শ্যামলাল গোসাঁই
আপডেট: ১৪:১১, ৮ আগস্ট ২০২৩
সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩: নতুন মোড়কে পুরোনো হয়রানি?
জনবিরোধীতার মাঝেই ২০১৮ সালে ক্ষমতাসীন সরকার প্রণীত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অবশেষে পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। জনগনের প্রবল বিরোধীতা সত্ত্বেও এ আইনটি বাতিল করা না হলেও শেষ পর্যন্ত বৈদেশিক চাপে সরকার এ বিতর্কিত আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। যা এই সময়ের জন্য ক্ষাণিকতা স্বস্তির সংবাদ বলে মনে হলেও নতুন প্রস্তাবিত আইনটিতেও রয়েছে যথেষ্ট অস্বস্তির কারণ। অন্তত দেশের আইন বিশেষজ্ঞরা এই কথাই বলছেন।
দেশের বিশিষ্ট নাগরিকসহ আইন বিশেষজ্ঞরা এরিমধ্যে সেই অস্বস্তির কারণগুলোও সামনে এনে তুলে ধরছেন সংবাদ মাধ্যমগুলোর মারফতে। যার সারমর্ম হচ্ছে- আগের আইন বদলানো বা বাতিল করা হলেও নতুন প্রস্তাবিত আইনে রয়ে গেছে আগের আইনের হয়রানির সুযোগ। সহজ কথায়, পুরোনো আইনটি (ডিএসএস) বাতিল করলেও আদতে নতুন মোড়কে পুরোনো হয়রানি করার পদ্ধতিই জারি রেখেছে সরকার। ফলে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা আদৌ এ নয়া আইনে কতোখানি রক্ষিত হবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
সোমবার বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ পরিবর্তন করে নতুন আইনের খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। নতুন আইনটি ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’ নামে প্রতিস্থাপিত হবে বলে জানিয়েছে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। মন্ত্রী বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পরিবর্তিত হয়ে সাইবার নিরাপত্তা আইন হয়েছে। তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মধ্যে যেসব ধারা ছিল, সেই ধারা রেখে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ‘মিসইউজ’ ও ‘অ্যাবিউজ’ বন্ধ করার জন্য ব্যবস্থা নিয়েছি আইনের মাধ্যমে।
২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ১১ এপ্রিল পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা ১২৯৫টি মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)। তাতে ওঠে এসেছে, ২৭ দশমিক ৪১ শতাংশ মামলা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে।
এদিকে দেশের আইনজ্ঞরা মনে করছেন সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ দিয়ে আসলে মানুষের হয়রানি কমবে না। কেন কমবে সেসবের যৌক্তিকতাও তারা তুলে ধরেছেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া দৈনিক প্রথম আলোকে বলেছেন, এতোদিন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিলো, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটা ভালো, এর অপব্যবহার হচ্ছে। আমরা বলছিলাম, আইনটা ব্যবহার করা হচ্ছে, অপব্যবহার না। আইনটাই খারাপ। এই আইনটা এতোটাই খারাপ যে সংশোধন করলেও এর চরিত্র পাল্টানো যাবে না। তিনি বলেছেন, এ আইনের মধ্যেই অন্তর্নিহিত এক ধরনের উদ্দেশ্য আছে, যা হলো বিরুদ্ধ মত দমন করা। বিশিষ্ট এ আইনজীবী মনে করেন- আইনের নাম পরিবর্তন করে কেবল পাত্র পরিবর্তন করা হচ্ছে। বাস্তবে মৌলিক কোনো পরিবর্তন হবে না। (দৈনিক প্রথম আলো, ৮ আগস্ট, মঙ্গলবার)
নতুন প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও একই বিষয়ে হুঁশিয়ারি বার্তা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকারকে। সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ এর ঘোষণা দেয়ার পর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক আঞ্চলিক দপ্তর এক টুইটে বলেছে- বাংলাদেশ সরকারকে অবশ্যই এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পরিবর্তে যে সাইবার নিরাপত্তা আইন করার পরিকল্পনা করা হয়েছে, তাতে যেন ওই আইনের দমনমূলক বৈশিষ্ট্যগুলো ফিরিয়ে আনা না হয়। প্রায় একই কথা সরকারের উদ্দেশ্যে বলেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। প্রায় সকলেই বলছেন- নতুন আইনে আগের আইনের দমনমূলক বৈশিষ্ট্য যেন ফিরিয়ে আনা না হয়।
এখন নতুন প্রস্তাবিত আইনের কাঠামোর দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে আগের আইন থেকে সামান্য এদিক-সেদিক পরিবর্তন হলেও হয়রানির ক্ষেত্রগুলো আগের মতোই আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আগের চেয়ে পীড়নের মাত্রা বাড়ানোর উদ্যোগও নেয়া হয়েছে নতুন প্রস্তাবিত আইনে। আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনেকগুলো ধারা, যেমন মানহানির যে ধারাটা ছিল, সেই ধারায় আগে শাস্তি ছিল কারাদণ্ড। সেই কারাদণ্ডের জায়গায় এখন জরিমানার বিধান করা হয়েছে। অর্থাৎ মানহানির একমাত্র সাজা জরিমানা। এই সাজার পরিমাণ আবার এতো মোটা অংকের যে অনেক ভুক্তভোগী এ জরিমানার টাকা পরিশোধ করতে পারবেন কি না তা নিয়ে সংশয় আছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধাআয় মানহানির বিষয়টি রয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী, মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করলে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান ছিলো। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার আইন ছিল। নতুন আইনে যদিও কারাদণ্ডের বিষয়টি বাদ দেয়া হয়েছে। শাস্তি হিসেবে ধারায় রাখা হয়েছে শুধুমাত্র আর্থিক জরিমানা। ফলে নতুন আইনে একই অপরাধের জন্য কারাদণ্ড বাদ দিয়ে শাস্তি হিসেবে অনধিক ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। জরিমানা দিতে অক্ষম থাকলে তিন থেকে ছয় মাসের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ফলে ঘুরেফিরে প্রশ্ন উঠছে নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ দিয়ে আসলে কোন দিক থেকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করা হলো? কিংবা আদৌ নতুন সংযুক্ত এ ধারাগুলো দিয়ে বাক স্বাধীনতা রক্ষা করা সম্ভব হবে কি না। অনেকেই মনে করছেন, সম্ভব হবে না।
৮ আগস্ট দৈনিক প্রথম আলোর খবরে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ১১ এপ্রিল পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা ১২৯৫টি মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)। তাতে ওঠে এসেছে, ২৭ দশমিক ৪১ শতাংশ মামলা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। এই আইনের সমালোচনা করে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের সদস্যরা একাধিকবার বলেছেন, সরকার ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য এই আইন করেছে। নতুন প্রস্তাবিত আইনে যে ধারাগুলো রাখা হয়েছে এবং জরিমানার যে পরিমাণ রাখা হয়েছে তা দেখলেও এটিই প্রতীয়মান হয় যে সরকার মূলত জনমনে ভয় ও আতঙ্কের জিইয়ে রাখতে আইন বদলালেও আইনের চরিত্রে তেমন কোনো বদল আনে নি। বরং কারাদণ্ডের বিধান বাদ দিলেও ক্ষেত্রে বিশেষে বেড়েছে হয়রানির সুযোগ। নতুন আইনের ফলে আগের মতো মানহানিকর তথ্য প্রচার বা প্রকাশের দায়ে জেলের শাস্তি না হলেও যে পরিমাণ অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে তা কতোখানি সহনশীল তা ভেবে দেখার দরকার আছে বলে মনে করি।
খোলা জানালা বিভাগে আরও পড়ুন-
তাছাড়া, নতুন প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ এ বহুল বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২০, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২ ও ৪৬ ধারাগুলো অজামিনযোগ্য রয়েছে। আগের আইনের আরেকটি অসংগতি রয়ে গেছে এখনো। সেটি হচ্ছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর চলমান মামলাগুলো বাতিল করা হচ্ছে না। মামলাগুলোর বিচার আগের আইনেই চলবে বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। অর্থাৎ, বুঝাই যাচ্ছে আগের আইনটির আংশিক পরিবর্তন আনলেও আগের আইনে যারা ইতিমধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন বা যে মামলাগুলো প্রক্রিয়াধীন আছে সেগুলো চলমান থাকবে। এখানে প্রশ্ন রাখা যায়, এতোশত বিতর্ক আর সমালোচনার জন্য যে আইন সংশোধন করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে, সেই বিতর্কিত আইন মারফতেই যারা এখনো হয়রানির মধ্যে আছেন তারা কেন এই হয়রানি থেকে মুক্তি পাবেন না? তাদেরকে বরং কেন ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে না?
পরিশেষে, আইনটি এখনো অনুমোদন পায় নি। আগামী সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদের সম্ভাব্য শেষ অধিবেশনে নতুন আইন সংক্রান্ত বিলটি সংসদে উত্থাপন করা হবে। আইনটি সেখানে পাস হলে চলমান মামলাগুলোও সাইবার নিরাপত্তা আইনের অধীনে চলে যাবে। যদিও আইনমন্ত্রী বলছেন, নতুন আইনে অপপ্রয়োগের সুযোগ আছে এমন বিধানে সংশোধন আনা হয়েছে তথাপি মানবাধিকার সংস্থা ও কর্মীরা এ আইন বাতিলের জোর দাবী জানিয়ে যাচ্ছেন। এর কারণ, এই আইনটির অবৈধতা। একটি অবৈধ পন্থায় রচিত আইনকে যতোই সংশোধন ও পরিমার্জন করা হোক না কেন এই অসৎ উদ্দেশ্য দমিয়ে রাখা যায় না। নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ অনেকটা সেরকম বলেই মনে হচ্ছে। যেখানে, কারাদণ্ডের শাস্তি বাতিল করা হলেও বিশাল অর্থদণ্ডের ভয় দেখিয়ে চেষ্টা করা হবে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করবার। আগে যেই ভয় ছিলো কারাদণ্ডের সেই ভয়ের জায়গা এখন নিয়ে নেবে অর্থদণ্ড। কার্যত, উদ্দেশ্য আগের মতোই থাকবে। ফলে এটা বলাই যায়, নতুন প্রণীত আইনটি যে আসলে সুরত বদলে শয়তানের রুহু একই রাখা হয়েছে।
- শ্যামলাল গোসাঁই, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
- খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ