সোহেল সানি
মায়ের সঙ্গে শেষ কথা
হাসু তোরা ফিরে আয়, জয়-পুতুল ছাড়া আমার সময় কাটেনা!
লেখক- সোহেল সানি, সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
জয়-পুতুল ছাড়া যে আমার সময় কাটেনা, তোরা দ্রুত দেশে ফিরে আয়। আর শোন তোর আব্বা আমাকে শেখ শহীদের বিয়েতে যেতে দেননি। তাঁর বোঝা উচিত ছিল শহীদ আমার একমাত্র বোনের ছেলে। মা বঙ্গামাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বড় মেয়ে শেখ হাসিনাকে নিদারুণ এ কষ্টের কথাগুলো বলে অঝোরে কেঁদেছিলেন। বঙ্গবন্ধু প্রায় সপরিবারে নিহত হওয়ার মাত্র চার দিন আগে শেখ হাসিনাকে টেলিফোনে এ কথাগুলো বলেছিলেন তাঁর মা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।
কিন্তু ফোনালাপের মাত্র চারদিন পরেই ঘাতকদের বুলেটে রক্তবন্যায় ভেসে যায় বত্রিশ নম্বরের বাসাটি। পরিবারের বাকিসব সদস্যদের সাথে প্রাণ হারান বঙ্গমাতাও। দেখে যেতে পারেন নি নাতি-নাতনিদের। জয়-হাসু-পুতুল সেদিন দেশে থাকলেও হয়তো নানিকে দেখতে পারতেন শেষবারের মতো। কিন্তু ঘাতক, হন্তারকরা সেদিন তাহলে তাদেরকেও হত্যা করে ফেলতো।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলীয় নেতা থাকাকালীন স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, ১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাইয় পশ্চিম জার্মানিতে যাওয়ার পর একবারই আমার মায়ের সঙ্গে কথা হয়। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ভাষায় চার দিনের ব্যবধানে বয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের ওপর এক রোজকেয়ামত।
শেখ হাসিনার নিদারুণ কষ্টের ধারাপাত বর্ণনার আগে কিভাবে তিনি হত্যাযজ্ঞের খবর পেয়েছিলেন, সে প্রসঙ্গের অবতারণা করছি। পশ্চিম জার্মানির তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ছিলেন সিংহপুরুষ হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী। তাঁর বাসায় ছিলেন ডঃ এমএ ওয়াজেদ মিয়া, সহধর্মিণী শেখ হাসিনা, পুত্রকন্যা ও শ্যালিকা শেখ রেহানা। ১৫ আগস্ট বাইরে থাকা হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী তাঁর সহধর্মিণীকে ফোন করেন কাক ডাকা ভোরে। তিনি সহধর্মিণীকে বলেন ডঃ এম এ ওয়াজেদ মিয়াকে পাইয়ে দিতে। ঘুম থেকে জাগিয়ে ডঃ ওয়াজেদের হাতে রিসিভার তুলে দেন বেগম চৌধুরী। ওপাশ থেকে ভারাক্রান্ত কন্ঠে হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী জানান, বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবাইকে হত্যা করা হয়েছে। এখনি যেনো শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা না জানানো হয়।
জার্মানি যাওয়ার আগের ঘটনা...
শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এম এ ক্লাশের ছাত্রী। তাঁকে পশ্চিম জার্মানি যেতে হবে স্বামী ডঃ ওয়াজেদের কাছে। তাই ছুটি মঞ্জুর করাতে ছুটে গিয়েছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক ডঃ আবদুল মতিন চৌধুরীর কাছে। কিন্তু বাধ সাধলেন উপাচার্য। তিনি বললেন "যেতে চাও ১৫ আগস্টের পরে যাও। তোমার বাবা এখন মহামান্য রাষ্ট্রপতি। তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 'আচার্য' হিসাবে এই প্রথম বরণ করবে। তুমি শুধু তাঁর মেয়ে নও, এই বিশ্ববিদ্যালয়েরও ছাত্রী। অতএব তুমি এই ঐতিহাসিক বরণ-উৎসব রেখে বিদেশ যেতে পারবে না।" শেখ হাসিনা সবিনয়ে স্যারকে বললেন, "আমি ১৫ আগস্ট পর্যন্ত থেকে যেতে চেষ্টা করবো।"
দ্বিধাগ্রস্ত মন নিয়ে বাসায় ফেরেন শেখ হাসিনা। মাকে স্যারের কথাগুলো শুনালেন। মা বলেন, 'শিক্ষকের আদেশ শিরোধার্য, ১৫ আগস্টের পরেই যাবে।" কিন্তু সন্ধ্যায় শেখ হাসিনাকে টেলিফোন স্বামী ড. ওয়াজেদের। উপাচার্যের আপত্তির কথা জানান স্বামীকে। শিশুপুত্র জয়ের প্রচন্ড জ্বরের কথাও বলেন। এসব কথা মানতে চাইলেন না ডঃ ওয়াজেদ। রাগস্বরে বললেন, "বাজার-সদায় করেছি, ছুটি নিয়েছি, আর এসব কি বলছো?"
স্বামীর মুখের ওপর না করে বরং শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আমরা ৩০ জুলাই রওয়ানা হচ্ছি। এ কারণে আর শেখ হাসিনার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতির পিতার বরণ উৎসব আর দেখা হলো না। যে বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৪৯ সালে তাঁর বাবার ছাত্রত্ব কেড়ে নিয়েছিল। যাহোক শেখ হাসিনা স্বামীর মনরক্ষার জন্য ১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই শিশু পুত্রকন্যা জয়-পুতুল ও ছোটবোন শেখ রেহানাকে নিয়ে আকাশ পথে উড়ে গেলেন পশ্চিম জার্মানিতে।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা স্মৃতিচারণমূলক এক প্রবন্ধে লিখেছেন, এমন রোজকেয়ামতের দিন, কোনদিন যেন কারো জীবনে কখনো না আসে। যেমনটি আমার জীবনে এসেছে। মাঝেমধ্যে মনে উদয় হয় সেদিন যদি ভিসি স্যারের কথা অমান্য না করে ঢাকায় থেকে যেতেন, তাহলে আমার জন্য সেটাই ভালো হতো। বেঁচে থাকা এই জীবনটাতে সে কি যন্ত্রণা তা প্রকাশ করার ভাষা নেই।
শেখ হাসিনা লিখেছেন, সব হারিয়ে এমন বেঁচে থাকতে তো আমি চাইনি। প্রতিদিন পলে পলে দ্বগ্ধ হওয়া, সব হারানোর প্রচন্ড দাবদাহ সমস্ত অন্তরজুড়ে যে তুষের আগুনের ধিকিধিকি জ্বলনীর জীবন, এ জীবন তো আমি চাইনি। এর চেয়ে মা, বাবা,ভাই ও ভাবীদের সঙ্গে আমিও চলে যেতে পারতাম, তাহলে প্রতিদিনের অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে তো বেঁচে যেতাম। আমার জন্য সেটাই ভালো হতো। আমি সেদিন কেন যে স্যারের নিষেধ শুনলাম না, আমি সেই কেনোর জবাব খুঁজে ফিরি। আমার দৃষ্টি ঝাঁপসা হয়, আমায় কুঁরেকুঁরে খায়। দলপাকানো বেদনায় আমার কন্ঠ রুদ্ধ হয়। স্মৃতির নিদারুণ কষাঘাতে জর্জরিত হই।
শেখ হাসিনা লিখেছেন, আমার সেই স্যার ড. আব্দুল মতিন চৌধুরীও নিস্তার পাননি। ২৩ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ থেকে তাঁকে অপসারণ করে মিথ্যা মামলায় কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশে ফেরার পর একবার তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়। সেটা ২৩ জুন সন্ধ্যায় শিক্ষাবিদ মাজাহারুল ইসলামের বাসায়। আমাকে এক সংবর্ধনা দেন তিনি। কিন্তু নিয়তি কি নিষ্ঠুর! সেই প্রিয় স্যার পরের দিন পৃথিবী থেকেই চিরবিদায় নেন। ডায়েরীর পাতায় আমার জীবনের সব চাইতে করুণ ও বেদনাঘণ হাহাকার পরিপূর্ণ একটি বিশেষ স্মৃতি রয়েছে মহান ওই মানুষটিকে নিয়ে। ভীষণ ব্যস্ত দিনেও যখন আমি কদাচিৎ একা বসে ভাবি তখন ফেলে আসা জীবনের স্বপ্নমধুর কিংবা বিষাদ-বেদনার স্মৃতির অর্গল তখনই উন্মুক্ত হয়। আমি বেদনায় বিমুঢ় হয়ে যাই।
শেখ হাসিনা বলেছিলেন, মানুষের কিছু স্মৃতি থাকে যা কখনো অর্ন্তহিত হয় না। এমনকি ম্লান বা হাল্কাও হয় না। আমি যেন প্রত্যক্ষ করি, স্যারের সঙ্গে সেই কথোপকথন। তখনই প্রচন্ড যন্ত্রণা অনুভব করি আমার সমস্ত বুক জুড়ে। অন্তর কেবল প্রচন্ড শূণ্যতায় আর্তনাদ করে। বুকের মধ্যে দুমড়েমুচড়ে একাকার হয়ে যায়। চোখের দৃষ্টি অজান্তেই ঝাঁপসা হয়। আমি আমার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি।
লেখক- সোহেল সানি সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
আইনিউজে আরও পড়ুন-
- যাত্রাপালার শিল্পী ও দর্শক-শ্রোতা : অতীত থেকে বর্তমান
- বাবু ফকিরের আশ্রম, গান শিখলে ফাউ মিলে মুড়ি, শিঙারা
- এ পি জে আব্দুল কালাম: ‘দ্য মিসাইল ম্যান অফ ইন্ডিয়া’
বিশ্বের মজার মজার গল্প আর তথ্য সম্বলিত আইনিউজের ফিচার পড়তে এখানে ক্লিক করুন
দেখুন আইনিউজের ভিডিও গ্যালারি
দিনমজুর বাবার ছেলে মাহির বুয়েটে পড়ার সুযোগ || BUET success story of Mahfujur Rhaman || EYE NEWS
হানিফ সংকেত যেভাবে কিংবদন্তি উপস্থাপক হলেন | Biography | hanif sanket life documentary | EYE NEWS
আশ্চর্য এন্টার্কটিকা মহাদেশের অজানা তথ্য | Antarctica continent countries | facts। Eye News
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ