আজিজুল আম্বিয়া
আপডেট: ১৪:১১, ১৫ এপ্রিল ২০২২
বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা
আজিজুল আম্বিয়া
১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাতে যখন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে বর্তমান পাকিস্তানে নিয়ে যায় হায়নারের দল। সেই সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন হয়ত এখানেই সমাপ্তি হয়ে যাবে পশ্চিমারা ভেবেছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার পূর্ব তাঁর হাতে লেখা স্বাধীনতার পত্রটি যখন আওয়ামীলীগ নেতা এম এ হান্নান এবং পরবর্তীতে সাবেক মেজর জিয়াউর রহমান পাঠ করেন তখন থেকেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
এই যুদ্ধকালীন সময়ে একটি দেশের নেতৃত্ব কে দেবে? নিশ্চয় একটি সরকার দরকার। কারণ মাঝিবিহিন নৌকা যেমন কল্পনা করা যায়না তেমনি একটি সরকার ছাড়া দেশ পরিচালনা সম্ভব নয়। তাই কৌশলী বীর বাঙ্গালীরা গঠন করল বাংলাদেশের খুলনা বিভাগের মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরে (উল্লেখ্য, বৈদ্যনাথতলা ইউনিয়নের ভবেরপাড়া গ্রামের নাম পরিবর্তন করেই মুজিবনগর রাখা হয়) ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার। বাংলার আলোকিত মানুষের আলোকিত ঘটনার সাক্ষী এই মুজিবনগর এলাকা । আর এই সরকার হল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশের প্রথম অস্হায়ী সরকার । এই সরকার ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ ইং তারিখে শপথ গ্রহণ করে। সেখানে ‘ডিক্লারেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্স’ পাঠ করলেন গণপরিষদের স্পিকার অধ্যাপক ইউসুফ আলী। তিনিই ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীদের শপথ বাক্য পাঠ করান। সেই সময় থেকে সরকারি নথিতে লেটার হেডে লেখা থাকত ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার,মুজিবনগর’। আর এই সরকারের দাপ্তরিক সব কাগজপত্রের ঠিকানা ছিল মুজিবনগর। বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী হিসেবে এটি ঐতিহাসিক স্হানের মর্যাদা লাভ করেছে । সর্বপ্রথম এখান থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশে সরকারের কথা কার্যত সারা বিশ্ব আনুষ্ঠানিক ভাবে জানল।
তাৎক্ষনিকভাবে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমান জেলে থাকায় তাঁর অনুপস্তিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাংবাদিক ও উপস্থিত জনসাধারণের সম্মুখে মন্ত্রীপরিষদের সদস্যদের নাম ঘোষণা করেন। এই সরকারের রাষ্ট্রপতি হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকায় তাঁর অনুপস্তিতে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় । প্রধানমন্ত্রী হন তাজউদ্দীন আহমদ। তাকে দায়িত্ব দেয়া হয় প্রধানমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষা,তথ্য, সম্প্রচার ও যোগাযোগ, অর্থনৈতিক বিষয়াবলী,পরিকল্পনা বিভাগ,শিক্ষা, স্হানীয় সরকার, স্বাস্হ্য, শ্রম, সমাজকল্যাণ, সংস্থাপন এবং অন্যান্য যেসব কারো উপর ন্যস্ত হয়নি তা । পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হন খন্দকার মোশতাক আহমদ। অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হন এম মনসুর আলী। স্বরাষ্ট্র,সরবরাহ,ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হন এ এইচ এম কামরুজ্জামান এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীর নাম ও ঘোষণা করা হয় । এই মুজিবনগর সরকারের অধীনেই পরিচালিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম। তাই এই সরকারের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনেক বেশি।
বাংলাদেশের শোষিত, নিপীড়িত ও নির্যাতিত জনতার মুক্তির জন্য অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সমর্থনের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনে মুজিবনগর সরকার যে ভূমিকা রেখেছে তা অত্যন্ত প্রশংসার দাবিদার। তৎকালীন যুদ্ধাবস্হায় নেতৃত্ব , দেশবিদেশের ব্যাপক সমর্থন আদায়, নিজস্ব আয় ও ব্যয়ের ব্যবস্হা, পরিকল্পিতভাবে যুদ্ধ পরিচালনা, এ ছাড়া প্রায় এক কোঠি শরণার্থীর জন্য ত্রাণের ব্যবস্হা করা, বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে জনগণকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করা ছিল উল্লেখযোগ্য কাজ। উল্লেখ্য ২০ অক্টোবর মন্ত্রীপরিষদের সচিবের এক প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা যায়,মুজিবনগর সরকার পরবর্তীতে সম্প্রসারিত হয় এবং বহির্বিশ্বে সরকারের বিশেষ দূত নিযুক্ত হয়েছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী । সামরিক প্রশাসন নিয়ন্ত্রিত হতো প্রতিরক্ষা মন্ত্রিনাল্যের মাধ্যমে। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এসবের তদারকি করতেন। এ মন্ত্রণালয়ের সচিব ও উপসচিবের দায়িত্ব পালন করেন যথাক্রমে আব্দুস সামাদ এবং আকবর আলী খান। অভ্যন্তরীণ সামরিক প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল সশস্ত্র বাহিনীর দপ্তর পরিচালনা । এ দপ্তরই ছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধান ও মুল অঙ্গ সংস্থা।
সশস্ত্র বাহিনী দপ্তরের প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হয়েছিলেন কর্নেল আতাউল গনি ওসমানী । এ ছাড়া সেনাপ্রধান ছিলেন লে.কর্নেল আব্দুর রব, উপপ্রধান সেনাপতি ও বিমান বাহিনী প্রধান ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে.খন্দকার,মেডিকাল সার্ভিসেস- এর মহাপরিচালক ছিলেন কর্নেল সামছুল হক। তাদের কাজ সমূহ ছিল সমগ্র যুদ্ধ অঞ্চলকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে তাতে অধিনায়ক নিযুক্ত করা এবং যুদ্ধ পরিচালনা তদারকি করা, তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের সাথে সহযোগিতা রেখে কাজ করা, স্বাস্হ্যমন্ত্রণালয়ের সাথে সহযোগিতা বজায় রেখে নিয়মিত বাহিনী ও গণবাহিনীর জন্য চিকিৎসা ও তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করা এবং সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সাহসিকতাস্বরূপ পুরস্কার প্রধান ইত্যাদি কাজ। এ ছাড়া বেতার কেন্দ্র থেকে যুদ্ধের খবর, পাকবাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের খবর প্রচার করা। বহির্বিশ্বে সরকারের মিশন স্হাপন ও তাতে প্রতিনিধি নিয়োগ করে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রচারণা ও সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করা।
বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধি প্রেরণ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন লাভের চেষ্টা অব্যাহত রাখা । জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের জন্য সরকার ১৯৭১ সালের অক্টোবরে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৬ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে । ২৬ জুলাই হাউজ অব কমন্সের হারকোর্ট রুমে স্বাধীন বাংলাদেশের ৮ টি ডাক টিকিট প্রকাশ উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় এই সরকারের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে । বিদেশে চিঠিপত্র পাঠাতে ভারত সরকার এই ডাক টিকিট সমূহ ব্যবহারের অনুমতি দেয়। এর ফলে বাংলাদেশ সর্বপ্রথম স্বাধীন দেশের মর্যাদা পায়। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বিদেশে তহবিল সংগ্রহ করা এবং তাঁর সঠিক ব্যবহারের কারণে স্বাধীনতা সংগ্রাম ধীরে ধীরে আমাদের অনুকূলে আসতে বাধ্য হয়। মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রবাসে ও প্রবাসী বাঙ্গালীদের নিয়ে আন্দোলন ও জনমত গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে এই সরকার । তাদের মধ্যে লন্ডন প্রবাসীদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য।
তৎকালীন সময়ে বাঙ্গালীর প্রিয় অভিভাবক বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগারে যাতে হত্যা না করে হায়নারেরা সে বিষয়েও আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করে এই সরকার। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অবশেষে বাঙ্গালী লাভ করে তাদের কাঙ্খিত বিজয় । দেশ স্বাধীন পরবর্তী সময় ও বঙ্গবন্ধুকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ও এই সরকার বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাই এই সরকার যে আমাদের জন্য একটি আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল তা বলার অপেক্ষা রাখেনা । কিন্তু জাতি চায় এর একটি সঠিক ইতিহাস সরকারি উদ্দ্যোগে লিপিবদ্ধ হোক।এর ধারাবাহিকতায় তাজউদ্দীনের সন্তান সুহেল তাজ এর নেতৃত্বে শুরু হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচির । আশা করছি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার বিষয়টি গুরুতসহকারে দেখবে ।যদি এই ইতিহাস এখন পূর্নাঙ্গ লিপিবদ্ধ না হয় তাহলে তা ভবিষ্যতে বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এই ইতিহাসকে নিরাপদ রাখা সরকারের গুরু দায়িত্ব আমি মনে করি।
আজিজুল আম্বিয়া, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
আইনিউজে দেখুন আরও ভিডিও খবর
মনে আছে অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের কথা? (ভিডিও)
বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মহসিন আলী
ঘুরে আসুন মৌলভীবাজারের পাথারিয়া পাহাড়
মৌলভীবাজারের বিস্ময় বালিকা : ১৯৫ দেশের রাজধানীর নাম বলতে পারে
মৌলভীবাজারের সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী ভারত সরকারের পদ্মভূষণ পদকে ভূষিত
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ