অনিক দেব, শিক্ষার্থী চবি
আপডেট: ১৭:০১, ১৭ অক্টোবর ২০২২
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে ছাত্রদের অধিকার নিয়ে বলার কেউ নেই
প্রতিকৃতি- আইনিউজ
বাংলাদেশের দক্ষিণপূর্বাঞ্চলের প্রাচ্যের হার্ভাডখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ২১০০ একরের ভূমি নিয়ে এটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয় অনন্য অবদান রেখেছে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বিভিন্ন আন্দোলনে। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গড়ে উঠেছে দেশের অন্যতম নেতৃবর্গ যারা অতীত এবং বর্তমানে দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে স্বমহিমায় স্থায়ী আসন পেতে নিয়েছেন।
তবু গত কয়েকবছর ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই, নেই কোনো রাজনৈতিক তৎপরতাও। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি যেনো এক মুখিয়ে পড়া ভ্রান্ত এককেন্দ্রিক শত্রুতার কেন্দ্রস্থলে রূপ নিয়েছে!
বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির রাজনৈতিক অঙ্গনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় একটি বৃহৎ ইউনিট। তবু এখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি কেন্দ্রীভূত হয়েছে এককেন্দ্রিকতায়, স্বৈর-ছাত্ররাজনীতির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে ছাত্রসংগঠন।
বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য কোনো দলের অস্তিত্ব নেই৷।যদিও ২০১৫ সালের আগে পর্যন্ত এখানে ইসলামি ছাত্র শিবির ও ইসলামি কিছু ছাত্রসংগঠন অত্যন্ত সক্রিয় ছিলো। তাদের কার্যক্রমে সাধারণ শিক্ষার্থী হতে শুরু করে অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের কর্মীরাও ভীত থাকতো। প্রগতিবাদের চর্চা ছিলো প্রায় মৃত, সাংস্কৃতিক বা, কোনোধরনের আধুনিকতার চর্চাকে তারা বক্রদৃষ্টিতে দেখতো।
ছাত্রলীগের ভাষায়- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রশিবিরের দৌরাত্ম্য ও প্রভাব লোপসহ তাদেরকে স্থায়ীভাবে ক্যাম্পাস-আউট করা ছাত্রলীগের বৃহৎ অর্জন।
তাছাড়া, এখানে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোও ইদানীং একেবারে ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। তারা প্রকাশ্যে কোনোরূপ আন্দোলন, সভা-সমাবেশ, কিংবা সরকারের অথবা, রাষ্ট্রের কোনো সমালোচনা করে রাস্তায় দাঁড়াতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার সমালোচনায় তারা রাস্তায় দাঁড়ালেও তাদের ব্যানারে, ফেস্টুনে লেখা থাকে- সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দ অথবা, প্রগতিশীল ছাত্রজোট।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্টের নাম শোনা গেলেও এখন তাদের কোনোরূপ প্রকাশ্য কর্মসূচি নেই, তারা রাস্তায় নামলে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ছাত্রলীগ। এমনকি ইদানীং তাদের কর্মী সংখ্যাও হ্রাস পেতে পেতে ক্রান্তিলগ্নে পৌঁছেছে।
ইসলামি ছাত্রশিবিরের মতো বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের অস্তিত্ব এখানে একদমই নেই। তারা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করার মতো সাহসও রাখেনা। তাদের কার্যক্রম একদম শূন্যের কোটায়। ছাত্রদল বা, ছাত্রশিবির নাম শুনলেই ক্ষেপে যায় ক্ষমতাসীন সংগঠন ছাত্রলীগ, এটা সারাদেশেই বিদ্যমান।
তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতি- ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য যেকোনো সংগঠনকে যেনো জিরো টলারেন্স দৃষ্টিতে দেখছে। অতএব, এসব সংগঠনের কোনো প্রকাশ্য নতুন কর্মী সৃষ্টির সুযোগ নেই, যদিবা অল্পকিছু থেকে থাকে তাদেরকেও গোপনে থাকতে হয়। ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে তাদের প্রকাশ্য প্রবেশসহ যেকোনো ধরনের মন্তব্য ও বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য।
নির্দ্বিধায় বলা যায় এখানে গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা নেই, মুক্তচিন্তার চর্চা থাকলেও মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ নেই। সরকারের সমালোচনা করাকে এখানে কঠোরভাবে দমন করা হয়। এই মনোভাব থেকে ছাত্রলীগ নিজেকে কলুষিত করছে এবং ছাত্রলীগের অতীত সুনামকে ক্ষুণ্ণ করছে।
আবার ছাত্রলীগের রাজনীতিও বহুধাবিভক্ত, একটিমাত্র ছাত্র সংগঠন থাকা সত্ত্বেও এখানে ছাত্রলীগের উপদলের সংখ্যা প্রায় ১২টি। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য- সিএফসি, বিজয়, সিক্সটি নাইন, ভিএক্স, একাকার, এপিটাফ, বাংলার মুখ, রেড সিগন্যাল, উল্কা, কনকর্ড ইত্যাদি।
সবগুলো উপগ্রুপ এখন আর তেমন সক্রিয় নেই, অনেক গ্রুপই কর্মীর অভাবে বিলুপ্তপ্রায়। বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান নওফেলের অনুসারী সিএফসি ও বিজয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অত্যন্ত সক্রিয়। অন্যদিকে চট্টগ্রাম সিটির সাবেক মেয়র আ.জ.ম. নাছির উদ্দীনের অনুসারী সিএক্সটি নাইন ও ভিএক্সের তুমুল প্রভাবও বিদ্যমান।
যদিও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশ অনুযায়ী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ ইউনিটের গ্রুপিং রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবু এখনও এখানে গ্রুপিং রাজনীতিই সবচেয়ে প্রবল। বর্তমান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেল সিএফসি উপগ্রুপের প্রধান, সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপু সিক্সটি নাইনের প্রধান, সহ সভাপতি প্রদীপ চক্রবর্তী দুর্জয় ভিএক্সের প্রধান ও যুগ্ম সম্পাদক মো.ইলিয়াস বিজয় গ্রুপের প্রধান হিসেবে পরিচিত।
দেখা যায় গত ৪-৫ বছরে তারা ঠুনকো বিষয় নিয়ে বারবার সংঘর্ষে জড়িয়েছেন, গ্রুপিং সমস্যার জন্য শাটল ট্রেনের হুইস পাইপ কেটে দিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক বন্ধ করে দিয়েছেন, হল ভাংচুর করেছেন।
সম্প্রতি দীর্ঘ প্রায় আড়াই বছর পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেওয়া হলেও এই কমিটি নিয়েও সহিংসতা দেখা দেয়। বিভিন্ন উপগ্রুপ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পাঠকার্যক্রম ব্যহত করে, পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেয়।
ছাত্রলীগের নীতি বহির্ভূত এই কমিটিতে শুধু সহ-সভাপতির পদে আছেন প্রায় সত্তরজনের মতো নেতা, সর্বমোট ৩০০ এর মতো সদস্য নিয়ে গঠিত এই কমিটি ছাত্রলীগ কর্মীদের সুসংগঠিত করতে ব্যর্থ।
অনেক ছাত্রলীগ নেতা ও কর্মীর মতে- ছাত্রলীগের এই কমিটিতে স্বজনপ্রীতিতার ছাপ আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে নব্যপ্রবেশ করা অনেকেই আছেন গুরুত্বপূর্ণ পদে। এ নিয়ে উপগ্রুপগুলোর মধ্যে ক্ষোভের অন্ত নেই। তারা পুনঃপুন আন্দোলন ও সহিংসতা করে যাচ্ছেন বর্ধিত কমিটির জন্য।
তবে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র অধিকার পরিষদ নেই। চাকসু নির্বাচন নেই। ছাত্র-ছাত্রীদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া তুলে ধরার মতো কেউই নেই। এমনকি ছাত্রলীগও এ ব্যাপারে নিস্ক্রিয়, প্রায় ২৮ বছর হয় এখানে চাকসু নির্বাচন নেই।
সর্বশেষ ১৯৯০ সালের ৮'ই ফেব্রুয়ারী চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৯ সালে ছাত্র ইউনিয়নসহ বেশকিছু সংগঠন চাকসু নির্বাচনের দাবি নিয়ে মানবন্ধন ও সাবেক ভিসি ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর নিকট স্মারকলিপি দিলেও তিনি তার মেয়াদে চাকসু নির্বাচন দিতে ব্যর্থ হন। পরবর্তী বর্তমান ভিসি ড. শিরিন আখতারেরও এ ব্যাপারে ভ্রুক্ষেপ নেই।
একটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে আড়াইযুগ ধরে চাকসু নির্বাচন নেই এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারকদের ব্যর্থতা প্রমাণ করে। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে কোনো শিক্ষার্থী বা, তাদের প্রতিনিধি না থাকায় প্রতিনিয়ত তাদেরকে হেনস্থা হতে হচ্ছে।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের অন্যতম অধিকার হলে সিট পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। একমাত্র ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাই হলে থাকতে পারছে। যেহেতু তাদের একক আধিপত্য বিরাজ করে, তাদের সাথে প্রশাসনও তাল মিলিয়ে চলছে।
গত পাঁচবছর ধরে সাধারণ শিক্ষার্থীরা হলে থাকার সুবিধা থেকে বঞ্চিত, একমাত্র ছাত্রলীগের রাজনীতি করলেই হলে সিট পাওয়া সম্ভব। একটু গভীরভাবে দৃষ্টি দিলে এটাও প্রতীয়মাণ হয় যে- এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি সিট রাজনীতি। নেতা-কর্মীরা নতুন শিক্ষার্থীদের হলে থাকার সুযোগ দেওয়ার বিনিময়ে তাদের গ্রুপে যুক্ত করেন, ফলে একপ্রকার বাধ্য হয়েই অনেক শিক্ষার্থীকে তাদের সাথে যুক্ত হতে হয়। এ ব্যাপারে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের অন্ত নেই।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিতে সরকার দলীয়দের একচ্ছত্র প্রভাব যতোটা অগণতান্ত্রিক তেমনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য ছাত্র অধিকার পরিষদ না থাকা আরো বেশী দুঃখের। এর দায়ভার কে নিবে, ক্ষমতাসীন দল নাকি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, প্রশ্নটা সকল শিক্ষার্থীর।
- খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আইনিউজে আরও পড়ুন-
- ২০ হাজার গানের জনক গাজী মাজহারুল আনোয়ার ও তার কীর্তি
- প্রেম-ভালোবাসার ১০ উপকারিতা : শ্রেষ্ঠ কিছু প্রেমের গল্প
- কোমরে বাশি, হাতে তালি — গানই মদিনা ভাই’র জীবন-মরণ
দেখুন আইনিউজের ভিডিও গ্যালারি
সৌদি আরবে মেয়েকে নির্যাতনের খবরে মায়ের আহাজারি-কান্না
গ্রিসের বস্তিতে বাংলাদেশীদের মানবেতর জীবন, অধিকাংশই সিলেটি
গ্রিসে পাঁচ বছরের ভিসা পাবে বাংলাদেশিরা
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ