কবির য়াহমদ
সামাজিক মাধ্যম ও শিশুর প্রতি সংবেদনশীলতা
কবির য়াহমদ
পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে একটি শিশুর অসম্পূর্ণ বক্তব্যের একটা ভিডিয়ো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। একাত্তর টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে শিশুটি বলেছে - ❛পহেলা বৈশাখ মানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পহেলা বৈশাখ মানে...❜ এরপর তাকে আর কিছু বলতে দেওয়া হয়নি। তার কথা সম্পূর্ণ করার আগেই ক্যামেরা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। অসম্পূর্ণ ভিডিয়োর ওই অংশ দিয়েই সামাজিক মাধ্যমে তোলপাড় চলছে। ওই বক্তব্য বঙ্গবন্ধুর নাম আছে বলে এটা নিয়ে ট্রল চলছে। এই ট্রলের কারণ একটাই—❛বঙ্গবন্ধু❜!
শিশুটির বক্তব্য পূর্ণাঙ্গ হলে সে কী বলতো আমরা জানি না। হয়তো সে গুছিয়ে বলতো, নয়তো অসংলগ্ন কিছু বলতো। বক্তব্য পূর্ণাঙ্গ হয়নি শেষ পর্যন্ত সে কী বলতো আমরা জানি না। তবে যেকোনো বিষয়কে বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধৃত করার একটা চল বর্তমানে প্রচলিত, এখানে সেই চলের ব্যতিক্রম কিছু কি-না আমরা জানি না। তবে শিশুটি যেভাবে বলতে শুরু করেছিল তাতে দেখা যায় তার অনেক কিছু হয়তো বলার ছিল। ❛পহেলা বৈশাখ মানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পহেলা বৈশাখ মানে...❜ অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ নিয়ে তার বলার কিন্তু শেষ হয়নি। আরও অনেক বলার ছিল, তাকে সে সুযোগ দেওয়া হয়নি।
কোন বিশেষ দিন মানে... এইভাবে অনেকে অনেক কিছু বলে থাকেন। এই বলার মধ্যে সংশ্লিষ্ট বক্তার আবেগ থাকে, নানা বিশেষণের ব্যবহার থাকে। আবেগ-বিশেষণ শেষে এরপর বের হয়ে আসে প্রকৃত বক্তব্য। এজন্যে পুরোটা শুনতে হয়, শোনানোর দায়িত্ব নিলে সেটা শোনানোর ব্যবস্থা রাখতে হয়। কিন্তু সেটা করেননি টেলিভিশন চ্যানেলটির ওই প্রতিবেদক। বক্তব্য শেষের আগে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ওই প্রতিবেদক কি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছেন? এরমাধ্যমে সাংবাদিকতাকে কি প্রশ্নের মুখে ফেলে দেননি? শিশুটিকে সামাজিকভাবে হেনস্তা করার সর্বোচ্চ কাজটুকু কি এর মাধ্যমে সম্পাদন হয়নি? অসম্পূর্ণ এই বক্তব্যের কারণে শিশুটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়েছে, সামাজিকভাবে হেয় হয়েছে, তার পরিবারের মানহানি হয়েছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ❛কারাগারের রোজনামচা❜ বইটি যারা পড়েছেন তারা জানেন কারাগারেও বঙ্গবন্ধুর নববর্ষ উদযাপনের নজির আছে। ষাটের দশকে পহেলা বৈশাখ বা বর্ষবরণ বাঙালির সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একটা অংশ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৬৭ সালে যে বছর রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসব শুরু হয়েছিল সে বছর বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। তখন পহেলা বৈশাখ ১৫ এপ্রিল পালিত হতো, পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে আশির দশকে বাংলা পঞ্জিকার সংস্কার সাধন করে পহেলা বৈশাখকে ১৪ এপ্রিল নির্ধারণ করা হয়।
❛কারাগারের রোজনামচা❜ গ্রন্থের ❛১৪ই এপ্রিল-১৫ই এপ্রিল ১৯৬৭❜ অংশে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ❛❛আজ বাংলা নববর্ষ, ১৫ই এপ্রিল। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি নুরে আলম সিদ্দিকী, নুরুল ইসলাম আরও কয়েকজন রাজবন্দি কয়েকটা ফুল নিয়ে ২০ সেল ছেড়ে আমার দেওয়ানিতে এসে হাজির। আমাকে কয়েকটা গোলাপ ফুল দিয়ে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাল। ২৬ সেল হাসপাতাল থেকে বন্ধু খোন্দকার মোশতাক আহমদও আমাকে ফুল পাঠাইয়াছিল। আমি ২৬ সেল থেকে নতুন বিশ সেলে হাজী দানেশ, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, হাতেম আলি খান, সিরাজুল হোসেন খান ও মৌলানা সৈয়াদুর রহমান সাহেব, ১০ সেলে রফিক সাহেব, মিজানুর রহমান, মোল্লা জালালউদ্দিন, আবদুল মোমিন, ওবায়দুর রহমান, মহিউদ্দিন, সুলতান, সিরাজ এবং হাসপাতালে খোন্দকার মোশতাক আহমদকে ফুল পাঠাইলাম নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে। শুধু পাঠাতে পারলাম না পুরানা হাজতে, যেখানে রণেশ দাশগুপ্ত, শেখ ফজলুল হক (মণি)—আমার ভাগনে, হালিম, আবদুল মান্নান ও অন্যরা থাকে—এবং ১/২ খাতায় যেখানে শ্রমিক নেতারা, ওয়াপদার কর্মচারী ও কয়েকজন ছাত্র থাকে। জেলের ভিতর অনেক ছোট ছোট জেল; কারও সাথে কারও দেখা হয় না—বিশেষ করে রাজনৈতিক বন্দিদের বিভিন্ন জায়গায় রাখা হয়েছে। এরা তো ❛রাষ্ট্রের শত্রু❜!
বিকালে পুরানা বিশ সেলের সামনে নুরে আলম সিদ্দিকী, নুরুল ইসলাম ও হানিফ খান কম্বল বিছাইয়া এক জলসার বন্দোবস্ত করেছে। বাবু চিত্তরঞ্জন সুতার, সুধাংশু বিমল দত্ত, শাহ মোয়াজ্জেমসহ আরও কয়েকজন ডিপিআর ও কয়েদি, বন্দি জমা হয়ে বসেছে। আমাকে যেতেই হবে সেখানে, আমার যাওয়ার হুকুম নাই তবু আইন ভঙ্গ করে কিছু সময়ের জন্য বসলাম। কয়েকটা গান হলো, একজন সাধারণ কয়েদিও কয়েকটা গান করল। চমৎকার গাইল। শিক্ষিত ভদ্রলোকের ছেলে, প্রেম করে একজনকে বিবাহ করেছিল। পরে মামলা হয়। মেয়েটা বাবা মায়ের চাপে উলটা সাক্ষী দেয় এবং নারীহরণ মামলায় ৭ বৎসরের জেল নিয়ে এসেছে। ছোট হলেও জলসাটা সুন্দর করেছিল ছেলেরা। আমি কারাগার থেকে দেশবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই। ১০ সেল থেকে মিজানুর রহমান চৌধুরী আমাকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাইয়া একটা টুকরা কাগজে নিম্নলিখিত কবিতাটি লিখে পাঠায়,
❛আজিকের নূতন প্রভাতে নূতন বরষের আগমনে
—মুজিব ভাইকে
বন্ধু হও, শত্রু হও, যেখানে যে কেউ রও
ক্ষমা করো আজিকার মত,
পুরাতন বরষের সাথে
পুরাতন অপরাধ হতে।❜
নববর্ষের শ্রদ্ধাসহ মিজান
১লা বৈশাখ ১৩৭৪ সাল।❜❜
[কারাগারের রোজনামচা, শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা ২২২-২২৩]
পরাধীন দেশে কারাগারের মতো বিরুদ্ধ-পরিবেশেও বঙ্গবন্ধু নববর্ষ উদযাপন করেছেন, উদযাপনে সঙ্গী করেছে অন্যদের। স্বাধীন বাংলাদেশেও পহেলা বৈশাখ ও বর্ষবরণ উদযাপনে নানা ভূমিকা পালন করেছেন। এই হিসাবে এই নববর্ষ উদযাপনের সঙ্গে তার যোগকে অস্বীকার করার উপায় নাই। নববর্ষ উদযাপনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর যোগ নিয়ে যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রসিকতা করছেন প্রসঙ্গক্রমে কারাগারের রোজনামচার উদ্ধৃতি এখানে শুধু, এটা শিশুর অসম্পূর্ণ বক্তব্যের প্রসঙ্গে নয়।
অদ্য যে শিশুটির অসম্পূর্ণ বক্তব্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা উপহাস করছেন তারা শিশুর প্রতি অসংবেদনশীল আচরণ করেছেন। একে তো তাকে তার বক্তব্য সম্পন্ন করে দেওয়া হয়নি, তার ওপর তাকে সামাজিকভাবে হয়রানি করা হচ্ছে! যে সাংবাদিক তার বক্তব্য সম্পূর্ণ করার সুযোগ দেননি তিনি সঠিক কাজ করেননি। এখানে তার পেশাদারিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলে মনে করছি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্রেফ আনন্দ লাভের জন্যে অথবা বঙ্গবন্ধুর প্রতি রাজনৈতিক বিদ্বেষ কিংবা অপছন্দের সূত্রে এই ভিডিয়ো নিয়ে উপহাস করছেন তাদের প্রতি অনুরোধ দয়া করে শিশুটির প্রতি মানবিক হোন। এই শিশুটিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হেয় করবেন না, এই ধকল সামলে ওঠার বয়স ও মানসিক শক্তি তার এখনও হয়নি।
কবির য়াহমদ, প্রধান সম্পাদক, সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর
আইনিউজে দেখুন আরও ভিডিও খবর
মনে আছে অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের কথা? (ভিডিও)
বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মহসিন আলী
ঘুরে আসুন মৌলভীবাজারের পাথারিয়া পাহাড়
মৌলভীবাজারের বিস্ময় বালিকা : ১৯৫ দেশের রাজধানীর নাম বলতে পারে
মৌলভীবাজারের সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী ভারত সরকারের পদ্মভূষণ পদকে ভূষিত
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ