জসীম উদ্দীন মাসুদ
আপডেট: ১৩:১৮, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩
সাক্ষরতা ও প্রাথমিক শিক্ষার হালচাল
জসীম উদ্দীন মাসুদ
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সার্বজনীন ও প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের ২৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, "রাষ্ট্র সমান সুযোগের ভিত্তিতে শিশুর শিক্ষা লাভের অধিকারকে স্বীকার করবে এবং এই অধিকারকে বাস্তবায়ন করবে"। এই সনদের ২৮(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, "রাষ্ট্রসমূহ বিশ্বব্যাপী অজ্ঞতা ও নিরক্ষরতা দূর করার জন্যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতাকে জোরদার ও উৎসাহিত করবে"।
১৯৬৬ সালে যখন আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস শুরু হলো তখনও বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়নি। তারও ৪ বছর আগে বঙ্গবন্ধু ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের সময় কার্যকরী সর্বজনিন শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলেছিলেন। ১৯৭০ এর নির্বাচনের সময় টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘নিরক্ষতা অবশ্যই দূর করতে হবে। পাঁচ বছর বয়স্ক শিশুদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্যে একটি ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চালু করতে হবে।’
সাক্ষরতা
একসময় সাক্ষর বলতে কেবল অক্ষর জ্ঞানের সাথে নিজের নাম লিখতে পারার দক্ষতাকেই বোঝানো হতো। তখনকার প্রেক্ষাপটে এইটুকু অর্জন করাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। তবে দিন দিন এর পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সময়ের সাথে সাথে সাক্ষরতা শব্দটির ব্যপকতা বাড়ছে। সাক্ষরতা হচ্ছে পড়া, অনুধাবন করা, মৌখিকভাবে ও লেখার বিভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করা, যোগাযোগ স্থাপন করা এবং গণনা করার দক্ষতা। অর্থাৎ সাক্ষরতা বলতে লিখতে, পড়তে, গণনা করতে ও যোগাযোগ স্থাপন করার সক্ষমতাকে বোঝানো হয়।
আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো’র উদ্যোগে ১৯৬৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো ‘আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস’ পালন করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উদযাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
সময়ের গুরুত্ব বিবেচনায় ইউনেস্কো এ বছর অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক একটি বিষয় সাক্ষরতা দিবসের প্রতিপাদ্য হিসাবে নির্ধারণ করেছে- ‘Promoting literacy for a world in transition: Building the foundation for sustainable and peaceful societies’, যার বাংলা ভাবানুবাদ করা হয়েছে, ‘পরিবর্তনশীল ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে সাক্ষরতার প্রসার’।
সাক্ষরতা, শিক্ষা ও উন্নয়ন
সাক্ষরতা, শিক্ষা ও উন্নয়ন- একটির সাথে আরেকটি ওতোপ্রাতভাবে জড়িত। সাক্ষরতা একটি দেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। দেশের অগ্রযাত্রায় এর একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। শিক্ষার সঙ্গেও সাক্ষরতার রয়েছে নিবিড় যোগসূত্র। দেখা গেছে যে দেশে সাক্ষরতার হার যত বেশি সে দেশ তত বেশি উন্নত। তবে সাক্ষরতার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার হার বৃদ্ধির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।
সাক্ষরতার হার
১৯৭১ সালে দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। তিন বছর পর ১৯৭৪ সালে এই হার দাড়ায় ২৫ দশমিক ৯ শতাংশে। এরপর ২০০১ সালে সাক্ষরতার হার বেড়ে দাড়ায় ৪৭ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০২২ সালের জনশুমারির প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী জাতীয়ভাবে সাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। সাক্ষর পুরুষের হার ৭৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং সাক্ষর নারী ৭২ দশমিক ৮২ শতাংশ। আগের জনশুমারির সময় জাতীয়ভাবে সাক্ষরতার হার ছিল ৫১ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
এদিকে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস ২০২৩ উপলক্ষে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষে বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশে সাক্ষরতার হার ৭৬ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে এ হার ছিল ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। সেই হিসাবে এক বছরে দেশে সাক্ষরতার হার বেড়েছে ১ দশমিক ৪২ শতাংশ।
দেশের প্রায় ৯৬ শতাংশ শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। নিরক্ষরতা দূরীকরণেও অর্জিত হয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য। দশ বছর আগে যেখানে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী ভর্তির হার ছিল ৬১ শতাংশ। বর্তমানে সেখানে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের সংখ্যা শতভাগ।
বাংলাদেশে সাক্ষরতা ও প্রাথমিক শিক্ষার ক্রমবিকাশ
১৯৬৬ সালে যখন আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস শুরু হলো তখনও বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়নি। তারও ৪ বছর আগে বঙ্গবন্ধু ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের সময় কার্যকরী সর্বজনিন শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলেছিলেন। ১৯৭০ এর নির্বাচনের সময় টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘নিরক্ষতা অবশ্যই দূর করতে হবে। পাঁচ বছর বয়স্ক শিশুদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্যে একটি ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চালু করতে হবে।’
১৯৭২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি একটি প্রেসনোটের মাধ্যমে জানানো হয়, প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যে বই পাবে এবং ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা পাবে বাজার মূল্যের চেয়ে ৪০ শতাংশ কম দামে। নারীর উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাসে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নারীদের অবৈতনিক শিক্ষা চালু করার যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
শিক্ষা ব্যবস্থার দিকনির্দেশনা প্রদান করার জন্য বিখ্যাত শিক্ষাবিদ বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই-খুদাকে সভাপতি করে ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে ১৯ সদস্যবিশিষ্ট একটি শিক্ষা-কমিশন গঠন করা হয়। বঙ্গবন্ধুর একান্ত ইচ্ছায় ১৯৭৪ সালের মে মাসে একটি সুদূরপ্রসারি লক্ষ্য নিয়ে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা-কমিশন প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। উচ্চশিক্ষা গ্রহণেচ্ছুদের জন্য সাক্ষরতা অভিযান নামে বিশেষ একটি পদক্ষেপের কথা শিক্ষা-কমিশনে উল্লেখ করা হয়। ৫ বছরের মধ্যে ১১-৪৫ বছর বয়সী সাড়ে তিন কোটি নিরক্ষর মানুষকে অক্ষরজ্ঞান দেয়ার প্রস্তাব ছিল এই শিক্ষা-কমিশনে। অর্থাৎ শুধু নিজে শিক্ষিত হলে চলবে না, বরং নিরক্ষরদের শিক্ষিত করার মাধ্যমে সামাজিকতা তৈরি ও দেশ গঠনে অবদান রাখতে হবে।
বঙ্গবন্ধু সরকার স্বাধীন দেশে প্রথম যে বাজেট ঘোষণা করেছিলেন তাতে প্রতিরক্ষা খাতের চেয়ে শিক্ষা খাতে ৭% বরাদ্দ বেশি রেখেছিলেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে প্রায় ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ, ১ লাখ ৫৭ হাজার ৭২৪ জন শিক্ষককে সরকারীকরণ, ১১ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন, ৪৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগ ও চাকরি সরকারীকরণ, ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে বই ও গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের পোশাক দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন।
১৯৭৩ ঠাকুরগাঁওয়ে সাক্ষরতা অভিযান শুরু হয়। ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের প্রধান অনুষ্ঠানটি হয় ঠাকুরগাঁয়ে। ওইদিন ঠাকুরগাঁওয়ের কচুবাড়ী-কৃষ্টপুর গ্রামকে বাংলাদেশের প্রথম নিরক্ষরতামুক্ত গ্রাম হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের একটি আইন প্রণয়ন করেন। তার আগ্রহে ১৯৭৪ সালের ২২ জুন ‘জাতীয় শিশু আইন’ জারি করা হয়। ১৯৭৪ সালের প্রথম জাতীয় শিক্ষা কমিটি প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করেছিল।
১৯৮১-৮৫ মেয়াদে বাংলাদেশের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রথম সর্বজনীন অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন করা হয়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৮১ সালে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রাথমিক বাধ্যতামূলক আইন পাশ হয়, ১৯৯০। ১৯৯১ সালে সাক্ষরতার হার হয় ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশে। এ সময় দেশব্যাপী শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে ‘সমন্বিত উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা বিস্তার কার্যক্রম (ইনফেপ)’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়।
বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রাথমিকভাবে ৬৮ টির উপজেলায় চালু হয় ১ জানুয়ারী, ১৯৯২ এবং ১ জানুয়ারী, ১৯৯৩ থেকে দেশব্যাপী এই কর্মসূচি সম্প্রসারিত হয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়- ১৯৯২ সালে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত হয়- ২০০৩ সালে।
প্রাথমিক শিক্ষাকে গতিশীল করতে আরও যত উদ্যোগ
শিক্ষাকে মূলধারায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি ২৬,১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১,৪৪,৮৭৬ জন শিক্ষকের চাকরী জাতীয়করণ করেন। ২০১৩ সাল হতে পিটিআই গুলোতে এক বৎসর মেয়াদী সি-ইন-এড কোর্সের পরিবর্তে দেড় বৎসর মেয়াদী ডিপিইএড প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করা হয়েছে।
প্রতি বছর প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের ১৩টি ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষা পদক প্রদান করা হচ্ছে। ২০১৪ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের জীবনমান, প্রশাসনিক ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিতে প্রধান শিক্ষক পদটিকে ৩য় শ্রেণী থেকে ২য় শ্রেণীর পদ মর্যাদায় উন্নীত করা হয়েছে।
সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শতভাগ উপবৃত্তি প্রদান, মিড ডে মিল, স্টুডেন্ট কাউন্সিল গঠন, কাব স্কাউট দল, ক্ষুদে ডাক্তারের দল, প্রাক্তন শিক্ষার্থী এলামনাই এসোসিয়েশন, বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্ণামেন্ট, জাতীয় পর্যায়ে আন্ত:প্রাথমিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ইত্যাদির মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা বহুমাত্রিকতা পেয়েছে । এখন একটি গ্রামের সবচেয়ে সুন্দর ভবনটি হলো ঐ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়টি।
শিক্ষায় নারী-পুরুষ সমতা
১৯৯০ সালে বাংলাদেশে নারী শিক্ষার হার বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম ছিল। অথচ এখন প্রায় শতভাগ মেয়েই এখন স্কুলে যাচ্ছে। মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে এই অর্জনকে উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা ‘বিস্ময়কর’ বলে বর্ণনা করছেন। মেয়েদের জন্য বিদ্যালয়ে যে পরিবেশ থাকা দরকার, তা নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে সবার জন্য বৃত্তি থাকলেও, মাধ্যমিক পর্যায়ে শুধু মেয়েদের জন্য বৃত্তি রাখা হয়েছে।
এখন বাংলাদেশে শিক্ষায় নারী-পুরুষের সমতা অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশে শিক্ষায় ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রীদের শিক্ষাগ্রহণে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার ভেতরে বাংলাদেশ সবার ওপরে অবস্থান করছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রথম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
বিনামূল্যে বই
২০১০ সাল থেকে উৎসব করে বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই তুলে দেওয়ার রেওয়াজ শুরু হয়েছিল। ২০২৩ সালে সারাদেশে ৩৪ কোটি ৭০ লাখ ২২ হাজার ১৩০ কপি পাঠ্যপুস্তক ৪ কোটি ১৭ লাখ ২৬ হাজার ৮৫৬ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ব্রেইল পাঠ্যপুস্তকক ও ৫টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষায় প্রণীত পাঠ্যপুস্তক রয়েছে।
২০১০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বর্তমান সরকার আমলে সর্বমোট ৪৩৪ কোটি ৪৫ লাখ ৮০ হাজার ২১১ কপি পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। বছরের প্রথম দিন শিশুদের হাতে বিনামূল্যে বই তুলে দেওয়া সরকারের একটি অসামান্য কৃতিত্ব। উন্নত বিশ্বে যেটি সম্ভব হয়নি সে অভাবনীয় কৃতিত্বই দেখিয়েছে বাংলাদেশ।
সাক্ষরতায় স্বীকৃতি
দেশের প্রায় ৯৬ শতাংশ শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। নিরক্ষরতা দূরীকরণেও অর্জিত হয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য। দশ বছর আগে যেখানে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী ভর্তির হার ছিল ৬১ শতাংশ। বর্তমানে সেখানে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের সংখ্যা শতভাগ। সাক্ষরতা বিস্তারে এ বিশাল অর্জনের জন্য বাংলাদেশ সরকার ইউনেস্কোর স্বীকৃতি হিসেবে ‘আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা পুরস্কার-১৯৯৮ লাভ করে।
প্রাথমিকে নতুন পদ সৃজন ও নতুন কোয়ালিশনে যোগদান
সম্প্রতি শিক্ষকদের চাকুরিতে পদোন্নতির ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। প্রাথমিকে অনেক শিক্ষককে সহকারি শিক্ষক হিসেবে ৩৮ বছর একই পদে চাকরি করে অবসরে যেতে হয়েছে। এ অবস্থা কাটাতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে নতুন বিধিমালা তৈরি হয়েছে। নবসৃষ্ঠ ৬৫ হাজার সহকারি প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি পাবেন। শিক্ষকরা অধিদপ্তরে পরিচালক হওয়ারও সুযোগ পাবেন।
বাংলাদেশ ৮৫তম দেশ হিসাবে ‘গ্লোবাল স্কুল মিলস কোয়ালিশন’-এ যোগদান করেছে। এ বিষয়ে ২০২৩ সালের ২৪ জুলাই ইতালির রোমে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব ফরিদ আহাম্মদ কোয়ালিশনের কমিটমেন্ট ডিক্লারেশনে স্বাক্ষর করেন।
কি হবে শিক্ষানীতির
সবশেষে শিক্ষানীতি প্রণয়ন হয় ২০১০ সালে, আজ প্রায় ১০ বছর পার হয়ে গেছে। সে শিক্ষানীতির তেমন কোনো বাস্তবায়ন এখনও হয়নি। শিক্ষানীতির বড় একটা ব্যাপার ছিল, প্রাথমিক শিক্ষার সংজ্ঞা কী হবে। শিক্ষানীতিতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে- ক্লাস ওয়ান থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত হবে প্রাথমিক শিক্ষা। আজ পর্যন্ত কিন্তু আমরা প্রাথমিক শিক্ষার বিভাজনটা করতে পারিনি। এখনো ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত রেখে দেওয়া হয়েছে। মাদ্রাসা, কিন্ডারগার্টেন, বাংলা মিডিয়াম, ইংরেজি মিডিয়াম নানাদিক বিবেচনায় প্রাথমিকের ১১ রকমের শিক্ষাকে একই ধাঁচে নিয়ে আনার প্রয়াস চালাতে হবে। শিক্ষা আইন করি করি বলে কত বেলা পেরিয়ে গেলো তা-ও বিবেচনায় আনতে হবে।
বাড়াতে হবে শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষ
দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষ নেই। প্রতিটি বিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে ক্রমান্বয়ে যথাযথ সুযোগ সুবিধা সহ প্রয়োজনীয় সংখ্যক শ্রেণীকক্ষ নির্মাণ করা দরকার। এছাড়াও প্রতিটি বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংখ্যা বাড়ানো এবং প্রতিটি শিক্ষককে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা দরকার। যতটুকু জানা যায় সার্কভুক্ত ৮ টি দেশের প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকদের বেতন কাঠামোতে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো নয়। এদিকেও লক্ষ্য দিতে হবে সরকারকে।
কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাবে ২০২১ ও ২০২২ সালে অন্তত ১৮ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় (কিন্ডারগার্টেনসহ) বন্ধ হয়ে গেছে। এরমধ্যে বেশিরভাগ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। মালিকপক্ষ খরচ চালাতে না পারার কারণে এসব বিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগই ২০২১ সালের দিকে বন্ধ হয়ে যায়। তবে বিদ্যালয়ের সংখ্যা কমলেও এক বছরের ব্যবধানে প্রায় সাড়ে চার লাখ শিক্ষার্থী বেড়েছে। সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের করা ২০২২ সালের বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারিতে (এপিএসসি) এ তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে সরকারি ও বেসরকারি (কিন্ডারগার্টেনসহ) প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল ১ লাখ ৩৩ হাজার ২টি। ২০২১ সালে কমে হয় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮৯১টি। আর ২০২২ সালে তা কমে হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৫৩৯টি; যার মধ্যে সরকারি ৬৫ হাজার ৫৬৬টি। অর্থাৎ, দুই বছরের ব্যবধানে প্রাথমিক বিদ্যালয় কমেছে ১৮ হাজার ৪৬৩টি।
বাড়াতে হবে বরাদ্দ
বিগত পাঁচ বছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বাজেট ও জিডিপির তুলনায় বরাদ্দ কমেছে। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে এই মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ। ২০২৩-২৪ বছরের বাজেটে তা কমিয়ে আনা হয়েছে ৪ দশমিক ৫৬ শতাংশে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষাখাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির তুলনায় ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে শিক্ষাখাতে মোট বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ইউনেস্কোর পরামর্শ, একটি দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করা উচিত। আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষার জন্য মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ বা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি টাকা শিক্ষাখাতে বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে ইউনেস্কোর পরামর্শ, একটি দেশের মোট বাজেটের ২৫ শতাংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করা উচিত।
শেষ কথা
এসডিজি অর্জনের যে লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করতে হবে। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, জাতিসংঘ সাক্ষরতাকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। দেশের বিরাট জনশক্তিকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করার মূল হাতিয়ার হচ্ছে শিক্ষা। সাক্ষরতার পথ পেরিয়ে শিক্ষাকে অবলম্বন করে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে বহুদূর- এ প্রত্যাশা হোক আমাদের সকলের।
জসীম উদ্দীন মাসুদ, লেখক ও গবেষক
অরো পড়ুন :
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ