ইয়াসীন সেলিম
আপডেট: ১৯:০৬, ৩০ জুলাই ২০২২
নিরাপদ রেলে মৃত্যুর মিছিল ও রনির আন্দোলন
শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকার তথ্যমতে, রেলে যত প্রাণহানি হয় তার ৮৫ভাগ হয় রেলক্রসিংয়ে। শুধু তাই নয়, ৮২ভাগ রেলক্রসিং অনিরাপদ এখনও। ২০১৪-২০২১ সাল পর্যন্ত রেলক্রসিংয়ে ১৮৭জন প্রাণ হারিয়েছেন। পাহারাদার থাকার পরও ১৮ভাগ রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত রেলক্রসিং নিরাপদ করতে ১৯৬ কোটি টাকা ব্যয় করার পরও কাজের কাজ হয়নি কিছুই। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে কী আশা করা যায়? অথচ এই টাকাটা রেলক্রসিং অটোমেটেড সিসটেমে নেয়ার পেছনে খরচ করলে অনেক আগেই রেলক্রসিং নিরাপদ হয়ে যেত!
আমাকে যদি মোটামুটি দূরত্বে কোথাও ভ্রমণ করতে হয় আর বাছাই করতে দেয়া হয় বিলাসবহুল এসি বাস এবং সাধারণমানের ট্রেনে ভ্রমণ করার জন্য, আমি চোখবুজে ট্রেনকে বেছে নেব ভ্রমণের জন্য। কারণ, নানা কারণে আমাদের দেশে সড়ক মানেই অনিরাপদ, ঝুঁকিপূর্ণ ভ্রমণপথ। কিন্তু রেলে সেই ঝুঁকিটা নেই। নিরাপদে গন্তব্যে যেতে হলে রেল হলো সবচেয়ে স্বস্তিদায়ক পরিবহন। সারা বিশ্বের মানুষ এটাই জানে এবং মানেও।
গত শুক্রবার (২৯ জুলাই) চট্টগ্রামে যে দুর্ঘটনাটি ঘটে গেলো সেটা শুধু মর্মান্তিক নয়, খুব আশঙ্কার ও আতঙ্কের বটে। তরুণ ছেলেদের একটা দল মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝর্না দেখতে গেলো, দেখল। কিন্তু ফিরল লাশ হয়ে। মাইক্রোবাস নিয়ে রেলক্রসিং পেরোতে গিয়ে চলন্ত ট্রেন এক কিলোমিটার টেনে নিয়ে গেলো তাদের। ১১জন স্পট ডেড হয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলো। ভ্রমণের আনন্দ মুহূর্তেই পরিণত হলো বিষাদে!
১১টা লাশ, ১১টা পরিবার। যারা সন্তান হারালেন তারাই শুধু জানেন তাদের কী অপূরণীয় ক্ষতি হলো। একেকটা পরিবারে কী নরকের বিভীষিকা নেমে এলো সেটা মিডিয়ায় খুব সামান্যই আসবে। আমরাও দু'দিন পরে ভুলে যাব সব। কিন্তু যারা চলে গেলো তাদের অভাব কি আর পূরণ হবে?
একটা রেলক্রসিং আছে, গেটম্যান আছে। তবু এড়ানো গেলো না দুর্ঘটনা। প্রশ্ন জাগে- এটা কি সত্যি দুর্ঘটনা, হত্যা নাকি আত্মহত্যা? গেটম্যান দাবি করেছেন তিনি লাল পতাকা প্রদর্শন করা সত্ত্বেও তারা মানেনি, রেলক্রসিংয়ে উঠে পড়েছে। বেঁচে যাওয়া একজন যাত্রী জানিয়েছেন ওখানে তখন কোনো গেটম্যান ছিলোই না। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, গেটম্যান জুমার নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন তাই রেলক্রসিং খোলা ও অরক্ষিত ছিল।
গেটম্যান নামাজে যেতেই পারেন। কিন্তু তার বিকল্প ব্যবস্থা করে গেলেন না কেন, বিশেষ করে ট্রেন আসার শিডিউল থাকা সত্ত্বেও। অপরদিকে গেট খোলা থাকলেই আমরা কেন সরাসরি চলে যাব? কেন একটু অপেক্ষা করে দুই পাশে ভালো করে তাকিয়ে, ট্রেন আসছে কী না তার শব্দ না শুনেই ক্রসিং পার হব? আমাদের এত তাড়াহুড়ো কেন? পাঁচ মিনিট পরে পার হলে কী এমন ক্ষতি হয়ে যেত? এত অনিয়মের দেশে নিয়ম মেনে পথ চললেও তো কিছু দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। আমরা কেন নিয়ম মানতে এতটা অনিচ্ছুক?
আমাদের দেশে রেলওয়ে সেক্টরটা দিনে দিনে উন্নত হওয়ার বদলে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের পাশের দেশেও ট্রেন হলো প্রধান গণপরিবহন। সেখানকার রেলে যারা ভ্রমণ করেছে তারা একবাক্যে স্বীকার করবে আমাদের আর তাদের মধ্যে কত তফাৎ। আমরা বিভিন্নভাবে এগিয়ে যাচ্ছি, উন্নয়নের অনেক পরিকল্পনা নিচ্ছি, কিন্তু রেল রয়ে যাচ্ছে সেই তিমিরেই। এই যে রেলক্রসিং এখনও সেই মান্ধাতার আমলের বাঁশ ও গেটম্যান দিয়ে চালাতে হচ্ছে, এটা তো চাইলে খুব সহজেই অটোমেটেড করে ফেলা যায়। এসব প্রযুক্তি এখন খুবই সহজলভ্য। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে হাঁটছি, অথচ রেলওয়েটা এখনও অ্যানালগ রয়ে গেছে। ট্রেন এলে গেট বন্ধ হবে, চলে গেলে খুলে যাবে এরকম স্বয়ংক্রিয় গেট প্রতিটি রেলক্রসিংয়ে বসানো কি খুব রকেট সায়েন্স? পৃথিবীর নানা দেশ স্থানীয় প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়েই এগুলো করে ফেলছে আর আমরা পড়ে আছি সেই বাঁশ আর লাল পতাকা নিয়ে!
শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকার তথ্যমতে, রেলে যত প্রাণহানি হয় তার ৮৫ভাগ হয় রেলক্রসিংয়ে। শুধু তাই নয়, ৮২ভাগ রেলক্রসিং অনিরাপদ এখনও। ২০১৪-২০২১ সাল পর্যন্ত রেলক্রসিংয়ে ১৮৭জন প্রাণ হারিয়েছেন। পাহারাদার থাকার পরও ১৮ভাগ রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত রেলক্রসিং নিরাপদ করতে ১৯৬ কোটি টাকা ব্যয় করার পরও কাজের কাজ হয়নি কিছুই। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে কী আশা করা যায়? অথচ এই টাকাটা রেলক্রসিং অটোমেটেড সিসটেমে নেয়ার পেছনে খরচ করলে অনেক আগেই রেলক্রসিং নিরাপদ হয়ে যেত!
ট্রেনের টিকেট নিয়ে চলে আরেক পুকুরচুরি। অনলাইনে টিকেটে কেনাবেচার জন্য যাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হলো সেই সহজ ডটকম নিজেরাই এখন ট্রেনের রক্ষক হয়ে ভক্ষক সেজে বসে আছে। তাদের ইঞ্জিনিয়ার নিজেই টিকেট কালোবাজারি করে ধরা পড়ে। আমরা অনলাইনে টিকেট পাই না, অথচ রেলওয়ে নাকি লস গুনে প্রতি বছর! অথচ সহজ ডটকমকে দায়িত্ব না দিয়ে আইটিতে কিছু দক্ষ জনবল স্বচ্ছতার সাথে নিয়োগ দিয়ে নিজেরাই ট্রেনের অনলাইন টিকেট সিসটেম তৈরি করতে ও অপারেট করতে পারত। দেশে প্রচুর ছেলেমেয়ে আছে এসব কাজে দক্ষ। তারা ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে উন্নত বিশ্বের রেল/বাসের টিকেট সিসটেম তৈরি করে দেয়, কিন্তু দেশে তাদেরকে কাজে লাগানো হয় না। রেলওয়ের প্রতিটি নিয়োগেই চলে বাণিজ্য। তার ওপর ৮০% নিয়োগ চলে যায় কোটায়। ফলে রেলে যোগ্য জনবল নিয়োগ হয় না। যার সু্যোগ নিয়ে সহজ ডটকম আর রেলওয়ের অসাধু কর্মচারীরা রেলকে আস্তে আস্তে শেষ করে দেয়ার মিশনে নেমেছে। ডিজিটালাইজেশন মানে শুধু থ্রিজি, ফোরজি, ফাইভজি না। দেশের প্রতিটি সেক্টরে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার নামই ডিজিটালাইজেশন।
আগে রেল চলত যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে। এরপর রেলের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় করা হয়। কিন্তু রেলে কোনো উন্নতির ছাপ দেখা যায় না। দেশের প্রতিটি সেক্টরে উন্নতির ছোঁয়া লাগলেও রেল যেন মা-বাবাহীন অনাথ একটি সেক্টর। আস্ত একটা মন্ত্রণালয় থাকলেও মনে হয় রেলকে দেখার কেউ নেই!
মহিউদ্দিন রনি নামের এক তরুণ সম্প্রতি রেলওয়ের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে একাই একটা বড় আন্দোলন করেছেন। তার আন্দোলনের ছয়দফা দাবির প্রতিটি ছিল যৌক্তিক। তাকে নানাভাবে সরানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে পরে তার দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়। মাত্রই আন্দোলনটা শেষ হলো। এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই রেলক্রসিংয়ে এতবড় ম্যাসাকার ঘটে গেলো, ঝরে গেলো ১১টি তাজা প্রাণ। রনির চমৎকার আন্দোলনের ফসল মিললো কোথায়? খেয়ে না খেয়ে দিনরাত কষ্ট করে একটা লোক যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল সেটা আপাতত সমাপ্ত হয়েছে বটে। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে একসময় অনেকেই রাস্তায় নেমে আসবেন রেলওয়ের অনিয়মের বিরুদ্ধে।
এখনও সময় আছে। পুরো রেলওয়েকে ঢেলে সাজানো হোক। রেলক্রসিংকে আধুনিক ও অটোমেটেড করা হোক। রেলের ই-টিকেট সিসটেমকে সহজ ডটকমের জটিলতা থেকে বের করে সত্যিকার অর্থেই সহজ করা হোক। মান্ধাতার আমলের রেললাইনগুলো আধুনিক করা হোক। 'টিকেট যার ভ্রমণ তার' সিসটেমে জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে রেলের টিকেট কেনার নিয়ম করা হোক। টিকেট কালোবাজারি বন্ধ করে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হোক। আর অবশ্যই সাম্প্রতিক দুর্ঘটনার যথাযথ তদন্ত করে দায়ীদেরকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হোক। আমাদের সেই নিরাপদ ও আরামদায়ক রেল ফিরিয়ে আমাদের মাঝে দেয়া হোক আবারও।
ইয়াসিন সেলিম, লেখক ও গবেষক
বিশ্বের মজার মজার গল্প আর তথ্য সম্বলিত আইনিউজের ফিচার পড়তে এখানে ক্লিক করুন
দেখুন আইনিউজের ভিডিও গ্যালারি
দিনমজুর বাবার ছেলে মাহির বুয়েটে পড়ার সুযোগ || BUET success story of Mahfujur Rhaman || EYE NEWS
হানিফ সংকেত যেভাবে কিংবদন্তি উপস্থাপক হলেন | Biography | hanif sanket life documentary | EYE NEWS
আশ্চর্য এন্টার্কটিকা মহাদেশের অজানা তথ্য | Antarctica continent countries | facts। Eye News
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ