শ্যামলাল গোসাঁই
কোন পথে হাঁটছে দুই দলের রাজনীতি?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন তুমুল আলোচিত শব্দটি বোধহয় ‘সংলাপ’। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহুবার, বহুভাবে এর আগেও সংলাপ হয়েছে। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট একেবারে ভিন্ন। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সামনে এবছর নির্বাচনে যেমন বেশকিছু চ্যালেঞ্জ আছে তেমনি প্রায় জনবিচ্ছিন্ন দেশের অন্যতম বিরোধী দল হিসেবে খ্যাত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি); তাঁদের জন্যও এই জাতীয় সংসদ নির্বাচন কঠিন পরীক্ষার মাঠ। তবে আসন্ন জাতীয় সংসদের কাঠামো যে ২০১৪ এবং ২০১৫ এর নির্বাচন থেকে কিছুটা ভিন্ন হবে তা দু'দলই আঁচ করতে পেরেছে এবং সে অনুযায়ী তারা কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে।
প্রধান এই দুই দলের রাজনীতি নিয়ে বর্তমানে ঘুরেফিরে একটি প্রশ্নই আসছে নির্বাচন কালীন সরকার বা নির্বাচনে জনগণের প্রত্যাশানুযায়ী একটি নির্বাচিত অনুষ্ঠিত করতে দুই দল সংলাপে বসবে তো? কিছুদিন আগেও সংলাপ নিয়ে তেমন আলোচনা না হলেও বর্তমানে সংলাপ-ই আলোচনার মুখ্য বিষয়। এর অন্যতম কারণ বোধহয় দুই দলের একমুখী দাবী।
অতিসম্প্রতি রাজধানীতে স্বল্প দূরত্বে সমাবেশ করেছে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি। অতীতের ন্যায় কোনো ধরনের সাংঘর্ষিক কর্মকাণ্ড ছাড়াই সমাবেশ দুটি সম্পন্ন হয়েছে। এতে সুশীল সমাজসহ অনেকেই অবাক হয়েছেন। হওয়ারই কথা। কারণ এই দুই দলের রাজনৈতিক ইতিহাসে এর বিপরীতের দৃশ্য অহরহ ঘটেছে এবার ঘটেনি। দুই দলই সমাবেশ থেকে এক দফা ঘোষণা করেছে। বিএনপির এক দফা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এই বলে এক দফা ঘোষণা করেছে- প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দুই দলের এই এক দফা ঘোষণার পর থেকে প্রশ্ন ওঠছে দুই দল সংলাপে বসবে তো? না বসলে কোন পথে হাঁটছে দুই দলের রাজনীতি?
যদিও তারা (মার্কিন প্রতিনিধি দল) সংলাপ নিয়ে কোনো কিছু বলেনি; তবে প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া জানিয়ে গেছেন তাঁরা রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপকে সমর্থন করেন। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে সংলাপ নিয়ে কিছু না বললেও সংলাপকে যে তাঁরা সমর্থন করে সেটা জানিয়ে গেছে।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন সংলাপ ছাড়া দুই দলের সামনে সুষ্ঠু সমাধানের আর কোনো রাস্তা খোলা নেই। শুধু রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরাই নন, দেশের আরেক আলোচিত ও একসময় বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করা জাতীয় পার্টির বক্তব্যও একই। তারাও বলছেন- দেশের জনগণের স্বার্থে সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক অস্থিরতা কীভাবে কাটবে তাঁর উত্তর খোঁজা উচিৎ। তা নাহলে দেশের জনগণকে ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হবে আবারও।
দেশের রাজনীতিক বিশেষজ্ঞ বা জাতীয় পার্টি এসব বললেও সংলাপ নিয়ে এখনো সন্তুষজনক কোনো কিছু বলছে না আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি। দুই দলই তাঁদের এক দফায় অটল। ফলে রাজনীতির এই অস্থির অবস্থার আসলে পরিণতি কী হতে যাচ্ছে তা নিয়ে ধোঁয়াশাই রয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিদেশীদের তৎপরতাও চোখে পড়ার মতো। সম্প্রতি একটি মার্কিন প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করে গেছেন। সফরে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলসহ সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে একাধিকবার বৈঠক করেছেন। মূলত আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন পরিবেশ পর্যবেক্ষণের জন্য আসা এই প্রতিনিধি দলেরও আলোচনার মূল বিষয় ছিলো নির্বাচন। যদিও তারা সংলাপ নিয়ে কোনো কিছু বলেনি; তবে প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া জানিয়ে গেছেন তাঁরা রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপকে সমর্থন করেন। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে সংলাপ নিয়ে কিছু না বললেও সংলাপকে যে তাঁরা সমর্থন করে সেটা জানিয়ে গেছে। ফলে দল দুইটির সংলাপের বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছে।
সংলাপ নিয়ে দুই দলের দুই প্রধান নেতা ওবায়দুল কাদের এবং মির্জা ফখরুল পরস্পর পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিচ্ছেন। কাদের বলছেন বিএনপির সঙ্গে সংলাপের প্রশ্নই ওঠে না। আর যুক্তরাষ্ট্রও সংলাপ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখায় নি। এদিকে বিএনপির মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রায় প্রতিটি সমাবেশ থেকেই এটা বলছেন, এই সরকারের আয়োজনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। নির্বাচনকালীন সরকারের হাতে দায়িত্ব দিয়ে আওয়ামী লীগকে পদত্যাগ করতে হবে। এরপরে তাঁরা সংলাপ নিয়ে আগ্রহ দেখাবে। যদিও বিএনপি নেতার এমন বক্তব্যের বিপরীতে আওয়ামী লীগের সহসভাপতি কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, যদি আগে বিএনপি এটা বলে যে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নির্বাচনে অংশ নিবে তাহলে তাঁরা বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসতে পারে।
ইইউ প্রতিনিধি দল আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই দলের সাথে নির্বাচন নিয়ে দীর্ঘবৈঠক করেছে। বৈঠকে ইইউ প্রতিনিধি দলের দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ আছে কিনা প্রশ্নের উত্তরে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব (প্রথম পাতা, সমকাল)। ক্ষমতাসীন দলটি ইইউ দলকে জানিয়েছে, সংবিধানের বর্তমান কাঠামোর আওতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। বিএনপি ইইউ প্রতিনিধি দলকে তাঁদের দাবীর ব্যাপারে বিস্তারিত জানিয়েছে। বর্তমান সরকারের অধীনে অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলকে জানিয়েছে বিএনপি। যদিও দুই দলের কথার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র তাঁদের মতামত জানায় নি; তারপরও এতে এটা সহজেই অনুমেয় যে, দুই দলের মধ্যে সংলাপে বসার তেমন কোনো অবকাশ দেখা যাচ্ছে না। তাঁরা বরং দলীয় কৌশলে অটল থাকছেন। কিন্তু এতে করে প্রকৃত সমাধান আসবে কী?
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সাহাব এনাম খান দৈনিক সমকালে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। সেখানে তিনি একটি জায়গায় এই সঙ্কট থেকে উত্তরণের ব্যাপারে বলতে গিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখেছেন। তা হচ্ছে, গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরির জন্য সংলাপ বা সংলাপের জন্য গণতান্ত্রিক পরিবেশ- এ ধরনের বিতর্কে না গিয়ে সরাসরি দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থ নিয়ে কাজ করার মতো প্রতিনিধি কীভাবে নির্বাচিত করা যায় তা নিয়ে মূল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা দরকার। ষড়যন্ত্রমূলক চিন্তাভাবনা পরিহার করে গণতান্ত্রিক আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করা রাজনৈতিক দলগুলোর একটা মৌলিক দায়িত্ব ( নিবন্ধ- 'যুক্তরাষ্ট্র সংলাপ চায়, সহিংসতা চায় না', ১৬ জানুয়ারি দৈনিক সমকাল)।
একটি রাজনৈতিক দল দেশের শাসনকার্য গ্রহণ করে দেশের জনগণের সেবার জন্য। রাজনৈতিক দল নিয়ে গঠিত সরকার চেষ্টা করে তাঁর পূর্বের সরকারের থেকে জনগণকে আরও ভালো মানের সেবাপ্রদানত এবং ভবিষ্যত নির্বাচনের জন্য জনগণের সমর্থন আদায়। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে সেই জনগণই যেন পড়ে আছে রাজনীতির আলোচনার বাইরে। জনগণের সমর্থন কিংবা ভোটের চাইতে রাজনৈতিক মারপ্যাঁচসহ নানা অস্থিরতার মধ্য দিয়ে সরকার গঠন আমাদের দেশের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হচ্ছে। নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর চাইতেও দেশের জনগণের অংশগ্রহণ যে বেশি প্রয়োজন সেটা যেন আমরা ভুলতে বসেছি।
- শ্যামলাল গোসাঁই, কবি ও সংস্কৃতি কর্মী
- খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ