শ্যামলাল গোসাঁই
প্রকাশিত: ১৪:২১, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২
আপডেট: ১৪:৫৭, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২
আপডেট: ১৪:৫৭, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২
ভাটির কবি আব্দুল করিম এবং কিছু কথা
লিখেছেন- কবি ও সংবাদকর্মী শ্যামলাল গোসাঁই
বাউলদের নিয়ে আমার একটা একান্ত ধারণা আছে। আর সেটা হলো বাউলরা অঞ্চলভেদে বা এলাকাভেদে আলাদা হলেও বাউল সত্তা থাকে এক। অর্থাৎ বাউলদের চিন্তার জগৎ প্রায় ক্ষেত্রে একই রকম থাকে। শুধু পরিবেশ আর সময়ভেদে তারা তাদের গানের কথায় পরিবর্তন আনেন। শাহ আব্দুল করিমও তেমনি একজন সমৃদ্ধ বাউল ছিলেন।
যিনি পড়াশোনা তেমন না করেও তার গানে যে ভাবের সঞ্চার করেছিলেন তা অনেক শিক্ষিত সঙ্গীতবোদ্ধাদেরও অবাক করে দিয়েছিলো! তিনি এই ভাব তরণীর মাঝি হয়ে একে একে পাড়ি দিয়েছেন বাউল গানের বিভিন্ন পর্যায় বা ধাঁপ। গানে তৈরি করেছেন তার নিজস্ব বলয়।
ফকির লালন সাঁই যেমন মানুষের দেহকে একটা 'খাঁচা' ভেবে সেখানেই সৃষ্টিতত্ব কিংবা দেহতত্বের উন্মোচন করেছেন। শাহ আব্দুল করিমও এর ব্যাতিক্রম করেন নি। বরং বলতে গেলে করিমের কিছু গানে লালনের সুস্পষ্ট ছাপ ছিলো। এ ব্যাপারে আব্দুল করিমও জীবদ্দশায় অনেক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, 'আমি লালন ফকিরকে খুব গুরুত্ব দেই।'
তবে তিনি লালন সাঁইয়ের মতো দেহকে একখানা 'খাঁচা' না ভেবে সেখানে ঢেলে দিয়েছেন আঞ্চলিক উপমা। আঞ্চলিক উপাদানে সমৃদ্ধ করেছেন গানকে। যাকে সহজ ভাষায় গানের অলংকারও বলা যেতে পারে। লালনের সেই 'খাঁচা'কে আব্দুল করিম নিজের গানে করে নিয়েছেন 'ময়ুরপঙখী নৌকা'! তারপর এই নৌকার অবকাঠামোতেই তোলে ধরেছেন এই মানবদেহকে। তোলে ধরেছেন মানবদেহের রহস্য এবং সর্বশেষে প্রকাশ করেছেন অদৃশ্য সেই ঈশ্বরকে না পাওয়ার ব্যাকুলতা।
এখানে আরেকটা বিষয় আব্দুল করিম সবসময়ই পরিষ্কার করে বলেছেন যে তিনি কোনো আসমানী খোদায় বিশ্বাস করেন না। মানুষের ভেতরে যে খোদা বিরাজমান আব্দুল করিম সেই খোদার চরণে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। সেই ভাবনা থেকেই আব্দুল করিম তার রঙিলা বাড়ই গানের শেষ অংশে এসে লিখেছেন, 'তোমার প্রেমে আব্দুল করিম মরেও যদি ভালো, রঙ্গিলা বাড়ইরে বাড়ই নানান রঙের খেলা খেলো।' এ
আব্দুল করিমের বাড়িতে তার প্রতিকৃতির সামনে লেখক। ছবি- অনাদি দাশ
ভাবেই আব্দুল করিম গানের মধ্য দিয়ে সুপ্রসস্ত করেছেন তার চিন্তা-ভাবনার পরিধি। নিজেকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। তার এই অনন্য উচ্চতার বিষয়টি অন্যান্যদের মতো তৎকালীন সময়ে মাওলানা ভাসানীর চোখে ধরা পড়েছিলো। তাই মাওলানা ভাসানী কাগমারী সম্মেলনে করিমকে বলেছিলেন, 'সাধনায় একাগ্র থাকলে তুমি একদিন গণমানুষের শিল্পী হবে।' আব্দুল করিম গণমানুষের শিল্পী হয়েওছিলেন।
আগেই বলেছি আব্দুল করিম তার গানের বলয় তৈরি করেছিলেন একান্তই তার আঞ্চলিক উপাদান দিয়ে। তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ধল গ্রামে। যেখানে ছয় মাস পানিবন্দী অবস্থায় থাকতে হয়। তিনি খুব কাছ থেকেই সেই ভাটি এলাকার মানুষের দুঃখ, দুর্দশার চিত্র অবলোকন করতে পেরেছিলেন। ব্যাক্তিগত জীবনেও তাকে অভাব-অনটনের কাঠখড় পোহাতে হয়েছে।
সেই ছোটবেলা থেকেই গাঁয়ের মোড়লের বাড়িতে রাখাল হিশেবে কাজে গিয়েছিলেন। মাঠে-ঘাটে গরু চড়াতে চড়াতে তাই তিনি যে গানগুলো বেঁধেছিলেন সে গানগুলো মূলতই ছিলো সেইসব এলাকার মানুষের জরাজীর্ণ জীবনের প্রতিচ্ছবি। তাই সঙ্গীত জীবনে তিনি বিভিন্ন তত্ব গান গেয়ে গেলেও তার ঝুলিতে রেখেছিলেন গণমানুষের জন্য কিছু গান।
একবার আমাদের মৌলভীবাজারের খ্যাতনামা লেখক এবং লোক গবেষক মাহফুজ ভাই আদুল করিমকে গরিব মেহনতী মানুষের মুক্তি নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। সেই প্রশ্নের উত্তরে আব্দুল করিম সহজ সাবলীল ভাষায় বলেছিলেন, 'এ দেশে বিপ্লব হোক, মানুষ মানুষের মতো বাঁচার অধিকার পাক, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক এটা আমি মনেপ্রাণে কামনা করি। এ সম্পর্কে আমি গানেও বলেছি।'
পেছনে শাহ আব্দুল করিমের নির্মানাধীন সমাধি। যেখানে সমাহিত আছেন তার প্রাণের প্রিয় সরলাও। ছবি- রূপন দাশ
সাধারণত বাউল সম্প্রদায় দেহ সাধনার মাঝেই তাদের এক জীবন কাটিয়ে দেন। কিন্তু আব্দুল করিম সেই দেহ সাধনার মাঝেও উপলব্ধি করেছিলেন গণ মানুষের মুক্তির বিষয়টি। তার মতে, 'মানুষই যদি না বাঁদে তাহলে দেহ সাধনা করবে কে? দেহ সাধনা করতে তো কেউ বাধা দিচ্ছে না। তবে বিপন্ন মানুষের কথাও ভাবতে হবে। তাই আমি সুযোগ পেলেই মানুষের দুঃখ দুর্দশার কথা তোলে ধরি।' আব্দুল করিমের এহেন বক্তব্যে একজন শিল্পী হিশেবে সাধারণ মানুষের কাছে দায়বদ্ধতার জায়গাটি পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে।
এতসবের পরেও আব্দুল করিম নিজেকে নিয়ে দুঃখ করেছেন শেষ জীবনে। তিনি মনে করতেন একজন শিল্পী হিশেবে সাধারণ মানুষের যতোটা কাছে থাকার কথা তিনি তা পারেন নি। তিনি বলেন, 'আমি আসলে তাক ধরে দুঃস্থদের জন্য কিছু লিখিনি। আমি শুধু নিজের কথা বলে যাই। ভাটি এলাকার একজন বঞ্চিত, নিঃস্ব, দুঃখী মানুষ আমি। আমার কথা সব হাভাতে মানুষের কথা হয়ে যায়।'
আসলেও তাই। আব্দুল করিম বুঝতেই পারেন নি তিনি তাঁর গানের পরিধি বিস্তৃত করলেও তাঁর মন সবসময় পড়ে রয়েছে ভাটি বাংলায়। তাই নিজের অজান্তেই তিনি নিজের দুঃখের কথা ভেবে যেই গানগুলো গেয়েছেন বা লিখেছেন সে গানগুলো অন্য দশটা হাভাতে মানুষের দুঃখের কথা হয়ে গিয়েছে। আব্দুল করিম সবশেষে ভাটির কবিই ছিলেন, এবং এখানেই তার স্বার্থকথা বলে আমি মনে করি।
তবে সবশেষে যদি প্রশ্ন উঠে একজন ভাটির বাউল হিশেবে আব্দুল করিম কি তার যথার্থ মর্যাদা পেয়েছেন? (যদিও তিনি নিজেকে বাউল সত্তার অনেক ঊর্ধে নিয়ে গিয়েছেন) উত্তর পাঠকমহল দিবেন, আমি শুধু একটা ঘটনা বলে ইতি টানছি।
আব্দুল করিম জীবনে বহুবার প্রতারণার শিকার হয়েছেন। নিজ গ্রাম থেকে শুরু করে শহুরে শিক্ষিত জনের কাছে প্রতারিত হয়েছেন তিনি। এর কারণ ছিলো আব্দুল করিম যে বাংলা লোকগানে একটা নতুন মাত্রা যোগ করেছেন তা আব্দুল করিম না জানলেও অনেক শিক্ষিত জন তাঁর গান শোনেই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তারা আব্দুল করিমকে ব্যবহার করেছেন নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য। কেন এ কথা বললাম?
দেশ স্বাধীনের পরে আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামাদ আজাদ সাহেব তার নির্বাচনী সভায় আব্দুল করিমকে আনিয়েছিলেন। এর কারণ ছিলো আব্দুল করিমের দর্শকপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। তাই সাধারণ মানুষের ভোট প্রাপ্তির জন্য তখন সামাদ আজাদ সাহেবের কাছে আব্দুল করিমকেই সবথেকে ভালো টোপ মনে হয়েছে। তাই তিনি তার নির্বাচনী সভায় আব্দুল করিমকে আনার জন্য তার বাড়িতে লোক পাঠান। এদিকে আব্দুল করিমের বাড়িতে তখন তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী সরলা (যাকে তিনি মুর্শিদ মানতে) অসুস্থ ছিলেন। তবুও সেদিন অসুস্থ স্ত্রীকে বাড়িতে রেখে সামাদ আজাদ সাহেবের সেই নির্বাচনী সভায় গিয়েছিলেন আব্দুল করিম৷ সেই সভায় সাধারণ মানুষ সামাদ আজাদের বক্তব্য শোনতে চায়নি। তারা বারবার উচ্চস্বরে বলছিলো, 'বক্তব্য দেওয়া লাগতো নায়, ভোট আমরা আফনারেই দিমু সামাদ সাব। আফনে করিম ভাইরে কইন আরো দুইটা গান হুনাইতা।'
সেদিন সভায় সামাদ আজাদের বক্তব্যের চেয়েও সাধারণ মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো আব্দুল করিমের গান। আব্দুল করিম সেই সভায় দুইটি গান শুনিয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ঘটে তার সাথে। ক্ষমতায় যাওয়ার পরে সামাদ আজাদ সাহেব আর আব্দুল করিমকে মনে রাখেন নি। খুব যত্ন করেই ভুলে গিয়েছিলেন। ফলে জীর্ণ আব্দুল করিমকে শীর্ণভাবেই যাপিত জীবন বয়ে বেড়াতে হয়েছে।
আব্দুল করিম তার গানের সহজ ভাষায় যে গভীর ভাবের সঞ্চার করেছিলেন তা অনেক বোদ্ধাদেরকেও অবাক করে দিয়েছিলো। তাই তারাও এই সুযোগটি হাতছাড়া করেন নি। আব্দুল করিমকে নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা শুরু করে দেন, টেলিভিশনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। কিন্তু পারতপক্ষে আব্দুল করিম এগুলো এড়িয়েই চলতেন। তবু একবার এই গাড্ডায় পড়েও প্রতারিত হতে হয়েছে তাঁকে।
জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ একবার টেলিভিশনে আব্দুল করিমের গান দিয়ে একটি প্যাকেজ অনুষ্ঠান করেন। সেখানে তিনি আব্দুল করিমকেও ডাকিয়ে নেন। কিন্তু একজন শিল্পী হিশেবে আব্দুল করিমকে যেই মর্যাদাটুকু দেওয়ার কথা সেটুকু তিনি দেন নি। বরং নিরব অপমানিত হয়েছিলেন সেদিন আব্দুল করিম। সেদিনের অনুষ্ঠানে হুমায়ুন আহমেদ একটিবারের জন্য আব্দুল করিমের সাথে সাক্ষাৎ করেন নি। এমনকি আব্দুল করিমের সম্মানীটুকুও তিনি পাঠিয়েছিলেন তার গাড়ির ড্রাইভার মারফত! হুমায়ুন আহমেদ তার সাথে সেদিন সৌজন্যমূলক আলাপটুকু পর্যন্ত করেন নি। এতে খুব ব্যথিত হয়েই আব্দুল করিম এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'ভাটির বাউলরা কি এতই অস্পৃশ্য? এভাবেই উপেক্ষিত থাকবে যুগের পর যুগ? হাওর অঞ্চলে জন্ম আমার, মনটাতো ছোট নয়। শুধুমাত্র ক'টা টাকার জন্যই কি ধল থেকে এতোদূরে ঢাকায় গিয়েছিলাম?'
আব্দুল করিমের এই প্রশ্নের উত্তর হুমায়ুন আহমেদ বেঁচে থাকলে কী দিতেন আমার জানা নেই। তবে এটা সত্য যে শুধু আব্দুল করিমই নয় আদিকাল থেকেই এদেশের সাধারণ বাউলদেরকে অনেকটা অস্পৃশ্যই ভেবে আসছি আমরা। আর এটি বর্তমানে আমাদের শিল্প-সাহিত্যে প্রকট আকার ধারণ করেছে। এর কারণও আছে।
আমার কেন জানি মনে হয় আমাদের শিল্প-সাহিত্য জাগতে বর্তমানে একটা ভাঁড়ামি ঢুকেছে। যার সর্বশ্ব জুড়ে জড়িয়ে আছে পুঁজি। যেখানে আসলে সাধারণ বাউলদের কোন জায়গা নেই। তানাহলে আজ দোতরা হাতে গান গেয়ে গেয়ে বাউলদেরকে ভিক্ষা করে জীবন ধারণ করতে হতোনা। অন্যদিকে এই সাধারণ বাউলদের গান গেয়েই কিন্তু অনেকে প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হয়ে যাচ্ছেন!
আব্দুল করিমের অনেক গানে উল্লেখ আছে যেই নদীর কথা, এই সেই কালনী। আমরা যখন ফিরে যাচ্ছি কালনীর বুকেও তখন নেমেছিলো দিনের ক্লান্ত সূর্য
একদিকে প্রকৃত বাউলরা হারিয়ে যাচ্ছেন অভাব-অনটনের তলানিতে অন্যদিকে এই তলানিতে পড়ে থাকা বাউলদের গান গেয়েই শিল্পীবৃন্দের একটা অংশ দিব্যি জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন। এটা কি শিল্প-সাহিত্য মাধ্যমে নেহাতই ভাঁড়ামি নয়? সুতরাং, আব্দুল করিম 'অস্পৃশ্য' শব্দটি ব্যবহার করে যেই প্রশ্নটি মারা যাওয়ার আগে করে গিয়েছিলেন তার উত্তর তো আমাদের কাছেই আছে। নির্লজ্জের মতো এবার এই উত্তরটা দিয়ে দিলেই হয়।
- তথ্যসূত্র: (শাহ আব্দুল করিম পাঠ ও পাঠকৃতি, করিমপূত্র শাহ নূর জালাল, নুরুন্নেসা খালা। যিনি আব্দুল করিমের স্ত্রী সরলা মারা যাওয়ার পর থেকে করিমের পরিবারটির দেখভাল করে আসছেন। নুরুন্নেসা খালার বাড়ি যতটুকু জানি মৌলভীবাজারের পাঁচগাঁয়ে।)
আরও পড়ুন
খোলা জানালা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ
সর্বশেষ
জনপ্রিয়