শরিফুল হাসান
আপডেট: ১৭:৪১, ১৮ এপ্রিল ২০২২
আত্মহত্যা নয়, লড়াই করুন, পাশে আছি
শরিফুল হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
খাবার টাকার অভাবে কিংবা আর্থিক অনটনে এই দেশের একজন শিক্ষার্থীকেও আত্মহত্যা করতে দেখতে চাই না। আপনাদের যে কারো যদি মনে হয় খাবার টাকা যোগাড়েরও সামর্থ্য নেই বা চরম অনটনে আছেন প্লিজ যোগাযোগ করুন। আপনার নাম পরিচয় জানবে না কেউ। না, আমার অনেক টাকা পয়সা নেই। কিন্তু বুক ভর্তি ভালোবাসা আছে।
আপনারা যার নিজেদের অসহায় ভাবেন তাদের বলি, এই দেশে আজকে আপনারা যাদের বড় দেখেন, বড় বড় সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, শিক্ষক তাদের অনেকের জীবনের গল্পগুলো কষ্টের।
হ্যা, আমি যে কোন সমস্যা কাঁধে নিতে রাজি। আমি আমার সীমিত সামর্থ্য নিয়ে অপনার পাশে দাঁড়াবো। একই সঙ্গে যদি মানসিক সংকটেও থাকেন, যদি মনে হয় কেউ আপনার পাশে কেউ নেই অন্তত পক্ষে একবার আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। শুনতে চাই আপনাকে। আমার বিশ্বাস আমরা সবাই মিলে আপনার পাশে দাঁড়াতে পারবো। আপনার জন্য লিখতে পারবো। তাতে কোন একটা লড়াইয়ের শক্তি পাবেন বা কোন কাজ।
বিশ্বাস করেন, আমি যখন দেখি কোন একজন মানুষ বিশেষ করে একজন তরুণ-তরুণী আত্মহত্যা করছেন অমার মনে হয় কী একটা অসীম সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেলো। এই যে দেখেন কয়েকদিন আগে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র অন্তু রায় (২১) আত্মহত্যা করলো।
পরিবার বলছে, অন্তু খুবই মেধাবী ছিল। গণমাধ্যম সূত্রে জানলাম, সংসারে আর্থিক টানাপোড়েন আর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের টাকা বাকি, ছিল ছোটবোনের পড়াশোনার খরচের চাপ। সব মিলিয়ে সামলাতে পারেনি বলে খুলনার ডুমুরিয়ায় নিজ বাড়িতে আত্মহত্যা করেন।
শুধু অন্তু নয় গত ৫ মাসে কুয়েটের তিন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। শুধু কুয়টে নয়, বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। বিষয়গুলো ভীষণ বেদনাদায়ক।
আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের হল জীবন এবং দুই দশকের সাংবাদিকতা জীবনে দেখেছি, এই দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ছেলেমেয়ে সংগ্রাম করে লেখাপড়া করেন। আর্থিক কষ্টের পাশাপাশি তারা যে সংকটে পড়েন সেটা হলো অনেক সময় বন্ধুবান্ধবরা তাদের বুঝতে চায় না।
আমার নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। ২১ বছর আগের ঘটনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহরুল হক হলে মাত্র উঠেছি। আমরা প্রথম বর্ষের ছেলেরা তখন গণরুমে থাকি। হলের খাবার জঘন্য। প্রায়ই বন্ধুরা কোন একজন বায়না ধরে, চল আজকে তুই খাওয়াবি। দলবেঁধে এরপর সবাই বাইরে খেতে যাওয়া। কিন্তু ছোটখাটো গড়নের একটি ছেলে কখনোই আমাদের সঙ্গে যোগ দিতো না। আমি ওকে সেভাবে হলের নাস্তার দোকানেও দেখিনি। তবে মাঝে মধ্যে হলের ক্যান্টিনের খাবার খেতে দেখতাম।
আরও পড়ুন : সামাজিক মাধ্যম ও শিশুর প্রতি সংবেদনশীলতা
একদিন বন্ধুর মতো কথা বললাম ওর সাথে দীর্ঘ সময় ধরে। জানলাম ওর বাবা রিকশা চালায়। খুব কষ্ট করে ও পড়াশোনা করছে। বাইরে খাওয়া তো দূরের কথা সাধ্য নেই। এমনকি নিয়মিত খাবারও সাধ্য নেই। আমার ভীষণ মন খারাপ হলো। আমি এরপর সব ঘটনায় ওর পাশে থাকার চেষ্টা করেছি বন্ধুর মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ও বিভিন্ন বর্ষের ভর্তির সময় আমি এমন অনেক ছেলেকেও পেতাম যাদের ভর্তির টাকাটাও নেই। আমার এক বন্ধু আমাকে বলেছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে ও কোনদিন সকালের নাস্তা করেনি। একবারে দুপুরে হলের ক্যান্টিনে খেতো!
এই ঘটনাগুলো আমাকে ভীষণ স্পর্শ করতো। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই আমি যেহেতু সাংবাদিকতা করতাম এবং ভালো বেতন ছিলো, পরে আবার বেশ বড় অংকের নরওয়ের বৃত্তি পেতাম আমি চেষ্টা করতাম যারই টাকার দরকার তাকেই দেওয়ার। আমি সবসময় আল্লাহকে বলতাম, আল্লাহ আমার কাছে যেন সবসময় টাকা থাকে যেন আমি আরেকজনকে নির্দিধায় দিতে পারি। আজো সৃষ্টিকর্তার কাছে আমার তাই প্রার্থনা।
আপনারা জানেন আমি সদ্য তরুণদের বিষয়ে কাজ করার একটা বাড়তি দায়িত্ব পেয়েছি। আমি অমার টীমের সদস্যদের বলেছি এই দেশের তরুণদের সব সংকটে আমাদের পাশে থাকতে হবে। আমি খুব দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, এই দেশের যে কোন প্রান্তের যে কোন শিক্ষার্থী যদি মনে করেন আপনার খাওয়ার ব্যাবস্থাটা নেই প্লিজ যোগাযোগ করবেন। দুনিয়ার কেউ আপনার নাম ঠিকানা জানবে না।
আরও পড়ুন : শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল-আমোদিনী পাল-সুনীল চন্দ্র দাস, অতঃপর...
আমি বিশ্বাস করি এই দেশের দরিদ্র প্রতিটি ছাত্রের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করার শক্তি আমাদের অন্তত আছে। আর সেই সাহসেই বলছি, যে কোন শিক্ষার্থী যদি মনে হয় খাওয়ার কষ্টে আছেন প্লিজ ইনবক্স করুন। আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করবো। কারণ আমি জানি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ে যারা লড়াই করে বড় হয় পরবর্তী জীবনে তারাই সফল হয়। কারণ তাদের অনেক বেশি জীবনী শক্তি থাকে। আমাদের কাজ শুধু ছাত্রাবস্থায় তাদের লড়াইয়ে পাশে থাকা।
আমি আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি একটু ভালোবাসা পেলে এরা পৃথিবী জয় করে ফেলতে পারে। আমি এমন বহু তরুণ-তরুণীর গল্প জানি। জীবনজয়ী এমন অনেককে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। তাদের কেউ আজ শিক্ষক, কেউ আজ বিসিএস ক্যাডার কেউ আরও ভালো কিছু করছে। আমাদের কাজ শুধু তাদের পাশে থাকা। এখানে শিক্ষকদেরও দায়িত্ব নিতে হবে।
আমি জানি না আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষকদের কতোজন খোঁজ নেন ছেলেমেয়েরা হলগুলোতে কী সংগ্রাম করে থাকে। ব্যতিক্রম বাদ দিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে ছাত্রদের দায়িত্বে থাকা শিক্ষকরা কতোটা সময় দেন তাদের ছাত্রদের? তারা কী জানে প্রথম বর্ষ কেমন কাটে ছেলেমেয়েদের? কেমন কাটে তাদের গণরুমে? শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয় প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে একই প্রশ্ন।
শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বলছি কেন অন্য সহপাঠী ছাত্রছাত্রীরা কতোজন তাদের বন্ধুর খবর নেন? আপনি কী জানেন মাসে আপনি যে কয় টাকার সিগারেট খান সেই টাকা দিয়ে অনেকের জীবন চলে? আপনার ঈদের একটা পোষাকের দাম অনেকের মাস চলার টাকা। কাজেই মানুষের পাশে দাঁড়ান। অনেকের আবার আর্থিক সংকট নয়, তাদের দরকার মানসিক শক্তি। তাহলেই আর তারা আত্মহত্যা করবে না।
দেখেন আমরা একটা সংকটময় সময় পার করছি। সারাক্ষণ পড়াশোনার চাপ, বকা-ঝকা, বেকারত্ত্ব সংকট, একটা চাকুরি বা সাফল্যের পেছনে দৌড়ানো আজকের প্রজন্মের ছেলেমেয়েগুলো ভীষন একা। বাস্তব জীবন বা ফেসবুকে হাজার বন্ধুর সাথে থেকেও তাই তারা একেক জন এতোটাই একা যে প্রচণ্ড কষ্টের মুহুর্ত শেয়ার করার জন্যও কাউকে পায় না। তাই বলি বন্ধুর খোঁজ নেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্রদের বলছি, আপনার আর্থিক অবস্থা যেমনি হোক আপনার বন্ধু, আপনার পাশের ছেলেটির খোঁজ নেন। কখনো একটু সামান্য সাহায্য, একটু ভালোবাসা, একটু সহমর্মিতা আরেকজন মানুষকে নতুন জীবন দিতে পারে।
এই যে দেখেন কয়েকদিন আগে নিজের ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক শিক্ষার্থী সোহাগ খন্দকার। আত্মহত্যার আট ঘন্টা আগে স্ট্যাটাসে সে লিখেছে, ‘ভালো থাকুক সেসব মানুষ যারা শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আল্লাহর দোহাই মাফ করে দেবেন; জীবনের কাছে হার মেনে গেলাম। আমি আর পারলাম না; একটা মানুষ যখন আর জীবনের কাছে যখন যখন হেরে যায় তখন আর করার কিছু থাকে না।’
আসলে যে কোন মানুষের আত্মহত্যার খবর দেখলে আমার মনে হয়, আমরা সম্মিলিতভাবে ব্যর্থ। কিন্তু মানসিকভাবে আমরা তো সুস্থ থাকি না অনেক সময়। অনেক সময় নানা সংকটে থাকি। এই সময়টায় তাদের পাশে থাকতে হবে। তাদের শুনতে হবে।
বাংলাদেশের যে কোন প্রান্তে থাকা এমন তরুণদের বলছি, প্লিজ আত্মহত্যা করবেন না। মনে রাখবেন প্রত্যেকটা মানুষের কষ্ট আছে। প্লিজ এগুলো শেয়ার করুন। সমাধান পাবেন। আমাদের ব্র্যাকের ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে মনের বন্ধু নামে একটা সংগঠনের পার্টনারশিপ আছে। যে কেউ চাইলে তাদের পেজে Moner Bondhu যোগাযোগ করতে পারেন। তাদের হেল্পলাইনে ফোন করতে পারেন।
একইভাবে আমাদের ব্র্যাক ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের আমরা নতুন নেটওয়ার্কের একজন সদস্য ফাইরুজ প্রতিষ্ঠা করেছে Moner School। যে কেউ অনলাইনে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। আপনার যে কোন মানসিক সংকটে তারা পাশে থাকবে। এ ছাড়া ব্র্যাকের Amra Notun Network পেজ আছে। সেখানেও যোগাযোগ করতে পারেন। আমরা চাই এই দেশের একজন তরুণ-তরুণীও আত্মহত্যা করবে না। বরং জীবনবোধ নিয়ে লড়াই করবে।
আপনারা যার নিজেদের অসহায় ভাবেন তাদের বলি, এই দেশে আজকে আপনারা যাদের বড় দেখেন, বড় বড় সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, শিক্ষক তাদের অনেকের জীবনের গল্পগুলো কষ্টের। কিন্তু তারা কেউ জীবনের কাছে হার মানেননি। বাংলাদেশের প্রতিটি ছাত্র প্রতিটি তরুণকে বলবো জীবনের কাছে হার মানবেন না। বুকে সাহস নিয়ে বলছি, আপনারা যদি মনে করেন আপনার কেউ নেই মনে করবেন আমি আছি। আমরা আছি।
আবারও বলছি আমি বড়লোক নেই। কিন্তু বুক ভর্তি সাহস আছে। আমরা সবাই মিলে পরিস্থিতিটা বদলাতে চাই। আত্মহত্যা বন্ধ করতে চাই। শক্তি ও সাহস দিতে চাই প্রত্যেকটা তরুণ-তরুণীকে। আর এই পুরো রাষ্ট্রকে বলি, দেশের হাজার হাজার শিক্ষক, চাকুরিজীবী, ব্যাবসায়ীসহ প্রতিটি মানুষকে বলি, চলুন সম্মিলিত শক্তিতে আমরা আমাদের তরুণদের পাশে দাঁড়াই। তাদের আগামী দিনের মুল্যবোধসম্পন্ন যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তুলি। সবাই মিলে সুন্দরভাবে বাঁচি। আরেকজনের জন্য বাঁচি। আরেকজনকে নিয়ে বাঁচি।
শরিফুল হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট (Programme Head, Migration Programme & Youth Initiatives at BRAC)
- খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ