স্বপন নাথ
আপডেট: ১৬:৪২, ২৪ জানুয়ারি ২০২৩
আমি কী তাই জানলে সাধন সিদ্ধ হয় (প্রথম পর্ব)
লালন সাঁইজির গান থেকে বেছে নিলাম আলোচনার শিরোনামা। প্রথমে গানের কথা পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে। ভাব প্রকাশে লালনবাণীর আশ্রয়ে আসর বন্দিত করা হলো। ‘আমি কী তাই জানলে সাধন সিদ্ধ হয়/ আমি কথার অর্থ ভারি আমাতে আর আমি নাই’।
এ বিশ্বের যা কিছু আমরা অনুভব, উপলব্ধি করছি এসবের ভেতরে কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। প্রশ্নের মীমাংসা ও উত্তর নিদানে মানুষ নতুন পথ সৃজন ও অগ্রসর হতে থাকে। অগ্রসরমানতা, বহমান স্রোতের ফলেই সৃষ্টি হয়েছে আমাদের সুখ-দুঃখের উপকরণ।
‘আমি’ সর্বনামে চলে জগত সংসার। এ ‘আমি’ বড়ো গোলমেলে। আমরা কেন এমন শিরোনামা নির্ধারণ করতে গেলাম, এটা এক মৌলিক প্রশ্ন। বিবেচনা করেছি, যে ‘আমি’ নিয়ে সর্বত্র লড়াই, চলমানতা, এর পরিণতি আজ কোথায় ঠেকেছে। বিশেষত স্মার্ট দুনিয়াতে অন্য এক ‘আমি’-র ভেতর ‘আমি’ হারিয়ে গেছে। তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বলে রাখা ভালো, দুনিয়াতে অনেককিছুই চেনা- জানা সহজ, তবে নিজেকে জানা আপাত কঠিন বলেই মনে হয়েছে।
নিজেকে জানার সূত্রে জড়িয়ে আছে অজানা ও অপরকে জানার পথ। যেখানে একটা বিভাজন আমরা পেয়ে গেলাম। যে পথ ধরে আমি-র অস্তিত্ব জানা কিছুটা সহজ। সুতরাং, সহজিয়া পথেই শিরোনামা নির্ধারণ করা হলো। কারণ, আমি-কে জানতে পারলে সাধন সিদ্ধ হতে পারে।
এ ‘আমি’-র অ্যালগরিদম সন্ধান করেছেন অনেকেই। আমি-র মীমাংসায় কত যে সূত্র ও তত্ত্ব প্রণয়ন। অ্যালগরিদম সূত্র অনুযায়ী সঠিক প্রণালির উদ্ভাবন। অর্থাৎ, আমাদের লক্ষ্লৎ ‘আমি’ সমস্যার সমাধান ও সংকট থেকে উত্তরণের উপায় সন্ধান করা। কারণ, সাপেক্ষ বিষয় ও বস্তু ছাড়া একটি অস্তিত্বের পরিচিতি জানা যায়। এর সমর্থনে দু-একটি কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। [ক] ‘আশ্চর্য এই যে, আমি হইয়া উঠিতেছি, আমি প্রকাশ পাইতেছি। আমার মধ্যে কী অনন্ত মাধুর্য আছে, যেজন্য আমি অসীম ব্রহ্মাণ্ডের অগ্রণ্য। সূর্য-চন্দ্র-গ্রহ- তারকার সমস্ত শক্তি দ্বারা লালিত হইয়া, এই আলোকের মধ্যে আকাশের মধ্যে চোখ মেলিয়া দাঁড়াইয়াছি আমাকে কেহ ত্যাগ করিতেছে না। ... বাহির হইতে দেখো না এমন করে, আমায় দেখো না বাহিরে। আমায় পাবে না আমার দুঃখে ও সুখে, আমার বেদনা খুঁজো না আমার বুকে, আমারে দেখিতে পাবে না আমার মুখে, কবিরে খুঁজিছ যেথায় সেথা সে নাহিরে।... অহংটাই পৃথিবীর মধ্যে সকলের চেয়ে বড়ো চোর। সে স্বয়ং ভগবানের সামগ্রীও নিজের বলিয়া দাবি করিতে কুণ্ঠিত হয় না। এই জন্যই তো ঐ দুর্বৃত্তটাকে দাবাইয়া রাখিবার জন্য এত অনুশাসন।
এইজন্যই তো মনু বলিয়াছেন সম্মানকে বিষের মতো জানিবে, অপমানই অমৃত।’ [ঠাকুর ১৪২৬ : ১৪২-১৪৯] [খ] আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময় আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়। আমি মানব দানব দেবতার ভয়, বিশ্বের আমি চির দুর্জয়,... [ইসলাম ১৯৯৬ : ১০]
[গ] ‘আমায় ক্ষমা করবেন আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।’ [ইসলাম ১৯৯৬: ১২৭]
এ আমি নিয়ে রয়েছে জ্যাক লাকাঁর ভিন্ন বয়ান। যে সেলফ অথবা অহং-এর কথা আমরা বলি, তা অবশেষে আমার আমি নয়। অপর ইচ্ছা দ্বারা গঠিত আমি। আমাদের অবচেতনে জমা হতে থাকে অপরেরই ভাষা। এ ভাষাই আমিকে তৈরি করে। আবার কখনো তা হয় ইমেজের সমষ্টি। এভাবে বলা যেতে পারে, নদীতে নৌকা ভ্রমণ শেষে ফিরে এসে সবকিছু আর মনে থাকে না। কিন্তু আরেকবার অন্য কোনো স্থানে নৌকা ভ্রমণে গেলে আগের ভ্রমণে দেখা কোনো ফুল, মাছ ধরার দৃশ্য, কিংবা পাখির উড়ে যাওয়া দৃশ্য মনে আসে। যা বর্তমানের কোনো ঘটনা অতীতের দৃশ্য স্মরণ করিয়ে দেয়। এর মানে হলো, মনের স্তরে এরকম ছবিগুলো স্থান করে নিয়েছিল, যা সাধারণত সেই সময় নিরর্থক মনে হয়েছে।
বস্তুত, অপরের ইচ্ছাকেই নিজের ইচ্ছা বলে গ্রহণ করা হয়। এতে অনিবার্য পরিণতি হলো, মানুষ চায় অপরের সম্মতি। অতএব এ আমি-র পরিচয় সাপেক্ষমূলক। অর্থাৎ, আমি-র পরিচয় দিতে গেলে সংশ্লিষ্ট অনেক ইমেজের উদাহরণ তুলে ধরা হয়। যে ভাষায় আমরা আমিকে প্রকাশ করি, তা অপরেরই ভাষা। ভাষার পৌনঃপুনিক প্রয়োগ মাত্র। আমি সর্বত্রই একটা ইমেজের খেলা বলেছেন লাকাঁ।
তাঁর কথা নিয়ে রমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় [২০১৭] বলেছেন, ‘ধরুন আমি কে? আমি তো শূন্যগর্ভ ব্যাপার যতক্ষণ না আমি নিজেকে অমুক জায়গায় মাস্টার, অমুক জায়গায় থাকি, অমুকের ছেলে ইত্যাদিভাবে আমার কাছেই না আমার পরিচয় দিই। শিশু প্রথমে নিজের ইমেজ দেখে এবং এরপর তার অহংকার বা ইগো তৈরি হল। এই ইগো, ভাষার নেটওয়ার্কে একজন হয়ে পড়ল এবং ভাষার যে অর্থগুলো সে সচেতনভাবে গ্রহণ করল না, সেগুলো তার অচেতন মনকে তৈরি করতে থাকল। তার কারণ মানুষের মন সবকিছু নিঃশেষে গ্রহণ করে।’
এ বিশ্বের যা কিছু আমরা অনুভব, উপলব্ধি করছি এসবের ভেতরে কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। প্রশ্নের মীমাংসা ও উত্তর নিদানে মানুষ নতুন পথ সৃজন ও অগ্রসর হতে থাকে। অগ্রসরমানতা, বহমান স্রোতের ফলেই সৃষ্টি হয়েছে আমাদের সুখ-দুঃখের উপকরণ।
অর্থাৎ, বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না যে, মানুষ আপন সুখ আহ্লাদের জালে ধরা পড়ে আছে। নিজ হাতে আলাদা নিয়তি নির্মাণ করে ফেলেছে। ভাবতে হয় কোথায় ছিল বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন। সেখান থেকে দিনে দিনে আপন হাতে বানানো পিঞ্জিরার মধ্যে প্রবেশ করছে আর বের হতে পারছে না। তাকে সামনের দিকে যেতেই হচ্ছে। নির্মাণ ও সমস্যা-সমাধান প্রচেষ্টার এ এক অপার খেলা। সীমাবদ্ধ দেয়ালে জীবন আটকা পড়ে থাকে। কিছুদিন খেলাঘরে রান্নাবাটি খেলায় মেতে থাকে কখনো সুখে, কখনো দুঃখে।
এই যে সুখ দুঃখের কথা, কিসসা কাহিনি, তাও রিলেরেসের মতো পেয়ে আপাত শান্তি, স্বস্তি খুঁজে অন্ধকারে। একটা অবিচ্ছিন্ন ক্রম-ঘোরের মধ্যে জীবন কাটায় মানুষ। যে ঘোর থেকে জন্ম লয় হিংসা, যুদ্ধ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ইত্যাদি। এর মধ্যেও জীবনার্থের সন্ধান করে মানবসমাজ। তা কি আর সন্ধান মিলে। এ সমাজ কেমন ক্ষয়রোগে আক্রান্ত নয় কি? এ ক্ষয়িষ্ণুতা আছে বলেই হিংসারোগ প্রসারিত হতে থাকে। একই সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে ছল-চাতুরি-কৌশল। মানুষের ভেতরে বিশেষভাবে আমি-র মধ্যে দ্বৈরথ আছে।
সোজাকথায় এ দুটি: অ্যানিমালিজম ও মনুষ্যত্বের দিক। এ দ্বন্দ্বের প্রবহমানতাই মানুষের বৈশিষ্ট্য। মানবসমাজের দ্বৈত বা বহুস্বরিত দ্বিধা থেকে মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা আপাত আমরা দেখছি না। আপাত শান্তি খোঁজার উদ্যোগ বা অন্বেষায় বা কিছু প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে আমরা অনুসন্ধান করছি। বস্তুত আমাদের অন্তর্জগতে অনেক পাথর, নুড়ি, নদী, খাল, বিল, জলাশয়ের সমাহার। ওই সাম্রাজ্য তৈরি হয়েছে কালে কালান্তরে। অন্তরের বিহারে একে একে আসন গ্রহণ করেছ ঝালমুড়ির মতো মুখরোচক ভাষা, ভাবাদর্শ। এই যে নানা রঙের প্রলেপ তৈরি হলো, তা কীভাবে পরিস্কার করবেন।
প্রশ্ন উত্থাপন সেখানেই, যে সমাজবোধে আমরা নিপতিত, এ সমাজ তা হলে কী। এমন সমাজের কাঠামো, পরিধি, বৈশিষ্ট্য কী ধরনের। যে সমাজ শুধু পলেস্তারা তৈরি করে, আবদ্ধ করে, মুক্তির দিশা দেয় না। কোনো পথের সন্ধান দিতে পারছে না। নিয়তি হলো, এমন সমাজে আমরা বাস করছি। এর মধ্যে প্রত্যক্ষত চরকির মতো ঘুরছি। এ পর্যন্ত মানবসমাজের মুক্তি সন্ধানে কথামালা, শব্দরাজি ঝুমঝুমির মতো আমাদের সদাই লোভ দেখাচ্ছে। আসলে সেসব ঝুমঝুমিতে রঙ আছে; কিন্ত রঙের ব্যঞ্জনা অনুপস্থিত।
ফলত, আমরা একযোগে ভাঙার নয়, প্রথারক্ষার লড়াই করছি। সামষ্টিক নির্জ্ঞানে বহন করে চলেছি বহমান, আরোপিত কিছু কথা, গল্প, কাহিনি। এ পর্যায়ে একটি সাধারণ উদাহরণ অন্য জায়গা থেকে নেওয়া যায়। ‘সেখানে ঝর্ণা রয়েছে, মানুষকে জলের জোগান দেওয়ার জন্য। সব ঝর্ণাই যে বরফের জল পায় এমন নয়। মাটির নিচের জল বাইরে বেরিয়ে এসে পাহাড়ের গা বেয়ে নামে। যে জল বাইরে আসে, তার সম্পূরণ না হলে কিছু দিন পরে ঝর্ণার আর জল জোগাবার সুযোগ থাকবে না। একই ভাবে যেখানে কুয়ো বা নলকূপ দিয়ে মাটির নিচ থেকে জল তোলা হয়, সেখানেও সম্পূরণের প্রয়োজন। সে কারণে মাটির জল ধরে রাখার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেলে সম্পূরণের সমস্যা তো হয়।’ [মুখোপাধ্যায় ২০১৯ : ২৯] তা হলে বস্তুবিশ্বের এ জালের প্রতিটি সুতা, কণার পরস্পর সম্পর্কের মাঝেই আমি-র অস্তিত্ব নিহিত।
লেখক : স্বপন নাথ, শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, কবি ও গবেষক
ধারাবাহিক পর্বের প্রথম পর্ব। চলবে...
[লিটল ম্যাগাজিন ফসল-এ স্বপন নাথের বক্তৃতা ‘আমি কী তা জানলে পরে সাধন সিদ্ধ হয়’ থেকে নেয়া।]
- খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
বিশ্বের মজার মজার গল্প আর তথ্য সম্বলিত আইনিউজের ফিচার পড়তে এখানে ক্লিক করুন
দেখুন আইনিউজের ভিডিও গ্যালারি
দিনমজুর বাবার ছেলে মাহির বুয়েটে পড়ার সুযোগ || BUET success story of Mahfujur Rhaman || EYE NEWS
হানিফ সংকেত যেভাবে কিংবদন্তি উপস্থাপক হলেন | Biography | hanif sanket life documentary | EYE NEWS
আশ্চর্য এন্টার্কটিকা মহাদেশের অজানা তথ্য | Antarctica continent countries | facts। Eye News
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ