Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ১০ এপ্রিল ২০২৫,   চৈত্র ২৭ ১৪৩১

মো. নাসির উদ্দিন খোন্দকার

প্রকাশিত: ১৮:৫২, ৩১ মার্চ ২০২২
আপডেট: ১৮:৫৪, ৩১ মার্চ ২০২২

নারীর শ্লীলতাহানি ও আমাদের করণীয়

মো. নাসির উদ্দিন খোন্দকার

মো. নাসির উদ্দিন খোন্দকার

এঙ্গেলস তার ''অরিজিন অব দ্য ফ্যামিলি' গ্রন্থে বলেছেন, ''নারী মুক্তি তখনই সম্ভব, যখন নারীরা সমাজের প্রতিটি কর্মকাণ্ডে সমগুরুত্ব নিয়ে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে'

‘শ্লীলতা’ শব্দের অর্থ ভদ্রতা, শিষ্টতা। ‘শ্লীলতাহানি’ শব্দের অর্থ ভদ্রতানাশ বা শিষ্টতানাশ। সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘শ্লীলতাহানি’ শব্দটি উচ্চারণ করলে যে মানুষের মুখ ভেসে ওঠে, তা পুরুষ নয়, তা নারীর। এটি সংঘটিত একধরনের অপরাধ। এক ধরনের যৌন আগ্রাসন, যার মধ্যে রয়েছে যৌন ইঙ্গিতবাহী মন্তব্য, প্রকাশ্যে অযাচিত স্পর্শ, শিস দেওয়া বা শরীরের সংবেদনশীল অংশে হস্তক্ষেপ। অন্যদিকে ধর্ষণ হলো বেআইনী যৌন ক্রিয়াকলাপ। সাধারণত জোর করে বা কোনো ব্যক্তির ইচ্ছার বিরুদ্ধে আঘাতের হুমকির মাধ্যমে তা সংঘটিত হয়।

দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আবশ্যক। বাবা তার কন্যাকে, স্বামী তার স্ত্রীকে সর্বোচ্চ নিরাপদে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু নারীদের প্রতি নৈতিকতাহীন কিছু মানুষের অমানুষিক নির্যাতন, শ্লীলতাহানি কিংবা ধর্ষণের মতো ঘটনা নারীর নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করেছে যুগে যুগে। নারীরা প্রায় প্রতিদিনই নির্যাতিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে থাকছে না বয়স, স্থান, কাল, পাত্র এমনকি সময়ের ভেদ। সময়ের সাথে সাথে নির্যাতনের ক্ষেত্রে যুক্ত হচ্ছে নতুন মাত্রা।

রাষ্ট্রে প্রত্যেক নারী-পুরুষের স্বাধীনভাবে চলা-ফেরা করা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। একুশ শতকে পদার্পণ করে বর্তমান বিশ্ব যে সমাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক পালাবদলে অংশ নিচ্ছে, নারী সেখানে এক অপরিহার্য অংশীদার, জীবনযুদ্ধেও অন্যতম শরিক ও সাথী। এককালে মাতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীরা ছিলো প্রধান; কিন্তু পরবর্তীকালে সমাজে পুরুষের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলে নারী হয়ে পড়ে অন্তপুরবাসী। আধুনিককালে নারীর স্বতন্ত্র মানবিক ভূমিকা স্বীকৃত বিশ্বব্যাপী।

এঙ্গেলস তার ''অরিজিন অব দ্য ফ্যামিলি' গ্রন্থে বলেছেন, ''নারী মুক্তি তখনই সম্ভব, যখন নারীরা সমাজের প্রতিটি কর্মকাণ্ডে সমগুরুত্ব নিয়ে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে', আর নারীকে মুক্তি দেওয়ার জন্য, নারীর উন্নয়নের জন্য, এক কথায় নারীর ক্ষমতায়নের জন্য প্রয়োজন সব ধরনের প্রতিবন্ধকতার অবসান। প্রয়োজন শিক্ষার প্রসার ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি। বর্তমান সভ্য সমাজে শিক্ষা ছাড়া সবই অচল। কোনো স্বাধীন জাতির পক্ষে নিরক্ষর ও মূর্খ থাকা এবং বিশ্বজগৎ, জীবন ও পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে অজ্ঞতা থাকা জাতীয় মর্যাদার পক্ষেও হানিকর।

পৃথিবীর যেকোনো বড়ো সামাজিক দায়িত্ব পালন করে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও নারীর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। ইভ টিজিং এ ক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে একটি বড় প্রতিবন্ধক। ব্যক্তিগতভাবে এর শিকার বেশিরবাগ ক্ষেত্রে কিশোরী-তরুণীরা এসব ক্ষেত্রে লজ্জা গোপন করার জন্য অনেকসময় আত্মহত্যাও ঘটায়। অনেকক্ষেত্রে ভিকটিমরা এ সম্পর্কে পুলিশের কাছে অভিযোগ করতেও ভয় পায়। সমাজের এ অবক্ষয় প্রতিরোধ করতে, নারীর নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষা করতে যুবসমাজের সঠিক মনুষ্যত্ববোধ ও নৈতিকতা শিক্ষা ও চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সুস্থ জীবন থেকে আলাদা হয়ে আদর্শহীন এসব কিশোর তরুণরা ঝুঁকে পড়ে অবক্ষয়ের গহীন আবর্তে। এ থেকে তাদের রক্ষা করতে পরিবার ও আমাদের সকলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

বাংলাদেশ, চীন, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা এবং পাপুয়া নিউগিনির মোট ১০,০০০ পুরুষের সাক্ষাৎকার নিয়ে জানা গেছে, তাদের প্রায় এক-চতুর্থাংশই কোনো না কোনো সময়ে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের সাথে কোনো না কোনোভাবে জড়িত ছিলো। ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির ওপর জাতিসংঘের এটিই প্রথম বড়ো আকারের কোনো জরিপ। জরিপের ফলাফল থেকে অনুমান করা যায়, এশিয়ার এ দেশগুলোতে শারীরিক নির্যাতনের মাত্রা কতটা বেশি। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও, ৬টি দেশের ১০,০০০ পুরুষের এক-চতুর্থাংশ নিজেরাই স্বীকার করেছে তাদের দ্বারা সংঘটিত ধর্ষণের কথা। ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথ নামে প্রতিষ্ঠানের চালানো জরিপে আরও দেখা গেছে নারীরা তাদের ঘনিষ্ঠজন দ্বারাই নির্যাতনের শিকার হন বেশি।

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক যে কোনো আইনে নারীর ওপর অত্যাচারের বিচার করা সরকারের দায়িত্ব। সিডো সনদের ১ অনুচ্ছেদের ৬ ধারায় বলা হয়েছে, ''শরিক রাষ্ট্রগুলো নারীকে সব ধরনের অবৈধ ব্যবসায় এবং দেহ ব্যবসার আকারে নারীর শোষণ দমন করার লক্ষ্যে আইন প্রণয়নসহ সব উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে'। দেশীয় আইনেও এমন অনৈতিক কাজের বিচারের ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮(২) ও ৩৪(১) অনুযায়ী গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা নেবে। এতে বলা হয়েছে সব ধরনের জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ ও আইনত দণ্ডনীয়। ইভ টিজিং দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৫০৯ ধারায় দণ্ডনীয় অপরাধ এবং দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩)-এ শাস্তির বিধান রয়েছে। এ আইনের ১০ ধারায় যৌনপীড়নের শাস্তি হিসেবে অনধিক ১০ বছর, কিন্তু অনূ্র্ধ্ব ৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে এবং তার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডও রয়েছে।

আর যদি নারীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে বা অশোভন অঙ্গভঙ্গি করে, তাহলে অনধিক ৭ বছর অনূ্র্ধ্ব ২ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং তার অতিরিক্ত অর্থদণ্ড প্রদানের বিধান রয়েছে। ওই আইনের ৯ ধারা অনুসারে ধর্ষণের শাস্তি হলো, ধর্ষণের কারণে বা ধর্ষণের পর অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ভিক্টিম মারা গেলে ধর্ষণকারীকে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড প্রদানের বিধান রয়েছে। কোনো নারী বা শিশুকে একাধিক ব্যক্তি মিলে ধর্ষণ করলে এবং সেই নারী বা শিশু মারা গেলে বা আহত হলে প্রত্যেক ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড প্রদানের বিধান রয়েছে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, ধর্ষণকারী কিন্তু ভিনগ্রহ থেকে আগত কোনো জীব নয়, সে আমাদেরই কারও না কারও আত্মীয়, কারও না কারও সন্তান, কারও ভাই, কারও স্বামী। শৈশব থেকেই যেন পরিবারের ছেলে সন্তানটি নারীকে সম্মান করতে শেখে, নারীকে পুরুষের সমপর্যায়ের ভাবতে শেখে এ শিক্ষা তাকে পরিবার থেকে দিতে হবে। ধর্ষণ নারীর একার সমস্যা নয়। এটা সমগ্র সমাজেরই সমস্যা, রাষ্ট্রের সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানের দায় যেমন রাষ্ট্রের, তেমনি প্রতিটি নাগরিকেরও বটে। একজন পুরুষকেও যেন ধর্ষক হিসেবে দেখতে না হয় আমাদের এ লক্ষ্য নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে সামনে।

নারীর জন্য ঘরে ও ঘরের বাইরে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে আমাদের। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি, সামাজিক সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবক সমিতি ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের যৌথ উদ্যোগে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নৈতিকমানের অবক্ষয় প্রতিরোধে সকলের কাজ করতে হবে একসাথে। নারীর শ্লীলতাহানি রোধ করে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রচেষ্টা ও সদিচ্ছা সর্বোচ্চ থাকতে হবে। প্রয়োজন আমাদের অঙ্গীকার, সম্মিলিত উদ্যোগ এবং আন্তরিক প্রয়াস।

মো. নাসির উদ্দিন খোন্দকার, সহকারী তথ্য অফিসার, পিআইডি, ঢাকা

 

আইনিউজ ভিডিও 

মানসিক চাপ কমাবেন যেভাবে

বয়স পঞ্চাশের আগেই বাড়ে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা

খালি পেটে ঘুমালে যেসব ক্ষতি হয়

Green Tea
সর্বশেষ
জনপ্রিয়