শ্যামলাল গোঁসাই
স্কুলছাত্রী জিনিয়ার আ ত্ম হ ন ন এবং বিবেকের দায়
কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী জিনিয়া খাতুনের মৃ ত্যু র ঘটনার রেশ এখনো কাটে নি। জিনিয়ার শোক সন্তপ্ত বাবা-মা অঝোরে কাঁদছেন এবং আরো কাঁদবেন। মেয়ে হারানোর এ কান্না তাঁরা ঠিক কতোদিনে মানিয়ে উঠতে পারবেন কেউ বলতে পারবে না। কেউ বলতে পারে না। কিন্তু কী কারণে মারা গেল জিনিয়ার মতো একটি স্কুলছাত্রী, কী এমন ঘটনা তাঁকে আ ত্ম হ ত্যা র মতো একটি বিষয়ে প্ররোচিত করলো তা নিয়ে বিস্তর কথা বলার আছে।
জানা গেছে জিনিয়ার মৃ ত্যু র সাথে জড়িয়ে আছেন তাঁর শিক্ষাগুরুরা। মাতা-পিতার পরেই আমরা যেই শিক্ষককে স্থান দেই, যাদের ভরশায় আমরা আমাদের সন্তানদের মানুষ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে বিদ্যালয়ের বারান্দায় ছেড়ে আসি সেই শিক্ষকরাই জড়িয়ে আছেন জিনিয়ার মৃত্যুর সঙ্গে। সহজ করে বললে, শিক্ষকরা জিনিয়াকে আ ত্ম হ ত্যা করতে প্ররোচিত করেছেন। যাদের কাছে জিনিয়াকে পাঠানো হয়েছিলো সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে তাঁরা একটি বিকৃত মানসিকতার চর্চা করে জিনিয়াকে মৃ ত্যু র দিকে ঠেলে দিয়েছেন। ফলে শিক্ষকদের নিয়ে বর্তমান সময়ে ওঠা নানা আঙ্গিকের প্রশ্ন, বিতর্কগুলো আরও প্রকট হয়ে আমাদের চোখে ধরা দিল।
শিক্ষকের পেশাকে এতোদিন মানুষ সম্মানের পেশা হিসেবে জেনে আসলেও সাম্প্রতিক কালে মানুষ শিক্ষক সম্পর্কে বিরূপ ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন। শিক্ষক কতৃক ব ল ৎ কা র, শিক্ষক কতৃক যৌ ন হয়রানির মতো ঘটনার সাথে মানুষ আগে পরিচিত ছিলেন না। এখন এসব ঘটনাই ঘটছে। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কে ছেদ ঘটছে। এই ছেদ ভালো বার্তা বয়ে নিয়ে আসবে না। গুরু এবং শিষ্যের সম্পর্কই যদি থাকে দা-কুমড়োর সেখানে মননশীল বিকাশ কীভাবে ঘটবে?
ঘটনার ব্যাপারে দেশের সংবাদ মাধ্যমে যতোটুকু জানা যায়- গত সোমবার কুমারখালীর সুলতানপুর মাহতাবিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাদে উঠে পাঁচ ছাত্রী ধূমপান করে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন জিনিয়াও। ধূমপানের শিক্ষককদের কাছে গেলে দু'জন শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে ডেকে এনে তাদের দীর্ঘক্ষণ শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন করেন। শিক্ষকরা তাদের ভিডিও ধারণ ও শাসন করে এগুলো অভিভাবকদের মধ্যে ছড়ানোর হুমকি দেন! এরপরেই দুই ছাত্রী নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। স্থানীয়রা তাদের জীবিত উদ্ধারে সক্ষম হলেও জিনিয়াকে বাঁচানো যায় নি। বিকেলে বাড়ি ফিরে জিনিয়া খাতুন গলায় ফাঁস নিয়ে মারা যায়।
ধূমপান একটি অপরাধ, প্রকাশ্যে ধূমপান দণ্ডনীয় অপরাধ। সেই হিসেবে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ধূমপানের দায়ে সেদিন শিক্ষকরা সর্বোচ্চ অধিকার নিয়েই ছাত্রীদের বিচার করতে পারতেন এমনকি এমনটাই হওয়া উচিৎ। কিন্তু যেটা উচিৎ হয় নি বা কাম্য নয় তাহলো- মোবাইলে ভিডিও ধারণ করা। একজন শিক্ষক কেন তাঁর ছাত্রীর ভিডিও মোবাইলে ধারণ করবেন আবার সেটা অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেবেন! একজন শিক্ষকের ব্যাপারে আমি যখন এই লেখাটি লিখছি আমার নিজের ভেতরেই এক প্রকারের ঘৃণার জন্ম নিচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে একজন শিক্ষকও এমনটা করতে পারেন?
এতোদিন আমরা নারীদের ভিডিও মোবাইলে ধারণ করে ছড়িয়ে দেয়া বা এ ধরণের হুমকি দেয়ার কাজ বখাটে, খারাপ চরিত্রের লোকেরা খারাপ মনোবাসনা থেকে করতো। এখন একই কাজ করছেন শিক্ষকরাও! অন্তত কুমারখালীর জিনিয়ার মৃ ত্যু র ঘটনায় তো আমরা এমনই দেখলাম। দু'জন শিক্ষকের বিকৃত মনমানসিকতার বলির শিকার হয়ে আ ত্ম হ ত্যা হতে দেখলাম একজন শিক্ষার্থীকে। যা সামাজিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত স্থলন বলেই মনে করি আমি। এসব ঘটনার পর ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক নিয়ে শঙ্কিত ভাবনার উদয় হয়।
একইসঙ্গে এই ঘটনা নারীর প্রতি আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির একটা স্বার্বিক চিত্রও তুলে ধরেছে। শিক্ষক, কুলি, মজুর, শিক্ষিত, অশিক্ষিত নির্বিশেষে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একটি নারীকে এখনো কতোভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হয় তাঁর একটা দিক এই ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে। যা কোনোভাবেই কোনো ভালো সংবাদ নয়।
এ ঘটনার পর নিহত শিক্ষার্থীর জানাযায় গিয়ে লাঞ্চনার শিকার হয়েছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। এরপর পাল্টাপালটি কর্মসূচি দিয়েছেন শিক্ষার্থীদের অভিবাবক ও শিক্ষকরা। এ যেন এক ঘোর কলির কাল চলছে। যাদের ঠাই মাতা-পিতার পরেই সেই মাতা-পিতারাই বর্তমান সময়ে এসে পরস্পর মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছেন। আর দৃশ্য আদতে আমাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে শিক্ষা খাতসহ আমাদের সামাজিক তীব্র স্থলের ঘৃণ্য দৃশ্যগুলোও।
বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষে বসেই প্রতিটি শিক্ষার্থী আমরা বাল্যপাঠে পড়েছি কাজী কাদের নেওয়াজের সেই বিখ্যাত কবিতা শিক্ষাগুরুর মর্যাদা। অথচ, আজকের দিনে সেই কবিতার প্রাসঙ্গিকতা যেন আকাশ আর জমিনের মতোই তফাতে। আজকাল শিক্ষকদেরকে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, মানববন্ধন করতে দেখা যায়। শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে মানববন্ধনে দাঁড়াতে দেখা যায় অহরহ। শিক্ষকরা আজকাল শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষার চাইতে ক্ষমতাসীন দল কিংবা পক্ষের স্বার্থে মানববন্ধন করা ও বিবৃতি লেখায় বেশি মনোযোগী। এসবকিছুই আসলে আমাদের আমুল সামাজিক ও শিক্ষা ব্যবস্থার নাজুক অবস্থার দিকেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যদিও আমরা সেদিকে আকর্ষিত হই না। ফলত; ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক দিনদিন তলানিতে গিয়ে ঠেকছে।
আমরা যারা শিক্ষাজীবন পেরিয়ে এসে আজ যে যার কর্মে ব্যস্ত তাঁরা আজও আমাদের সেইদিনের শিক্ষাগুরুকে দেখলে পথ থেকে সরে দাঁড়াই, মাথা নিচু হয়ে আসে শ্রদ্ধায়, তাদের দেখলে এখনো ভয়ে কাঁচুমাচু করি। এই বুঝি স্যারের সেই ধাতব হাতের একটা চাপড় এসে পিঠে পড়লো। কিন্তু স্যারেরা এখন আর মারতে আসেন না। তাঁরাও সহাস্যে এখনো কুশলবিনিময় করেন। শিক্ষকদের সাথে সম্পর্কের এ দিকগুলো এখন আর শিক্ষার্থীদের মাঝে দেখা যায় না। শিক্ষার্থীরা এখন স্যারেদের সামনেই ধূমপান করে অবলীলায়। কোনো কোনো জায়গায় শিক্ষককে শাসানোর কারণে শিক্ষার্থীর হাতে মারধর খেতে হয়েছে এমন খবরও পড়েছি সাম্প্রতিককালে। এই অবক্ষয়ের দায় যেমন শিক্ষকের, যেমন শিক্ষার্থীদের তেমনি আমাদের অভিবাবক এমনকি সমাজেরও।
আমাদের গোটা সমাজের একটা অস্থিরতা কাজ করছে। শিক্ষা ক্ষেত্রেও এই ব্যতিক্রম নেই। এখন শিক্ষায় ছাত্র-ছাত্রীদেরকে লেলিয়ে দেয়া হয় এ প্লাস, গোল্ডেন এ প্লাসসহ নানা বৃত্তিমূলক কুবৃত্তির কাজে। শিক্ষার্থীদের নীতি-নৈতিকতাগত মানস গঠনের চাইতে কলাপাতা সংগ্রহের জন্য শিক্ষার্থীদেরকে একরকম নির্যাতন করা হচ্ছে আজকাল। ফলে আমাদের শিক্ষার্থীদের কাছেও শিক্ষা বলতে রেসের ঘোড়ার মতো সেই গোল্ডেন প্রাপ্তিই প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁরা ভুলতে বসেছে শিক্ষার নীতি-নৈতিকতার পাঠ। শিক্ষকরাও তেমনি, তারাও এখন শিক্ষাকে আর সেবা হিসেবে না নিয়ে নিয়েছেন বাণিজ্য হিসেবে। শিক্ষকদেরকে আজকাল সনদ বিক্রির মতো লজ্জাজনক কাজে জড়িত হতে দেখা যায়। যেখানে শিক্ষকরাই নীতি-নৈতিকতাবহির্ভুত কর্মকাণ্ডে লিপ্ত তাদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীদের নীতি শিক্ষা কীরূপ হবে বা হচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়। এর জন্য শিক্ষকদের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি মানোন্নয়ন বলে মনে করেন শিক্ষা বিশারদরা।
শিক্ষকের পেশাকে এতোদিন মানুষ সম্মানের পেশা হিসেবে জেনে আসলেও সাম্প্রতিক কালে মানুষ শিক্ষক সম্পর্কে বিরূপ ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন। শিক্ষক কতৃক ব ল ৎ কা র, শিক্ষক কতৃক যৌ ন হয়রানির মতো ঘটনার সাথে মানুষ আগে পরিচিত ছিলেন না। এখন এসব ঘটনাই ঘটছে। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কে ছেদ ঘটছে। এই ছেদ ভালো বার্তা বয়ে নিয়ে আসবে না। গুরু এবং শিষ্যের সম্পর্কই যদি থাকে দা-কুমড়োর সেখানে মননশীল বিকাশ কীভাবে ঘটবে?
শিক্ষকদের নিয়ে কুষ্টিয়ায় কুমারখালীতে শিক্ষকদের নির্যাতনের শিকার হয়ে আ ত্ম হ ত্যা করা জিনিয়াকে নিয়ে যখন তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে ঠিক তখনি নওগাঁর কিছু শিক্ষার্থী তাদের প্রাণ-প্রিয় শিক্ষককে শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় ঘোড়ার গাড়ি চড়িয়ে সংবর্ধিত করছেন। এমন ঘোর অন্ধকার সময়ে এমন খবরও যখন পত্রিকায় পড়ি তখন আশার পিদিম একটু করে যেন জ্বলে ওঠে। এখনো সেইসব শিক্ষকদের কিছু রয়ে গেছেন যারা তাদের ছাত্র-ছাত্রীদের নিজের ছেকে-মেয়ের চোখে দেখেন। তাদের জন্য স্বপ্ন দেখেন, সেই স্বপ্নে বিভোর হয়ে তাদের জন্য হাসেন, কাদেন।
ব্যতিক্রমী এক আয়োজন এটা। সজ্জিত ঘোড়া আনা হয়েছে, সেই সঙ্গে আনা হয়েছে ঘোড়ার গাড়িও। এই ঘোড়ার গাড়িতে কোনো বর-কনে চড়বেন না; চড়বেন একজন শিক্ষক, শিক্ষাগুরু। শিক্ষাগুরুর প্রতি আকণ্ঠ শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা প্রদর্শনে শিক্ষকদের বিদায় সংবর্ধনায় এমনি এক তাক লাগানো উদ্যোগ নিয়েছিল নওগাঁর বদলগাছী উপজেলায় ভরট্ট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ ঘটনার একেবারে বিপরীত ঘটনা জিনিয়ার আ ত্ম হ ত্যা। তাঁরা দুজনেই শিক্ষক। কিন্তু তবু যেন দুজনের মাঝে এক আকাশ পার্থক্য।
- শ্যামলাল গোসাঁই, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
- খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আই নিউজ/এইচএ
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ