সোহেল সানি
আপডেট: ১২:৩০, ১৮ অক্টোবর ২০২২
শেখ রেহানার চোখে
শেখ রাসেলের কোনো কাকুতিই সেদিন ঘাতকদের মন দুর্বল করতে পারেনি!
লেখক- সোহেল সানি সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
প্রতিটি শিশুর অন্তরে- নিভৃতে চির-বিরাজমান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শিশুপুত্র শেখ রাসেল। শেখ রেহানার চোখে কেমন ছিল, আদুরে ছোট্ট ভাই শেখ রাসেল? রাসেলের কথাগুলোই প্রচন্ড আবেগ বিহ্বলে করুণ ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন শেখ রেহানা।
বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানার স্মৃতি রোমন্থন করে বললেন, "বাবার কাছে আমাদের ছোট্ট ভাইটির নানা আবদার ছিলো। রাসেলকে আব্বা সব সময় তাঁর কাছে রাখতে চাইতেন। মাঝেমধ্যে ওর সঙ্গে আমার লেগে যেতো, আমি বলতাম, আমি ছোট, ও বলত তুমি আগে ছোট ছিলে, এখন আমি ছোট।"
শেখ রেহানা বলেন, আমাদের সঙ্গে রাসেলেরও জার্মানিতে যাবার কথা ছিল। মা ওকে ছাড়েনি না। সেদিন যদি আসতো তাহলে রাসেলও বেঁচে যেতো।
এ কথাগুলো শেখ রেহানা তাঁর ডায়েরির পাতায় লিখে রেখেছেন। শেখ রেহানা তাঁর আদুরে ভাই শেখ রাসেলের কথা স্মরণ করতে গিয়েব ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েন।
শেখ রেহানা ডায়েরিতে লিখেছেন- সেদিন ছোট্ট শিশু হত্যায় কি আল্লাহর আরশ কাঁপেনি? পাখিরা গান ভুলে গিয়ে বেদনায় ডানা ঝাপটায়নি! বৃক্ষ, লতা, পাতা, ফুল কি কষ্টে নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে ওঠেনি?
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের হৃদয় স্পন্দনকে স্তব্ধ করে এই দেশেরই কতিপয় দানব সদৃশ্য মানব ঘাতক হ ত্যা র তাণ্ডবলীলায় মেতে উঠেছিল।
ঘৃণ্য, জঘন্য সেই দিন বাঙালি জাতির জন্যই চরম দুর্ভাগ্যের দিন। যেদিন শুধু রাসেলকেই নয়, ঘাতকদের বুলেট কেড়ে নিয়েছে তার পিতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, মমতাময়ী মা, প্রিয় ভাইদ ও ভাবীদের।
উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালের ২৯ জুলাই পশ্চিম জার্মানিতে থাকা স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদের কাছে বেড়াতে যান বঙ্গবন্ধুর শেখ হাসিনা তাঁর দুই শিশুসন্তান সজিব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে নিয়ে। সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানা। বঙ্গবন্ধু হ ত্যা র পর আর তাঁদের নিজ মাতৃভূমিতে ফেরা হয়নি। ওখান থেকেই তাঁরা ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন।
শেখ রেহানার অশ্রুসিক্ত ভাষায় দশ বছরের আদুরে ছোট ভাই শেখ রাসেলের সঙ্গে তার শেষ দেখা ২৯ জুলাই। ১৯৮৩ সালের ২১ জানুয়ারি স্বদেশে ফিরি ধানমন্ডির বাড়িটিতে প্রবেশ করেন। ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল চোখ, ঝাঁকিয়ে উঠেছিল মন। কেঁপে উঠেছিল বুক। পৃথিবীর সমগ্র কষ্ট অন্তরে চাপা দিয়ে আজ লিখেছি, রাসেলের সঙ্গে আমার সারাদিন খুনসুটি চলত। একটা সাইকেল নিয়ে সে পড়ে থাকত।
যে শিশু বোঝে না মানবিক জটিল ঘোরপ্যাঁচ, শুধু দেখতো সুন্দর চাঁদ, নীল আকাশের অপরূপ তারা, যে শুনত পাখির গান, আর বুঝত মানুষের ভালোবাসা, বোনদের আদর, মা-বাবার স্নেহ, ভাইদের মিষ্টি বকুনি, সেই অবুঝ শিশুকেও পাষণ্ড নরাধমরা হ ত্যা করেছে। বোধহয় ঘাতকরা ভেবেছিল, এই শিশু ধীরে ধীরে একদিন বড় হবে এবং একদিন লাখো কোটি মানুষ ওর মধ্যেই খুঁজে পাবে মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে।
বড় বোন দুই শিশুসন্তানের মা, শেখ হাসিনার সঙ্গে জার্মানিতে গিয়েছিলেন শেখ রেহানা। শেখ হাসিনার স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া তখন পশ্চিম জার্মানিতে ছিলেন। তার কাছেই তাদের বেড়াতে যাওয়া। তাদের ২৩ আগস্ট দেশে ফেরার কথা ছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘটে যায় ইতিহাসের নিষ্ঠুর হ ত্যা কা ণ্ড। বাবা-মা,ভাইদের,ভাবীদেরসহ নিকটতম আত্মীয়-পরিজন হারানোর খবর শুনতে হয় জার্মানিতে বসেই।
ফলে দুইবোনকে জীবন বাঁচাতে ভারতের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়। আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হবার কারণে ১৯৮১ সালের ১৭ মে বড় বোন শেখ হাসিনা স্বদেশে ফিরলেও শেখ রেহানা ফেরেন ১৯৮৩ সালের ২১ জানুয়ারি।
যেভাবে হ ত্যা করা হয় রাসেলকে
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠপুত্র শেখ রাসেল। হ ত্যা য জ্ঞে র মধ্যে এক ঘাতক তাকে নিচে নামিয়ে আনে। রাসেল দৌড়ে গিয়ে প্রথমে কাজের ছেলে রমা এবং পরে মহিতুল ইসলাম মহিতের হাত ধরে। সেখানেই রাসেল দেখতে পায় বড় ভাইয়া শেখ কামালের মৃতদেহ।
মহিতুল ইসলাম মহিত রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী (বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বাদী)। শেখ রাসেল মহিতকে জড়িয়ে ধরে বলছিল, ‘ভাইয়া ওরা আমাকে মারবে না তো?’ মহিত বলেছিল,‘না, ভাইয়া তোমাকে মারবে না।’
এই সময় এক ঘাতক মহিতের কাছ থেকে রাসেলকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়, গেইটের কাছে পুলিশ বক্সে। রাসেল কেঁদে কেঁদে শুধু মায়ের কাছে যাবার কথা বলছিল। ঘাতকটি রাসেলকে এক সৈন্যের কাছে রেখে বাড়ির ভেতরে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর ঘাতক আবার ফিরে আসে। ঘাতক এবার রাসেলকে বলে, চলো এবার তোমাকে তোমার মায়ের কাছে দিয়ে আসি। শেখ রেহানা বলেন, কোনও কাকুতি মিনতি ঘাতকের পাষণ্ড মন দুর্বল করতে পারেনি।
রাসেলকে দোতালায় নিয়ে গিয়ে গুলি করে হ ত্যা করা হয়। যেখানে পড়ে ছিল প্রিয় বড় ভাবী সুলতানা কামালের মৃতদেহ। ছোট্ট শিশু মায়াবী মুখের রাসেল। সে বাঁচতে চেয়েছিল। ঘাতকের বুলেটে লুটিয়ে পড়া প্রাণহীন জনতার বুকে মাথা গুঁজে বাচঁতে চেয়েছিল, দৌড়ে ভাবীদের আঁচলে মুখ লুকিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল, বাড়ির কাজের লোকদের ভিড়ে ছুটে গিয়ে লুকাতে চেয়েছিল- বেঁচে থাকার ইচ্ছায়- কিন্তু পারেনি। পাষণ্ডরা শিশুটির বুক ঝাঁঝরা করে দিল।
বনানী গোরস্থানে সবার লাশ দাফনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা স্টেশন কমান্ডার লে. কর্নেল এম এ হামিদ পিএসসির বর্ণনা মতে, সুলতানা কামালের কোল ঘেঁষে রাসেলের মৃতদেহ দেখা যায়। তার মাথার খুলির পেছন দিক একেবারে থেঁতলে যায়।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বাদী আ ফ ম মহিতুল ইসলাম মহিতের ভাষ্যমতে, সর্বশেষ হত্যাটি ছিল শেখ রাসেলের আর শেখ কামাল ছিল প্রথম হত্যা। ১৯৬৪ সালের ১৬ অক্টোবর শেখ রাসেলের জন্য। গণমানুষের অন্তরে, প্রতিটির শিশুর মনে, নিভৃতে চির-বিরাজমান শেখ রাসেল।তার মৃত্যু হয়নি। আকাশে বাতাসে, নদীর কলতানে, অরণ্যের প্রাণশক্তিতে মিশে আছে। থাকবে মিশে অনন্তকাল।
সোহেল সানি, সিনিয়র সাংবাদিক কলামিস্ট ও ইতিহাসবিদ
- খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আইনিউজ/এইচএ
আইনিউজে আরও পড়ুন-
- কোমরে বাশি, হাতে তালি — গানই মদিনা ভাই’র জীবন-মরণ
- ‘গাছ হেংলানেছে- পয়সা মিলেগা’ : চা শ্রমিক ও চা শিল্প
- পোশাক নয়, নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ জরুরি
বিশ্বের মজার মজার গল্প আর তথ্য সম্বলিত আইনিউজের ফিচার পড়তে এখানে ক্লিক করুন
দেখুন আইনিউজের ভিডিও গ্যালারি
দিনমজুর বাবার ছেলে মাহির বুয়েটে পড়ার সুযোগ || BUET success story of Mahfujur Rhaman || EYE NEWS
হানিফ সংকেত যেভাবে কিংবদন্তি উপস্থাপক হলেন | Biography | hanif sanket life documentary | EYE NEWS
আশ্চর্য এন্টার্কটিকা মহাদেশের অজানা তথ্য | Antarctica continent countries | facts। Eye News
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ