সোহেল সানি
স্বাধীনতা ঘোষণার অপরাধেই বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দেয়া হয়!
গ্রন্থে নিয়াজি লিখেন, '৭১ সালের ১৪ মার্চ ভুট্টো দুজন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের প্রস্তাব করে বলেছিলেন, তিনি নিজে হবেন পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী আর মুজিব হবেন পূর্বপাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তিনি (ভুট্টো) 'ওধার তুম ইধার হাম' বলতে দুটি পাকিস্তানকে বুঝিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছিল না। কারণ আওয়ামী লীগ এমন এক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল যেখান থেকে তার ফেরার পথ ছিল না। ২৩ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে পালন করা হয় প্রতিরোধ দিবস। মুজিবের বাসভবনে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হয়। মুজিব কর্নেল ওসমানীকে সার্বিক অপারেশনের কমান্ডার নিযুক্ত করেন।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অপরাধেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অভিযুক্ত হন এবং সামরিক আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে বিচারকার্য পরিচালিত হয়। রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় এবং রাওয়ালপিন্ডিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য কবরও খোঁড়া হয়। বিশ্বজনমত উপেক্ষা করে বর্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দিনক্ষণ ঠিক করলেও জুলফিকার আলী ভুট্টোর কারণে তা সম্ভব হয়নি।
নিয়াজীর অধীনে আত্মসমর্পণরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নব্বই হাজার সদস্যদের জীবন বাঁচানো এবং ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের কঠোর হুশিয়ারীর কারণে জুলফিকার আলী ভুট্টাো প্রেসিডেন্টের গদিতে বসেই বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিদানের ঘোষণা করেন এবং তা কার্যকর করেন।
পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট সামরিকজান্তা জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং যুদ্ধকালীন পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল নিয়াজি যেমন যুদ্ধের প্রতিপক্ষ রূপে শেখ মুজিবুর রহমানকে উল্লেখ করেন ঠিক তেমনিভাবে জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক জুরি কমিশন, পাকিস্তানের মিত্রশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সনের বক্তৃতা বিবৃতিতেও শেখ মুজিব যুদ্ধের প্রতিপক্ষরূপে চিহ্নিত হয়েছেন।
শেখ মুজিবের সেই বিচার সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব সাধারণতন্ত্র এবং বাংলাদেশের মিত্রশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারতসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের বার্তা-বিবৃতিগুলোই ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত। শেখ মুজিব বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক এবং স্বাধীনতার ঘোষক। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রমনার রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশ- ভারত যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল নিয়াজী একটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে লিখেছেন। তার ওই গ্রন্থটি স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতিরোধে বিশিষ্ট ভুমিকাপালন করতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত রয়েছে গ্রন্থটিতে।
একাত্তরের যুদ্ধকালীন শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার অভিযোগপত্র ও পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ভাষণগুলোও সাক্ষ্য দেয় যে, বঙ্গবন্ধুই যুদ্ধের প্রতিপক্ষ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক। বিদেশী গণমাধ্যমের খবরাখবরই ইতিহাস বিকৃতিরোধের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
উল্লেখ্য, দুঃখজনক হলেও সত্য যে স্বাধীনতার ঘোষক বিতর্ক বাংলাদেশের উচ্চ আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। হাইকোর্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে রায় দেন কিন্তু তারপরও বিএনপিসহ একটি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মেজর জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে অভিহিত করে আসছে। মুক্তিযুদ্ধের সরকারি দলিলপত্রে ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণাটি প্রচার করেন। যদিও বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে প্রস্তাবনা এবং বাংলাদেশের ভিত্তি যে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তাতেও ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চকে স্বাধীনতা ঘোষণার দিন বলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর রাষ্ট্রপরিচালনার মূল ভিত্তি ও উৎস যে প্রস্তাবনা ও চার মূলনীতিকে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছিল, সেটাও মহামান্য সুপ্রিমকোর্টের রায়ের ভিত্তিতে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। আদালত কর্তৃক বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষক এবং সংবিধানে "জাতির পিতা প্রতিকৃতি আইন" বিষয়ক অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত থাকা সত্ত্বেও মেজর জিয়াকে প্রতিপক্ষ মহল স্বাধীনতার ঘোষক বলে আইন ও সংবিধান লঙ্ঘন করছে। আইন ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে এটা সংবিধান পরিপন্থী।
জাতীয় সংসদ এটাকে রাষ্ট্রদ্রোহী মূলক অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করে অপরাধীর বিরুদ্ধে দণ্ডাদেশদানের আইন বা বিধান করতে পারে। জনস্বার্থে উচ্চ আদালতও স্ব প্রনোদিত হয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিতে পারেন। যেহেতু হাইকোর্টের রায়ে ইতিপূর্বেই বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে রায় প্রদান করেছেন। তানাহলে এ বিতর্কের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং স্বাধীনতার মূল্যবোধ ভূলুণ্ঠিত হতেই থাকবে।
যাহোক ফির আসছি বঙ্গবন্ধুর বিচার ও যুদ্ধ ঘোষণার প্রসঙ্গে। "পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার জন্য শেখ মুজিবের বিচার হবে"। উপর্যুক্ত কথা বলা হয়, ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট পাকিস্তান সরকারের প্রেসনোটে। এতে বলা হয় যে - (THE DAWN, Karchi - August 10, 1971) TRIAL FOR "WAGING WAR AGAINST PAKISTAN" official Press Note, August 9,1971 Sheikh Mujibur Rahman, President of the defunct Awami League, will be tried by a Special Military Court for "Waging war Against Pakistan" and other offences, a Press Note issued by the Headquarters of the Chief Martial Law Administrator said to day (August 9). The trial will commence on August 11 in camera and its proceedings will be secret, the Press Note said. The accused will be given proper opportunity to prepare his defence and will be provided with all facilities permitted in law including engaging a counsel of his own choice provided such a counsel is a citizen of Pakistan, it added. Sheikh Mujibur Rahman was arrested from his Dhanmondi residence in the early hours of the morning of March 26 after the Pakistan Army moved in to restore the authority of the Government. Later, he was brought to West Pakistan where he is under detention.
শেখ মুজিবকে দেশদ্রোহিতার অপরাধে শাস্তি পেতে হবে - জেনারেল ইয়াহিয়া খান
MUJIB WILL BE PUT ON TRIAL President Yahya Khan's Television Interview by Pakistan Television Corporation August 3,1971 President Agha Mohammad Yahya Khan has said that Sheikh Mujibur Rahman, leader of the defunct Awami League, would be put on trial. He said Sheikh Mujib was arrested for committing acts treason and he would be dealt with under the law of the land. In a television interview telecast from all stations of Pakistan Television Corporation last night, the President said that being a citizen of Pakistan he should be dealt with according to the law of Pakistan. The president, who was asked what would be the fate of Sheikh Mujibur Rahman, said that the leader of the defunct Awami League had deviated from his electoral campaign in which he demanded autonomy for East Pakistan. President Yahya said that after Sheikh Mujib got the mandate, he and a coterie of his people deviated from that aim and wanted seccession. In other words, he said Sheikh Mujibur Rahman had committed "acts of treason, acts of open rebellion" and incited armed rebellion against the State. In reply to a question, the president said that Sheikh Mujibur Rahman was not his opponent at all. The President said that he was only a caretaker and had nothing to oppose Sheikh Mujibur Rahman as a politician. The President made it clear that he had no political ambitions. He said as a soldier he was in his temporary duty of restoring the authority of the people. The President said he was sorry for what Sheikh Mujibur Rahman had done for which he would suffer like any other person committing crimes on the nation would suffer. "How would you treat your criminal", he posed question to the foreign news media representatives present at the interview.
"শেখ মুজিবের বিচারে জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্টের মন্তব্যে পাকিস্তানের প্রতিবাদ"
"TEXT OF PAKISTAN'S PROTEST NOTE AGAINST U.N. SECRETARY GENERAL'S STATEMENT AT SHEIKH MUJIB'S TRIAL" The Government of Pakistan appreciates the widespread humanitarian concern evoked by the tragic developments in East Pakistan since March. It warmly responds to any expression of such concern which is not motivated by power politics and which appreciates Pakistan's difficulties. It is publicly known that Government of Pakistan has promptly accepted several suggestions made by the Secretary-General to help the return of people who have been uprooted from their homes in East Pakistan.This understanding cannot, however, be extended to any attempt to interfere in Pakistan's internal affairs or to dictate to Pakistan the kind of political accommodation it should reach in its Eastern region.
The Pakistan delegation regrets that in the statement made on August 10 by a U.N. spokesman on his behalf, the Secretary General should have chosen to make a comment on the impending trial of Sheikh Mujibur Rahman which exceeds both the bounds of humanitarian concern and the competence of the U.N. as defined in the U.N. Charter. Our regret is sharpened by the awareness that in numerous cases of trial, even imprisonment without trial and sentences after summary trials of political leaders in various countries, no expression of feelingly about their repercussions was ever made on behalf of the U.N. The Government of Pakistan cannot accept the proposition that any judicial decision on the individual case of Sheikh Mujibur Rahman will have any repercussions outside the borders of Pakistan. No such repercussions are inevitable unless Pakistan's hostile neighbour, India, is encouraged to make them so. (THE DAWN, Karachi - August 16,1971)
জাতিসংঘে পাক-রাষ্ট্রদূত আগা শাহীর বিবৃতি - "শেখ মুজিবের বিচার শুরু হয়েছে ১১ আগস্ট, দু'সপ্তাহের বিচার সমাপ্ত হবে "Pakistan Ambassador Agha Shahi Yesterday (August 31) informed Secretary -General U-Thant about new steps contmplated by the Pakistan Government to build confidence in the country. He told correspondents in New York afterwards "as you know, the president of Pakistan has taken many steps to build confidence and further steps are contmplated in this direction," He said they would take place "within the next two or three weeks" Questioned about the trial of Sheikh Mujibur Rahman, leader of the Awami League in East Pakistan, Mr. Shahi said his trial started August 11 and should be over in another two weeks. He said Sheikh Mujib had been charged with waging war against the State and incitement to rebellion and violence. The Ambassador declined to say where the trial was taking place, but said Sheikh Mujib was being represented by a lawyer of his own choice, Mr. A. K. Brohi, who, he said, was one of the best constitutional lawyers in Pakistan. (DAILY NEWS, Karachi - September 1, 1971)
"শেখ মুজিবের বিচারের প্রতিবাদে আন্তর্জাতিক জ্যুরিস্ট কমিশন"
জেনেভা থেকে আন্তর্জাতিক জ্যুরিস্ট কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের প্রতিবাদ জানিয়ে জরুরি বার্তা পাঠায় ১০ আগস্ট, ১৯৭১। কমিশনের সেক্রেটারি জেনারেল নিয়াল ম্যাকডেরমট স্বাক্ষরিত বার্তায় বলা হয়েছে যে বিচারের ক্ষেত্রে গোপন করার তো কিছু নেই'ই, আন্তর্জাতিক জ্যুরিস্ট কমিশন সামরিক আদালতে গোপনে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের প্রতিবাদ করছে।
"মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ" মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগ প্রকাশ করছে যে, শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের নামে অমানবিকভাবে পাকিস্তানের ইয়াহিয়া সরকার অপচেষ্টায় মেতে উঠেছে। নিক্সন প্রশাসনের প্রেস কর্মকর্তা জন কিং বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে সংক্ষিপ্ত বিচারের মাধ্যমে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে তা "শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক আদান-প্রদানের" সম্ভাবনার উপর খারাপ প্রতিক্রিয়া পড়ার আশঙ্কায় মার্কিনীরা উদ্বিগ্ন। মানবিক কারণেই এই উদ্বেগ।
আরব সাধারণতন্ত্রের তীব্র প্রতিবাদ
সরকারি সংবাদপত্র আল-আহরাম এর এক রিপোর্টে বলা হয়ছে, সংযুক্ত আরব সাধারণতন্ত্র পাকিস্তানের সরকার কর্তৃক শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। ওই সংবাদপত্রটির সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে যে, সামরিক বা গোপন আদালতে বিচারের যে জাতীয় ঐক্য বজায় রাখা সম্ভব নয়, অস্ত্রবলের সাহায্যে কখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমতকে দমিয়ে রাখা যায় না।
ভারতের হুশিয়ারি
ভারত সরকার গত ৯ আগস্ট সোমবার নয়াদিল্লীতে এই বলে পাকিস্তানকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কোর্টমার্শাল হলে পাকিস্তানকে তার সমুচিত ফল ভোগ করতে হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং লোকসভায় এ কথা ঘোষণা করেন এবং তার সঙ্গে সঙ্গে পাক - জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের সময় শেখ মুজিবুর রহমান জীবিত নাও থাকতে পারেন বলে ইয়াহিয়া খান যে বিবৃতি দিয়েছেন তার বিরুদ্ধেও ভারতের তীব্র ক্ষোভের কথা ব্যক্ত করেন।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক বিবৃতিতে বলেন, ইসলামাবাদের জঙ্গীচক্র কর্তৃক বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের বিচারের নামে যে বিচারের প্রহসন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সভ্যতার ইতিহাসে তা বৃহত্তম ট্রাজেডি ছাড়া আর কিছু নয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বিবৃতিতে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উথান্টের কাছে শেখ মুজিবুর রহমানের বিনাশর্তে মুক্তির জন্য হস্তক্ষেপ করার দাবি জানান।
জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্বেগ
জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উথান্ট এই মর্মে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, শেখ মুজিবুর রহমানের ভবিষ্যতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত যে কোন পরিণতি পাকিস্তানের সীমানা ছাড়িয়ে সর্বত্র প্রভাব বিস্তার করবে। যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার অভিযোগে দেশদ্রোহী মামলায় বিচার চলছিল, তখন দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছিল মুক্তিবাহিনীর বিজয় অভিযান।
অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিভিন্ন সংবাদপত্রে, বেতার থেকে জাতির পিতা, স্বাধীনতার মহানায়ক, স্বাধীনতার তুর্যবাদক, বাংলার নব-অগ্নিযুগের স্রষ্টা, শোষিত মানুষের মুক্তির মূর্তপ্রতীক, মুক্তি-মন্ত্রের দীক্ষাগুরু, জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের অগ্নিপুরুষসহ অসংখ্য উপাধীমূলক সম্মোধন করা হচ্ছিল।
নিয়াজীর গ্রন্থেও স্বাধীনতার ঘোষক
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর 'বাংলাদেশ' নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে যে ব্যক্তিটির আত্মসমর্পণের মাধ্যমে, সেই পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ডের জেনারেল এএকে নিয়াজির যুদ্ধ নিয়ে রচিত "দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান" নামক গ্রন্থে পাকিস্তানের প্রতিপক্ষ হিসাবে শেখ মুজিবুর রহমানের নামই উঠে এসেছে। স্বাধীনতার ঘোষণাদানকারীও বলা হয়েছে শেখ মুজিবকে। গ্রন্থটিতে মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বদাতা হিসাবে এসেছে জেনারেল ওসমানীর নাম।
গ্রন্থটিতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ২৭ মার্চে মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণার কোন অস্তিত্ব নেই। '৭১ এর যুদ্ধের প্রকৃতি, পাকিস্তানের ভাঙ্গন, যুদ্ধ পরিকল্পনা, আক্রমণ, পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী, আলবদর, আলসামস্ সহ রাজাকার বাহিনী, যুদ্ধ শিবির, গোপনীয় রিপোর্ট, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, পাকিস্তান সেনাপ্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ খানের ভুমিকা এবং বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথকমান্ড, তথা মিত্রবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণের প্রেক্ষিত ও বাধ্যবাধকতার নিখুঁত বর্ননা করা হয়েছে গ্রন্থটিতে।
পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য লে. জেনারেল নিয়াজি শুধু জেনারেল ইয়াহিয়া, জেনারেল টিক্কা খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোকে দায়ীই করেননি, তাদের তিনজনকে পাকিস্তানের বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অভিহিত করেছেন। নিয়াজি বিশ্বাস করতেন, পূর্ব পাকিস্তান সংকট একটি রাজনৈতিক সংকট। যার সমাধান কোনো সামরিক যুদ্ধের মাধ্যমে হতে পারে না। তিনি দাবি করেছেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে জরুরি বার্তায় বলেছিলেন সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক। কিন্তু ইয়াহিয়া তার আবেদনে সাড়া দেননি। বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ নিপীড়নের কথাও স্বীকার করেছেন।
যদিও নিয়াজি সেই শাসকগোষ্ঠীর নিদের্শেই দায়িত্বপালন করেছেন কেন সেবিষয়ে নিজস্ব মত তুলে ধরেছেন। নিয়াজি লিখেছেন উপরের নির্দেশেই তাকে যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে। যা চরম অপমানের, তার চেয়ে মৃত্যুবরণ করা ভালো হতো। মজার ব্যাপার হচ্ছে নিয়াজি কিন্তু আত্মমর্যাদার জন্য মৃত্যুবরণ করেননি, আত্মসমর্পণ দলিলে সাক্ষর করে মিত্রবাহিনীর হাতে বন্দীত্ববরণ করেন। গ্রন্থটিতে নিয়াজি বলেছেন, জুলফিকার আলী ভুট্টো সিজারের চেয়ে পরাক্রমশালী ছিলেন। ক্ষমতাবলে হয়েছিলেন চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর, এ পদবী তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায়ও ব্যবহার করেন। যে কারণে আমার গ্রন্থটির প্রকাশ বিলম্বে হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে ভারতীয় হামলা সম্পর্কে অবগত করলে, তিনি বলেন 'পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আমি কি করতে পারি? আমি পারি কেবল প্রার্থনা করতে।' এই বাক্যটি দ্বারা ইয়াহিয়া রাষ্ট্রপ্রধান ও সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে তার সকল দায়িত্ব ও কর্তব্য শেষ করেন। পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষা করতেই আমাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়া হয়।
গ্রন্থে নিয়াজি লিখেন, '৭১ সালের ১৪ মার্চ ভুট্টো দুজন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের প্রস্তাব করে বলেছিলেন, তিনি নিজে হবেন পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী আর মুজিব হবেন পূর্বপাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তিনি (ভুট্টো) 'ওধার তুম ইধার হাম' বলতে দুটি পাকিস্তানকে বুঝিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছিল না। কারণ আওয়ামী লীগ এমন এক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল যেখান থেকে তার ফেরার পথ ছিল না। ২৩ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে পালন করা হয় প্রতিরোধ দিবস। মুজিবের বাসভবনে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হয়। মুজিব কর্নেল ওসমানীকে সার্বিক অপারেশনের কমান্ডার নিযুক্ত করেন। মেজর জেনারেল (অবঃ) মাজেদের তত্ত্বাবধানে সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের তালিকাভুক্ত করা হয়। ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র ও গোলাবারুদ আসতে থাকে। ভারতের সক্রিয় সহযোগিতায় সশস্ত্র সংগ্রামের পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়।
নিয়াজি লিখেছেন, মনে রাখা প্রয়োজন যে, তখনো বাঙালি সেনারা বিদ্রোহ করেনি। ২৫ ও ২৬ মার্চ মধ্যরাতে জেনারেল টিক্কা আঘাত হানেন। একটি শান্তিপূর্ণ রাত পরিণত হয় দুঃস্বপ্নে, চারদিকে আর্তনাদ, অগ্নিসংযোগ। জেনারেল টিক্কা তার সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন যেন তিনি তার নিজের বিপথগামী লোকের সঙ্গে নয় শত্রুর সঙ্গে লড়াই করছেন। ২৫ মার্চের সেই সামরিক অভিযানের হিংস্রতা ও নৃশংসতা বুখারায় চেঙ্গিস খান, বাগদাদে হালাকু খান এবং জালিয়ানওয়ালাবাগে বিট্রিশ জেনারেল ডায়ারের নিষ্ঠুরতাকেও ছাড়িয়ে যায়। সশস্ত্র বাঙালি ইউনিট ও ব্যক্তিবর্গকে নিরস্ত্র এবং বাঙালি নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করার জন্য টিক্কা খানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি এ দায়িত্ব পালন করার পরিবর্তে বেসামরিক লোকজনকে হত্যা এবং পোড়া মাটি নীতি গ্রহণ করেন।
ত্রাণ সহায়তা হ্রাস সার্বিক রোহিঙ্গা পরিস্থিতি জটিল করে তুলবে
তিনি তার সেনাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, 'আমি মাটি চাই মানুষ নয়।' মেজর জেনারেল ফরমান ও বিগ্রেডিয়ার জাহানজেব আরবাব ঢাকায় তার এ নির্দেশ পালন করেন। জেনারেল রাও ফরমান তার টেবিল ডায়েরিতে লিখেন, 'পূর্ব পাকিস্তানের শ্যামল মাটি লাল করে দেয়া হবে।
'বাঙালির রক্ত দিয়ে মাটি লাল করে দেয়া হয়েছিল।'৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাঙালিরা গভর্নর হাউজ (বঙ্গভবন) অবরোধ করার পর তারা ফরমানের ডায়েরি খুঁজে পায়। বাংলাদেশ সফরকালে মুজিব ভুট্টোকে এ ডায়েরি দেখিয়েছিলেন। নিয়াজি লিখেন, আমার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে ভুট্টো এ ডায়েরি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন। তাকে আমি আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানতাম না।
জেনারেল টিক্কা তার ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালন থেকে সরে যাওয়ায় সকল বাঙালি সশস্ত্র ব্যক্তি ও ইউনিট তাদের অস্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, সাজসরঞ্জাম ও পরিবহন নিয়ে পালিয়ে যায়। এবং মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করে।..মুজিব ছাড়া সকল নেতৃবৃন্দ পালিয়ে যায় এবং কলকাতায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠন করে।
২৫ ও ২৬ মার্চ সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার আগে ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেন। ঢাকা ত্যাগের আগে তিনি টিক্কাকে বলেছিলেন, 'তাদেরকে খুঁজে বের করো।' টিক্কার নিষ্ঠুরতা দেখার জন্য ভুট্টো ঢাকায় থেকে গেলেন। ভুট্টো দেখতে পেলেন ঢাকা জ্বলছে।
লেখক: সোহেল সানি, সিনিয়র সাংবাদিক ও ইতিহাস বিশেষজ্ঞ
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ