি লাল হয়ে যায়। মাঝি কয়েকবার লাফ দিয়ে ছটফট করে নদীতে নিথর হয়ে তলীয়ে যায়। কেউ কখনো তাঁর নাম আর জানবে না। মাঝিহীন নৌকাটি পরে তীরে ভীড়ে। তখন নদীর পাড়ে কয়েকজন পুরুষকে গুলি করে হত্য করা হয়। সুন্দরী হরিপ্রিয়া দিকে তাঁদের কুনজর পড়ে। তাঁর চোখের সামনেই প্রিয়তম স্বামী নরেশ দাসকে হত্যা করা হয়। তিনি দৃশ্য দেখে চোখ বন্ধ রাখেন। ছোট শিশুটি মাকে আকড়ে ধরে লুকিয়ে থাকে বুকে। রাজাকার ও খান সেনা এসে ছেলেটাকে বুক থেকে টেনে ফেলে ছুড়ে দেয় নদীতে। প্রিয়বালা ছেলেটাতে ধরার চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ। ছেলেটি ‘মা মা’ চিৎকার করে একসময়  চিরতরে আশ্রয় নেয় গঙ্গা-মায়ের কোলে। ছেলের নাম ছিল হরি দাস; বয়স আট মাস।

চোখের পলকেই নিজের সামনেই স্বামীর মৃত্যু, ছেলের মৃত্যু দেখে অঝোর কান্না করছেন। কিন্তু তাঁকে ধরে রেখেছে পশুরা; একটু পরে তার মাংস তারা খুবলে খাবে। হরিপ্রিয়ার ঠাঁই জয় সাচনা বাজারের সেনা ক্যাম্পে। অবেশেষে তাঁকে লথি মেয়ে নিচে ফেলা হয় এবং তাঁকে ঘিরে চলে বর্বরদের আদিম ও উন্মদ নৃত্য...। তখন তার কিছু করার ছিল না। জ্ঞান হারান। পাশেই দেখেন আরো অনেক নারী। তারা অনেকেই কচি মেয়ে। হরিপ্রিয়া সারা দিন-রাত ক্যাম্পে রাখা হয়। অবশেষ বহু কষ্টে তিনি মুক্তি পান।

দেশ স্বাধীন হলো কে রাখে হরিপ্রিয়ার খবর? উন্মাদের মতো ছিলেন। প্রিয় স্বামী ও সন্তানের মুখ তিনি ভুলতে পারেন নি। অথচ পেঠে দানা-পানি দেওয়ার মতো অবস্থা ছিলনা। পরিবারের কেউ নেই, কে খাওয়াবে? সিঁথিতে সেই লালটুকটুকে সিঁদুরও নেই। তখন হরিদাসীর অন্য জীবন। পালাগান, ধর্মীয় গান করে স্থানে স্থানে গিয়ে পেঠের জ্বালা মেঠাতেন। এবদিন হয়ে গেলেন বৈষ্ণব। নিলেন আখড়াতে ঠাই। তাঁর অন্তরের কথা কেউ জানেনি।

আজ বিশ বছর বছর হলো- হরিপ্রিয়া নবীগঞ্জ উপজেলার এক আখড়াতে ঠাঁই নিয়েছেন। আখড়াতে নারী দাসী (ঈশ্বরের) হিসেবে থাকেন। দেখার কেই নাই। শুধুই ভগবান ভরসা। এইতো আমাদের বীরঙ্গণাদের বিড়ম্বিত জীবন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যারা সোনালী মোড়কে বড়লোক হয়েছেন তাদের কাছে হরিদাসীরা মূল্যহীন কিংবা অপাংক্তেয় থাকে। অথচ তাদের ত্যাগের কারণে আমরা স্বাধীন। আর কপাল ভাঙা হরিদাসীরা মর্যদাহীন। তারা মুখ লুখিয়ে থাকেন। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও আমারা তাদের খুঁজে বের করতে পারিনি। বীরাঙ্গাণের মর্যাদা সুন্দর করে দিতেও পারিনি।

কিন্তু হরিদাসীরা জানে যে তাদের কপাল কখনো জোড়া লাগবে না। স্মৃতির গভীরে গেলে হয়তো কখনো নীরবে কান্না করেন। একদিন এই কান্নাও চিরতরে থেমে আসবে।

দীপংকর মোহান্ত, লেখক ও গবেষক

আইনিউজ ভিডিও 

মানসিক চাপ কমাবেন যেভাবে

বয়স পঞ্চাশের আগেই বাড়ে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা

খালি পেটে ঘুমালে যেসব ক্ষতি হয়

Green Tea
সর্বশেষ
জনপ্রিয়