Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, শনিবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৫,   বৈশাখ ৫ ১৪৩২

দীপংকর মোহান্ত

প্রকাশিত: ১২:৪৪, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২২
আপডেট: ১২:৪৬, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২২

বঙ্গবন্ধু, চা শিল্প এবং চা শ্রমিক

লিখেছেন শিক্ষক, গবেষক দীপংকর মোহান্ত

লিখেছেন শিক্ষক, গবেষক দীপংকর মোহান্ত

বাংলাদেশে চায়ের যাত্রার শুরুতে চা শিল্প যন্ত্র নির্ভর শিল্প ছিলনা; ছিল কৃষি শ্রেণিভুক্ত। বঙ্গবন্ধু ১৯৫৬ সালে শ্রম, শিল্প ও বানিজ্য মন্ত্রী থাকা কালে চা শিল্পের উন্নয় এবং চা শ্রমিকের জীবমান উন্নয়নের জন্য বাস্তব ভিত্তিক চিন্তা কাজ করেন।

১৯৫৬ সালে চাউলের দাম বেড়ে গেলে সে বছর সেপ্টেম্বর মাসে চা শ্রমিকদের প্রতিনিধি দল বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেন। তিনি বাগানে চাল সরবরাহ করতে খাদ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন। শ্রম, শিল্প ও বানিজ্য মন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু ১৯৫৬ সালের ২৫ নভেম্বর সিলেট খাদিমনগর চা বাগানের শ্রমিক বস্তিতে গমন করে শ্রমিকের সকল দুঃখের কথা শোনেন।

অতঃপর বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে প্রথম ঢাকায় সরকারিভাবে ১৯৫৭ সালের ২৩-২৫ মে তিন দিন ব্যাপী মলিকপক্ষ, চা বাগান ম্যানেজার, চা-শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিনিধি এবং শ্রম ও বানিজ্য মন্ত্রণালয়ের সরকারি কর্মমর্তাদের নিয়ে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এবং সকল পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করে শ্রমিকদের জীবনমান রক্ষার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়।

কিন্তু বঙ্গবন্ধুর পদত্যাগের পর সকল ফাইল ও চুক্তিপত্র চাপা পড়ে। তিনি সর্বজনীন ভোটাধিকার আন্দোলনে যুক্ত থাকায় শ্রমিকরা ভোটাধিকার পায় [তার আগে ছিল ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ও সুরমা উপত্যকা ভিত্তিক আসাম পার্লামেন্টে প্রতিনিধি নির্বাচন]।

ফলে চা শ্রমিকরা বঙ্গবন্ধুকে ‘মাই-বাপ’ বলে অভিহিত করে। তারা এতই বঙ্গবন্ধু ভক্ত যে, এখনো ৯৯% শ্রমিক ‘নৌকা মার্কা’য় ভোট দেয়। এ পর্যন্ত চা-বাগান অধ্যুষিত অঞ্চলে আওয়ামীলীগ প্রার্থীরা জয়লাভ করে আসছে বলে দৃশ্যমান।

চা-বাগানের বাস্তবতা
বাংলাদেশে বর্তমানে ১৬৮ টি চা বাগান রয়েছে। সরকারে কাছ থেকে মালিকপক্ষ যে পরিমান ভূমি লিজ নিয়েছেন সেই সকল ভূমিতে পর্যায়ক্রমে চা আবাদের কথা থাকলেও অধিকাংশ বাগান এই কাজ করছে না বা অতি ধীর গতিতে যাচ্ছে।

আয়তন, উৎপাদন ইত্যাদি বিচেনায় নিয়ে বা সূচকের আলোকের চা বাগানকে মূলত চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে: ১. এ-ক্লাস বাগান ১০৫ টি; ২. বি-ক্লাস বাগান ২১টি; ৩. সি-ক্লাস বাগান ২০টি; ৪. ইন-ক্লাস ২২ টি।

এই সকল বাগানে মজুরির হার ও সুযোগ সুবিধার মধ্যে পার্থক্য আছে। চা-শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বশীল ও চুক্তি করার ক্ষামতা রাখে ‘বাংলাদেশে চা শ্রমিক ইউনিয়ন’। এজন্য শ্রমিকরা চাঁদাও দিয়ে থাকে। কিন্তু পাকিস্তান আমল থেকে এই ইউনিয়ন দখলের লড়াই চলে। স্বধীনতার পর থেকে মোটামুটি স্থিতিশীলতা লক্ষ করা যায়।

অতঃপর বিগত জোট সরকারের আমলে নেতৃত্বে পালাবদল ঘটে। কিন্তু শ্রমিকদের যে খুব লাভ হয়েছিল তা বলা যাবে না। চা শ্রমিকদের মধ্যে নেতৃত্বের যে ভ্যালিভিত্তিক ইউনিয়ন কাঠামো ছিল তাও আজ নড়বড়ে। কেমন যেন দূরত্ব বেড়ে গেছে শ্রমিক ও ইউনিয়নের মধ্যে; আবার মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে।

বাংলাদেশে চা -জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৬-৭ লক্ষ। ফলে একজন চা শ্রমিকের আয়ের ওপর সে পরিবারের প্রায় ৪-৬ জন লোক নির্ভরশীল হয়ে থাকে। চা বাগানে সকল শ্রমিক বাগান এলাকায় কাজ পায় না। স্থায়ী শ্রমিকদের মধ্যে গড়ে ৮০% চা বাগানের ঘর পায়। সে ঘরটি ৩২ বর্গ মিটারের মধ্যে হয়ে থাকে এবং দুই কক্ষ বিশিষ্ট [ভালো বাগানে, এ ক্লাস বাগান]।

অনেক বাগান বারবার ক্রয়-বিক্রয় চলছে অর্থাৎ মালিকানা বদল ঘটছে। শিল্পপতিগণ আগের মতো ঝুঁকি নিতে চায় না। তাদের সামনে কর্পোরেট বানিজ্য হাত ছানি দেয়। আবার ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা প্রবেশ করেছে চায়ের মার্কেটে। তারা দায়বোধ থেকে নগদ লভ্যাংশ বেশি দেখে। এই ফাঁকে চোরা পথে ভারতীয় বাজারে প্রবশ করছে। দরদী শিল্পপতিরাও তাদের হটাতে পারছেন না।

কখনো দেখা যায় সিন্ডিকেট ব্যবসা করতে। অথচ দেশের আভ্যন্তরিণ চায়ের ব্যবহার প্রচুর বেড়েছে। চা উৎপাদন ব্যয় যে বেড়েছে তাও অস্বীকার করা যাবেনা। তারপরও অলাভজনক বাগানের সংখ্যা অল্প সংখ্যক। প্রয়োজনবোধে সরকার চা শিল্প, রুগ্ন চা বাগান রক্ষা ও চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নতি করতে একটি কমিশন গঠন করতে পারেন।

মালিক পক্ষকে সবদিক বিবেচনায় রেখে তাদের সহযোদ্ধা শ্রমিকদের প্রতি দায়বোধ বাড়ানোর দাবীও রাখে। বাংলাদেশে চা-বাগানে স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৯৭,০০০/- [সাতানব্বই হাজার] এবং অস্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ৩৫, ০০০ [পঁয়ত্রিশ হাজার]।

বাগান মালিক হতে যেসব সুবিধা মিলে

তার বাইরে বাংলাদেশে চা -জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৬-৭ লক্ষ। ফলে একজন চা শ্রমিকের আয়ের ওপর সে পরিবারের প্রায় ৪-৬ জন লোক নির্ভরশীল হয়ে থাকে। চা বাগানে সকল শ্রমিক বাগান এলাকায় কাজ পায় না। স্থায়ী শ্রমিকদের মধ্যে গড়ে ৮০% চা বাগানের ঘর পায়। সে ঘরটি ৩২ বর্গ মিটারের মধ্যে হয়ে থাকে এবং দুই কক্ষ বিশিষ্ট [ভালো বাগানে, এ ক্লাস বাগান]।

আবার কিছু কিছু বাগানে ছনের ঘর থাকে। পরবর্তী সময় এগুলোর সংস্কারের জন্য শ্রমিকরা নিজেরা অর্থ ব্যয় করেন। আবার বাগানে কাজ না পাওয়া শ্রমিক পরিবার অনুমতি নিয়ে নিজেই ঘর তৈরি করেন। কখনো মার্ড ওয়ার্ড ঘর তৈরির জন্য কর্তৃপক্ষ ৫,০০০/- দিয়ে থাকেন।

কিন্তু রিপিয়ারিং-এর জন্য কোনো টাকা দেওয়া হয় না। ছোট ঘরে গাদ্ধাসঢ়;গাদি করে থাকতে দেখা যায়। আগে কিছু শ্র্রমিক যে বিলঝিলে বা টিলার নিচে যে টুকু জমি বরাদ্ধ পেতেন। এই জায়গাটুকু ক্রমে সংকুচিত হয়ে পড়ছে। অথচ পরিবারে ব্যয় বাড়ছে।

চা শ্রমিক পরিবারের সন্তান গবেষক চিত্তরঞ্জন রাজবংশীর ভাষ্য [বেগম খান চা বাগান, চুনারুঘাট, হবিগঞ্জ], বিভিন্ন পত্রিকার রিপোর্ট এবং চা বোর্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ি ২০২১ সালে [বিপনন যোগ্য] উৎপাদিত চায়ের পরিমান ছিল ৯ কোটি ৬৫ লাখ কেজি চা পাতা। তার ১০% চা বিদেশে রপ্তানি [৯৬ লাখ ১০ হাজার কেজি] হলে [৬০০ টাকা কেজি দরে] তার ১৫% হারে ভ্যাট হিসেবে সরকার পেয়েছে ৮৬ কোটি টাকা [বাকিটা ব্যবসায়িদের লাভ]।

বাদবাকী ৯০% অর্থাৎ ৮ কোটি ৬৮ লাখ কেজি চাপাতা ২৫০ টাকা করে বাজার দর ধরলে তার ১৫% ভ্যাটে ৩২৫.৫ কোটি টাকা সরকার পেয়ে থাকবার কথা। এর পর রয়েছে মালিক পক্ষের লাভ। ফলে চা বাঁচিয়ে রাখা জরুরি এবং লাভজনক। সে বছর শ্রমিকদের মজুরি ও অন্যান্য বাবদ ব্যয় ধরলে চা শিল্পে লোকসান হওয়ার কথা নয়। বরং সেই হিসেবে ধরলে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর অবকাশ রয়েছে।

বর্তমান বাজার মূল্য
কোবিড-১৯ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সহ নানা কারণে নিত্য প্রয়েজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। ফলে অতি সামান্য আয় দিয়ে চা শ্রমিকদের জীবনধারণ কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়েছে। চা বাগানে প্রচ্ছন্ন বেকারত্বের হার কম নয়। চা বাগানের শ্রমিক পরিবারের অন্যান্য লোকজন সংগত কারণে বহুমুখী শ্রম করতে অনভ্যস্থ।

যেমন- গার্মেন্টস শিল্পের কাজ, রাজমিস্ত্রী, কাঠ মিস্ত্রী, মোবাইল মেরামত, দোকানদারি ইত্যাদি। ফলে তাদের দরিদ্র অবস্থা কমছে না। তাছাড়া তাদের কোনা স্থায়ী ভূমির মালিকানা কখনো দেওয়া হয়নি। বর্তমানে এক কেজি সাধারণ চালের দাম ৪৫-৫০ টাকার বেশি। নিত্যদিনের তেল, লবন, ডালসহ অন্যান্য আনুষাঙ্গিক দ্রব্যাদিও দাম বেড়েছে। ফলে এই সময়ের প্রেক্ষিতে তাদের দৈনিক মজুরি নূন্যতম ১৭৫ থেকে ২০০ টাকা হওয়া যুক্তিযুক্ত। যা পরে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের মাধ্যমে বাড়তে পারে।

চা শ্রমিকদের আরেকটি অভিযোগ যে, মূল চা শ্রমিকদের পাশ কাটিয়ে বর্তমানে বহিরাগত অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগের মূল চা শ্রমিকের পরিবারবর্গ কাজ পায় না। বিষয়টা তাদের মধ্যে একটা ক্ষোভের মতো কাজ করছে। শহরাঞ্চলে যুবকদের নানা ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজে লাগা বা বিদেশ যাওয়ার সুযোগ থাকে। অনেকেই জীবনযুদ্ধে কিছুটা হলেও বাঁচতে পারে।

চা শ্রমিকের নতুন প্রজন্মকে নিয়ে ভাবনার সময় এসেছে। আমরা চাই চাশিল্প আরো সম্প্রসারিত হোক। বৈদেশিক আয়েক একটা পথ যেন বন্ধ না হয়। এ ব্যাপারে সরকার, মালিকপক্ষ ও শ্রমিকপক্ষ সবাইকে গঠনমূলক ভ‚মিকায় আসবেন বলে প্রত্যাশা করছি।

দীপংকর মোহান্ত, শিক্ষক, লেখক ও সাংবাদিক

  • খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আইনিউজ/এইচএ

আইনিউজে আরও পড়ুন-


দেখুন আইনিউজের ভিডিও গ্যালারি

সৌদি আরবে মেয়েকে নির্যাতনের খবরে মায়ের আহাজারি-কান্না

গ্রিসের বস্তিতে বাংলাদেশীদের মানবেতর জীবন, অধিকাংশই সিলেটি

গ্রিসে পাঁচ বছরের ভিসা পাবে বাংলাদেশিরা

Green Tea
সর্বশেষ
জনপ্রিয়