শ্যামলাল গোঁসাই
আপডেট: ১০:৫৬, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩
তানজিম সাকিবরা কেন আজকের দিনেও নারী বিদ্বেষী?
এশিয়া কাপে নিজেদের শেষ ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে এগার বছর পর ওয়ান ডে'তে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। জয়সূচক ওই নিজের বোলিং এর ধার দেখিয়েছেন বাংলাদেশ দলের নবাগত পেসার তানজিম সাকিব। তবে, এই ম্যাচে পারফর্ম্যান্সের জেরে এখন তানজিম সাকিব যতোটা না আলোচনায় আছেন তার থেকে বেশি আলোচনায় তাঁর 'নারী বিদ্বেষী' পোস্ট শেয়ার করার কারণে। দেশজুড়ে কেউ এর জন্য তীব্র সমালোচনা করছেন নবাগত সাকিবের। আবার কেউ কেউ সাকিবের পাশে দাঁড়িয়ে সাকিবের পক্ষও নিচ্ছেন।
বলতে গেলে তানজিম সাকিবের এ পোস্টকে ঘিরে দেশের মানুষ এখন দুইটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছেন। একদল, যারা নারী আন্দোলনকর্মী বা নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। আরেকদল, যারা মনে করেন নারীর জন্য সবথেকে নিরাপদ জায়গা হলো তাঁর ঘর এবং পর্দা নারীর অবশ্য কর্তব্য, চাকরি নয়।
তানজিম সাকিব এতোসব আলোচনা-সমালোচনার মাঝে যদিও বিসিবির মারফতে এর জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছেন (পেরেছেন?)। তিনি স্বীকার করেছেন তাঁর মা-ও একজন নারী; তাই তিনি কখনো নারী বিদ্বেষী হতে পারেন না। কিন্তু সাকিবের এই ভুল বুঝতে পারা বা স্বীকার করাতেই তাতেই কি স্বার্বিক সমাধান হয়ে গেলো? আমার মনে হয় এর উত্তর হবে না। কারণ, নারী বিদ্বেষী মনোভাব নিয়ে এ বঙ্গদেশে শুধু তানজিম সাকিবই চলাফেরা করেন না। সাকিবের মতো আরো লক্ষ লক্ষ সাকিব আছেন, যারা শিক্ষিত, মার্জিত, সভ্য কিন্তু মনে করেন নারী গৃহকত্রী হিসেবেই সবথেকে মানানসই। তাঁরা এটা বিশ্বাস করেন নারী বাইরে কাজ করার কোনো গুরুত্ব বা অধিকার নেই। নারীদের পতীব্রতা ও সুগৃহকর্তী হওয়াতেই তাঁদের গৌরব, এই হচ্ছে তাঁদের থিওরি বা আদর্শ।
তানজিম সাকিব ক্ষমা চেয়েছেন, আপাতঃ দৃষ্টিতে বিষয়টি ভালো মনে হলেও আসলেই তানজিম সাকিব বিষয়টি কতোটুকু নিজের উপলব্ধি থেকে বলেছেন তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। তাঁর সামনে একটি উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনার সুযোগোকে কাজে লাগাটে, তাঁর দেয়া স্ট্যাটাসের কারণে সৃষ্ট এই উদ্ভট পরিস্থিতি মোকাবিলায় সাকিব হয়তো এখন ক্ষমা চেয়েছেন। কিন্তু, মন থেকে তাঁর এই আদর্শটি সাকিব মুছে ফেলতে পারবেন কী? মন থেকে কী সাকিব নারীদের অধিকারের বিষয়টিকে স্বীকার করে নেবেন?
সাকিবদের মতো মানুষদের এই যে চিন্তা, আদর্শ আর বিশ্বাস এই বিশ্বাসের জন্য শুধুমাত্র ইসলাম বা কোনো নির্দিষ্ট ধর্মকে দায়ী করা নেহাতই বোকামি বলে মনে হয়। বরং, এই নারী বিদ্বেষী হয়ে ওঠার নেপথ্যে আমাদের আদিকাল থেকে চলমান ঘটনা, জীবনপ্রবাহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাই সময়ের সেরা প্রশ্নটি হতে পারে তানজিম সাকিবরা কেন নারী বিদ্বেষী হয়ে ওঠেন। এমন প্রতিভাবান, মেধাবী মানুষগুলো কেন নারী বিদ্বেষের মতো নোংরা বিষয়কে মনে ধারণ করেন? তাঁদের এই নারী বিদ্বেষী হয়ে ওঠার পেছনে আমাদের দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা সমাজব্যবস্থা দায়ী নয় কী? এই প্রশ্নগুলোও সম্মুখে রাখতে হবে আমাদের।
নারী বিদ্বেষ বা নারী অধিকার খর্বের কথা উঠলেই ইসলাম ধর্মকে সামনে তুলে ধরা হয়। এটাও এক ধরনের ধর্ম বা সম্প্রদায় কেন্দ্রিক রাজনীতিরই বহিঃপ্রকাশ। এটা ঠিক, ইসলাম ধর্ম নারী অধিকার বা নারীদের নিয়ে একটু বেশিই রক্ষণশীল। এতে নারীর বহু অধিকারই হরণ করা হয়। যেমন সনাতন ধর্মে নারীদের সহমরণের মতো একটি নিকৃষ্ট নারী নিগ্রহের কাজকেও পূণ্যের মনে করে আয়োজন করে পালন করা হতো। এই সেদিনকার বিশ্বও দেখেছে ইউরোপে কীভাবে দলে দলে মুক্তিকামী, স্বাধীনচেতা নারীদের ডাইনী অভিযোগে হত্যা করা হয়েছে। এই যে দেশে দেশে নারীর প্রতি হিংসা, নিগ্রহ আর নির্যাতনের ইতিহাস এসবের পেছনে শুধুমাত্র ধর্মই দায়ী নয়। ধর্মের থেকেও বেশি যা দায়ী তা হলো আমাদের পুরুষতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা। আমরা দেশ, জাতি, ধর্ম, গোত্র, সীমানার দিক থেকে আলাদা আলাদা হলেও এক জায়গায় সমগ্র বিশ্ববাসীর মিল রয়েছে। আর সেটা হলো, আমরা দেশভেদে আলাদা আলাদা সকলে মিলে তৈরি করতে পেরেছি একটি পুরুষতান্ত্রিক বিশ্ব সমাজব্যবস্থা।
আধুনিক বিশ্বে নারীদের প্রত্যক্ষে যতোটা খোলামেলা আর অধিকারসম্পন্ন বলে ছড়ানো হয় বাস্তবতা আসলে তা নয়। অবকাঠামোগত দিক থেকে বা নীতি, কূটনীতি, নানা সূচকে আমরা আধুনিক হয়ে বটে। আমাদেরকে এখন আর সেই আদিকালের গুহায় থাকতে হয় না। কিন্তু সেই গুহাকাল থেকে লালন করা পুরুষতান্ত্রিক একটা চিন্তা, আদর্শ আমরা আজ পর্যন্ত নিজেদের সাথে নিয়ে ঘুরছি। নারীদের প্রতি বিদ্বেষের ঘটনাগুলো সেই পুরাকাল থেকেই হয়ে আসছে। সব দেশে, সব কালেই এটা ছড়ানো হয়েছে- নারী পুরুষের চেয়ে দুর্বল। পুরুষ নারীর তুলনায় শ্রেষ্ঠ। ধর্ম দিয়ে বলানো হয়েছে নারী, তোমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে পুরুষের বাঁ উরুর হাড় দিয়ে! এ সমস্তই পুরুষতন্ত্রের ফসল। ধর্ম পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস বা অনুষঙ্গ মাত্র। এই ধর্মগুলোও যে পুরুষরাই যুগে যুগে প্রণয়ন করেছেন তাও ধর্ম আর ধর্মগ্রন্থগুলো বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায়। সুতরাং, নির্দিষ্ট কোনো ধর্মকে নারী অসাম্যের অধিকার আদায়ের পরিপন্থী তা বলা বোধয় ঠিক না।
পৃথিবীর সুপুরুষগণ ধর্মেরও আগে যে বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তা হলো নারীকে অবদমিত রাখা। শ্রেষ্ঠত্বের মুকুটটি বিশ্বের পুরুষগণ সবসময় নিজেদের জন্যই সাজিয়েছেন। নারীকেও সাজিয়েছেন বটে। কিন্তু পুরুষের সমকক্ষ করে নয়। খুব কৌশলে; নারীকে বাধ্য করেছেন পুরুষের মাথায় তুলে দিতে শ্রেষ্ঠত্বের সেই মুকুট। আমাদের নারীরা জানে, আনজানে আজও পুরুষের সেই মুকুটটি হস্তগত করতে পারেন নি। বরং, তাদেরকে আধুনিক বলয়ে আরো আধুনিকভাবে নিগ্রহের পথ বেছে নিয়েছে পুরুষতান্ত্রিক বিশ্ব সমাজ।
আমাদের আধুনিক সমাজে এখনো নারী-পুরুষের অসাম্যটি স্পষ্ট চোখে দেখা যায় কারণ, আমরা আধুনিক হতে চেয়েছি কিন্তু নারীর অধিকার তাঁকে দিতে চাইনি কখনোই। অতীতেও না বর্তমানেও না। আর এর প্রভাব রয়ে গেছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়, জীবন ব্যবস্থায়, উচ্চ শিক্ষায়, বাল্যশিক্ষায় এমনকি সবকিছুতে, সবজায়গায়। যার ফলে একজন মেধাবী কিংবা মার্জিত, শিক্ষিত ব্যক্তিও মনে করছেন, সবকিছুর শেষে পুরুষই শ্রেষ্ঠ, নারী কমজোর।
তানজিম সাকিব ক্ষমা চেয়েছেন, আপাতঃ দৃষ্টিতে বিষয়টি ভালো মনে হলেও আসলেই তানজিম সাকিব বিষয়টি কতোটুকু নিজের উপলব্ধি থেকে বলেছেন তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। তাঁর সামনে একটি উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনার সুযোগোকে কাজে লাগাটে, তাঁর দেয়া স্ট্যাটাসের কারণে সৃষ্ট এই উদ্ভট পরিস্থিতি মোকাবিলায় সাকিব হয়তো এখন ক্ষমা চেয়েছেন। কিন্তু, মন থেকে তাঁর এই আদর্শটি সাকিব মুছে ফেলতে পারবেন কী? মন থেকে কী সাকিব নারীদের অধিকারের বিষয়টিকে স্বীকার করে নেবেন?
- লেখক: শ্যামলাল গোসাঁই, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ