অ্যান্ড্রোস লিহন
ডিপ্রেসড ব্যক্তিকে বিরক্ত করা কতোটা ক্ষতিকর?
ছবি- আইনিউজ
-
আজকের বিজ্ঞান আমাদের বলছে ডিপ্রেসন বিবর্তিত হয়েছে সমস্যার সমাধান করার জন্য। আমরা তখনই ডিপ্রেসনে আক্রান্ত হই যখন আমরা কঠিন সমস্যায় পড়ি। গবেষকরা একসময় ভেবেছিলেন, ডিপ্রেসন তৈরি হয় জীবাণুর কারণে। মা যদি জীবাণু সংক্রমিত হয় তবে সে সন্তান থেকে দূরে থাকে যেন সন্তানকে প্যারাসাইট থেকে সেইফ রাখা যায়।
আমাদের একটি অত্যন্ত সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে আর তা হল ডিপ্রেসন আক্রান্ত ব্যক্তিকে বিরক্ত করা। যে একা থাকতে চায় আমরা তার সাথে জোর করে সংযুক্ত হতে চাই, তার একাকীত্ব স্পয়েল করি। একজন ব্যক্তি যখন ডিপ্রেসনে ভোগে সে সোশ্যাল আইসোলেশন চায়, তার খাবারের প্রতি আগ্রহ কমে যায়, তার মধ্যে যৌনতা কাজ করে না এবং তার কথা বলতে কষ্ট হয়। আর ঠিক তখনই আমরা তাকে ভুল বুঝি ও বাড়াবাড়ি করি। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন বিজ্ঞানী, ম্যাথম্যাটিশিয়ান অথবা ইন্টেলেকচুয়াল মানুষরা। কারণ ডিপ্রেসনের সাথে বুদ্ধিমত্তার একটি সম্পর্ক আছে।
কিন্তু প্রশ্ন হল, কেন তারা সামাজিক একাকীত্ব প্রত্যাশা করছে, কেন একা থাকার প্রবণতা, কেন লাইফ থ্রেটেনিং আচরণ? ডিপ্রেসন কি সুইসাইডকে ট্রিগ্যার করে? এর সরাসরি উত্তর হল, না! ডিপ্রেসন সুইসাইডের কারণ নয় বরং একজন ডিপ্রেসড মানুষকে ভারসাম্যপূর্ণ মাত্রায় ডিপ্রেসড থাকতে না দেয়াটাই তার সুইসাইডের কারণ হতে পারে।
আজকের বিজ্ঞান আমাদের বলছে ডিপ্রেসন বিবর্তিত হয়েছে সমস্যার সমাধান করার জন্য। আমরা তখনই ডিপ্রেসনে আক্রান্ত হই যখন আমরা কঠিন সমস্যায় পড়ি। গবেষকরা একসময় ভেবেছিলেন, ডিপ্রেসন তৈরি হয় জীবাণুর কারণে। মা যদি জীবাণু সংক্রমিত হয় তবে সে সন্তান থেকে দূরে থাকে যেন সন্তানকে প্যারাসাইট থেকে সেইফ রাখা যায়।
আবার অনেকে বলেন, বয়স বাড়ার সাথেসাথে ডিপ্রেসন বেড়ে যায়। কিন্তু পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বয়সের সাথে ডিপ্রেসনের সম্পর্ক নেই বরং অল্প বয়সী তরুণরা বৃদ্ধদের থেকে বেশি ডিপ্রেসড।
ডিপ্রেসড হবার পেছনের কারণটা ঠিক কী?
সায়েন্টিফিক আমেরিকানে প্রকাশিত একটি আর্টিকেলে বলা হয়, যে সকল ছাত্র কঠিন কঠিন ম্যাথ সমাধান করে তারা ডিপ্রেসড হয়ে একা হয়ে যায়, তারা কারও সাথে তেমন কথা বলতে চায় না, খেতে ইচ্ছে করে না। আমি নিজেও যখন কঠিন কোনো বই পড়ে বুঝতে পারি না, আমি সামাজিক একাকীত্ব গ্রহণ করি, আমার ডিপ্রেসন কাজ করে।
জীবনে যখন কঠিন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়, যা আমাদের নিজেদেরই সমাধান করতে হবে আমরা হতাশ হই। কারণ কারও সাথে কথা বললে, খাবার চিবালে, কোলাহোল, আড্ডা ও খেলাধুলায় অংশ নিলে আমাদের প্রচুর শক্তি খরচ হবে। এই সময় আমাদের দেহে শক্তির সংকট কাজ করে। কিন্তু কেন?
মস্তিষ্কে আছে ডিপ্রেসনের অন/অফ বাটন!
বিজ্ঞানীরা ইঁদুরের মস্তিষ্কে এক ধরণের মলিক্যুল খুঁজে পান যার নাম 5HT1A। এটি সরাসরি ডিপ্রেসনকে টার্ন অন করার সাথে জড়িত। তারা 5HT1A- এর ফাংশনাল অংশ মানুষের সাথে তুলনা করে দেখেছিলেন তারা দেখতে পান যে, এটি মানুষের সাথে ৯৯% মিলে যায়। অতএব দেখা যাচ্ছে, আমাদের মস্তিষ্ক নিজেই 5HT1A মলিকিউল প্রিজার্ভ করে যেন ডিপ্রেসনকে সুইচ অন করা যায়।
যদি ডিপ্রেসন মস্তিষ্কের ম্যালফাংশন হত, এর কোনো উপকারী দিক না থাকত তাহলে প্রাকৃতিক নির্বাচন লাখ লাখ বছর ধরে এই মলিকিউলকে প্রিজার্ভ করত না, বাদ পড়ে যেত। মূলত একজন ব্যক্তি যখন সমস্যায় পড়ে ডিপ্রেসড হয় তখন সে সমস্যাটির প্রতিটি পয়েন্টকে খণ্ড খণ্ড করে বুঝতে চায়। একটা সময় সে প্রত্যেকটি পয়েন্টকে বিশ্লেষণ করে ভেঙে প্রতিটি পয়েন্ট এক করে ফেলে আর সমস্যাটি সমাধান হয়ে যায়। চিন্তার এ অ্যানালিক্টিক্যাল স্টাইল খুবই প্রোডাক্টিভ। চিন্তাকে যেহেতু তারা বিভিন্ন খণ্ডে ভাগ করে ফেলে, অতএব এ খণ্ড খণ্ড উপাদানগুলো কিন্তু এত বেশি জটিল নয় , যার ফলে সমস্যা অনেক বেশি সহজ হয়ে ওঠে।
মূলত, যখন আপনি কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হবেন। যেমন- ম্যাথমেটিক্স সংক্রান্ত, আপনার মধ্যে ডিপ্রেশনের অনুভূতি জন্ম হবে, এটা খুব উপকারী। কারণ, তখন ডিপ্রেসন আপনাকে ম্যাথটি অ্যানালায়েজ ও সলভ করতে সাহায্য করবে।
গবেষণায় যা দেখা গেছে
গবেষণায় দেখা গেছে, যখন মানুষ কোনো জটিল সমস্যার মধ্যে পড়ে তখন সে বারবার ডিপ্রেসড হয়ে যায় বা তার মস্তিষ্কে ডিপ্রেসন সুইচ অন হয়, আর যাদের মস্তিষ্কে ডিপ্রেসন বেশি দেখা দেয় তারাই সবচেয়ে High Score করে!
কিন্তু একটি সমস্যাকে অণু অণু করে বিশ্লেষণ করার জন্য নিরবিচ্ছিন্নভাবে চিন্তা করা প্রয়োজন আর চিন্তার জন্য প্রয়োজন শক্তি। এ সময় মস্তিষ্কের ভেন্ট্রোল্যাটারিয়াল প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্সের নিউরনগুলো নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে ফায়ার হয়, যাতে করে একজন ব্যক্তি নিরবচ্ছিন্ন ভাবে চিন্তা চালিয়ে যেতে পারে যেন তার চিন্তায় কেউ ডিস্টার্ব করতে না পারে।
কিন্তু এর জন্য ভেন্ট্রোল্যাটারিয়াল প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্সের প্রচুর পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হয়, ঠিক যেমনি একটি গাড়ির ইঞ্জিন পাহাড় বেয়ে ওপরে ওঠার সময় অনেক জ্বালানী শোষিত হয়। তাছাড়া, এভাবে নিরবিচ্ছিন্ন নিউরাল ফায়ারের কারণে নিউরন ভাঙতে শুরু করে। একটি গাড়ির ইঞ্জিন যেমন প্রচন্ড চাপে ব্রেক ডাউন করে।
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন 5HT1A রিসেপ্টর মস্তিষ্ককে নিরবিচ্ছিন্ন চিন্তার জন্য জ্বালানী বা ফুয়েল দিয়ে থাকে। কিন্তু একজন ব্যক্তি যখন ডিপ্রেসনে থাকে এই রিসেপ্টর একই সময় নিউরনের ভাঙন প্রতিরোধ করে। আর এখান থেকেই তার মধ্যে অলসতা, দূর্বলতা, একাকীত্বের মনোভাব তৈরি হয়।
সবসময় একাকীত্ব মানেই ডিপ্রেশন নয়
কেউ যখন একা থাকতে চায় তার কারণ সবসময় এই নয় যে সে মানসিকভাবে অসুস্থ্য, সে একা থাকতে চায় কারণ তার শক্তি প্রয়োজন , আপনার সাথে ক্যাচাল করলে তার নিউরন ফেটে যাবে, সে তার সমস্যা সমাধান করতে পারবে না, তার ব্রেন কলাপ্স করবে, সে ডিপ্রেসন থেকে বের হতে পারবে না এবং সুইসাইডও করতে পারে। ভালোবাসা ভালো তবে অতিরঞ্জিত ও অজ্ঞতাপ্রসূত ভালোবাসা ভালো না।
নিউটন একা থাকতেন, পল ডিরাক, টেসলা একা থাকতেন। কারণ, তারা কঠিন কঠিন সমস্যা ফেইস করেছিলেন যেজন্য তাদের ডিপ্রেসন কাজ করত। মানুষ সামাজিক প্রাণী সে একা সার্ভাইভ করতে পারে না কিন্তু নিউটন অথবা আইনস্টাইনের একাকীত্ব যদি আপনি নষ্ট করতেন তাদের মস্তিষ্কের 5HT1A রিসেপ্টর নিউরনের ভাঙন রোধ করার শক্তি পেত না, তারা কোনো ইকুয়েশনই সমাধান করতে পারত না, আজ আমরা সভ্যতা বলতে যা বুঝি তার কিছুই সম্ভবপর ছিল না বরং তারা সুইসাইড করত।
চিন্তাশীল মানুষদের সাথে অহেতুক কথা বলা সঠিক মনে করি না আমি, নিজের অপ্রয়োজনীয় আবেগ জড়িয়ে তাদের মস্তিষ্ককে বিরক্ত করাও ঠিক নয়। তাদেরকে তাদের মতো করে থাকতে দিন। জ্ঞানীর প্রতি শ্রদ্ধা হলো কোমলতা।আইনস্টাইনের জন্মই হয়েছে থিওরি অভ রিল্যাটিভিটির জন্য, আপনার অবান্তর কথাবার্তা শুনে নিজের ও বিশ্বের ক্ষতি করার জন্য নয়। আপনি যদি এই ধরণের কাউকে ভালোবাসেন তো সম্মাজনক দূরত্ব বজায় রাখেন। শুধু কথা বলে অথবা শারীরীক এনগেইজমেন্টের মাধ্যমেই যে কারও পাশে থাকা যায় তা নয়, কর্ম ও সহানুভূতির মাধ্যমেও আপনি তাদের পাশে থাকতে পারেন।
একজন বিজ্ঞানী ও চিন্তাশীল মানুষের লাইফ পার্টনার যিনিই হোন তাকে এই কয়েকটি বিষয় খুব ভালোভাবে মনে রাখা উচিত। তাদের সাথে কোমল ও সহনশীল আচরণ করা উচিত। একজন ব্যক্তি বুদ্ধিমান হলেই যে তাকে আপনার মনের আবেগ বুঝতে হবে এমন কোনো কথা নেই, সে গড ইকুয়েশনও বুঝতে পারে, সে আপনার আবেগ বুঝবে এমন কোনো যুক্তি নেই। পৃথিবীতে অনেক বিজ্ঞানী ছিলেন যারা অটিজম এসপার্গার ডিজিজে আক্রান্ত, তারা অসামাজিক ছিলেন, তারা সাধারণ আবেগ অনুভূতির সাথে সংযুক্ত থাকতে পারতেন না।
( ডিপ্রেসনের কিছু জটিলতর রূপ আছে যেগুলোর জন্য চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হওয়া উচিত, তবে আমার মতে ডিপ্রেসন ম্যালফাংশন নয়)
লেখক- অ্যান্ড্রোস লিহন, বিজ্ঞান লেখক
- খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আইনিউজে আরও পড়ুন-
- কোমরে বাশি, হাতে তালি — গানই মদিনা ভাই’র জীবন-মরণ
- ‘গাছ হেংলানেছে- পয়সা মিলেগা’ : চা শ্রমিক ও চা শিল্প
- পোশাক নয়, নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ জরুরি
বিশ্বের মজার মজার গল্প আর তথ্য সম্বলিত আইনিউজের ফিচার পড়তে এখানে ক্লিক করুন
দেখুন আইনিউজের ভিডিও গ্যালারি
দিনমজুর বাবার ছেলে মাহির বুয়েটে পড়ার সুযোগ || BUET success story of Mahfujur Rhaman || EYE NEWS
হানিফ সংকেত যেভাবে কিংবদন্তি উপস্থাপক হলেন | Biography | hanif sanket life documentary | EYE NEWS
আশ্চর্য এন্টার্কটিকা মহাদেশের অজানা তথ্য | Antarctica continent countries | facts। Eye News
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ