শ্যামলাল গোঁসাই
গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধে প্রকাশ্যে আসছে আমেরিকার ভণ্ডামির কূটনীতি
আমেরিকাকে দুনিয়ার সুসভ্য দেশ বলা হয় গণতান্ত্রিক চর্চার ধারক এবং উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে। সোভিয়েত যুগের অবসানের পর পৃথিবীতে রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক আদর্শগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে হারিয়ে গেলেও আজ অব্দি বহাল তবিয়তে আছে বিশ্বজোড়া চর্চিত আমেরিকার গণতান্ত্রিক আদর্শ। বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মুরুব্বি ভাবা হয় আমেরিকাকে তারাও নিজেদেরকে সেই আসনে রেখেই বিশ্বের সঙ্গে তাঁদের কূটনৈতিক বিস্তৃতির প্রসার করে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরে বিশ্ব রাজনীতিতে যে উলটপালট হয়েছে তাতে আমেরিকার ভণ্ডামির আসল চিত্রটি যেন বাইরে আসতে শুরু করেছে। বিশেষ করে, ফিলিস্তিনের গাজা-হামাস যুদ্ধ শুরুর পর অধিকাংশ বিশ্ববাসী এমনকি খোদ আমেরিকান জনগণও আমেরিকার ভণ্ডামির কূটনীতির বিষয়ে খোলাসাভাবে জানতে পারছেন বা বুঝতে পারছেন।
কেননা, আমেরিকাসহ অনেক দেশেই সত্যটা জানতে দেয়া হয় না এমন একটা অভিযোগ আছে। কিন্তু তদুপরি, আধুনিক এ বিশ্ব ব্যবস্থায় গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধের ব্যাপারে একেবারে অজ্ঞাত থাকা যায় না। তাই এখন বিশ্বের সামনে এখন ক্রমশ যেন আমেরিকার দ্বিচারি স্বভাব পরিষ্কার হয়ে ধরা দিচ্ছে।
আমেরিকা আসলে মনেপ্রাণে ইসরায়েলিদের হয়েই লড়ছে। যেমন যুদ্ধের ময়দানে, তেমনি বিশ্ব রাজনীতির ময়দানেও। এতে করে আমেরিকান প্রশাসনের কূটনৈতিক নৈতিকতা এবং স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। তাঁরা রাশিয়া যখন ইউক্রেনে হামলা করছে তখন ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ মারা যাচ্ছে, এটা মানবতাবিরোধী। ইউক্রেনে আক্রমণের পর রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে এখনো লুকোচুরি করে সফর করতে হচ্ছে। অথচ, একই দৃশ্য যখন ফিলিস্তিনে দেখা যাচ্ছে। যখন ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বর হামলায় ২৪ ঘণ্টায় সাড়ে সাতশো মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, ইসরায়েলি বাহিনীর নিষ্ঠুরতায় যখন মাত্র ১৫ দিনে ২ হাজারের বেশি শিশুর মৃ ত্যু হচ্ছে তখন তাঁরা এটাকে ইসরায়েলি বাহিনীর ন্যায্য অভিযান বলে দায় এড়াচ্ছে!
গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরুর পর থেকে আমেরিকা প্রকাশ্যে এবং সর্বাত্মকভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়ে আসছে। এমনকি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাইডেন একদিকে ফিলিস্তিনিদের হামলা সমবেদনা জানিয়ে অন্যদিকে ইসরায়েলের হয়ে হামাসসহ ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার মতো কথা বলতেও শোনা গেছে। গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরুর পর আমেরিকার সব বড় বড় কর্তারা ঘনঘন ইসরায়েল সফর করছেন। আমেরিকান সৈন্য, যুদ্ধ জাহাজ তাঁরা ইসরায়েলের সহায়তার জন্য পাঠাচ্ছেন। পাশাপাশি নিয়ম করে সংবাদমাধ্যমের সামনে এসে নির্লজ্জের মতো ইসরায়েলিদের রাষ্ট্র গঠনের বৈধতা এবং ফিলিস্তিনিদের শায়েস্তা করার বিষয়ে অঙ্গিকারবদ্ধ হওয়ার কথা জানাচ্ছেন। অনেকে এখন বলতে শুরু করেছেন, নেতানিয়াহু তো পুতুল মাত্র। যুদ্ধ চালাচ্ছে আমেরিকা। সহজ করে বললে বাইডেন। তাঁদের নির্দেশনাতে নাকি এখনো স্থল অভিযানে নামেনি ইহুদি বাহিনী। আমেরিকান সৈন্যরা পৌঁছালে দুই দেশের সৈন্য মিলে একসাথে হামলে পড়বে ফিলিস্তিনের ভূমিতে।
এসব থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, আমেরিকা আসলে মনেপ্রাণে ইসরায়েলিদের হয়েই লড়ছে। যেমন যুদ্ধের ময়দানে, তেমনি বিশ্ব রাজনীতির ময়দানেও। এতে করে আমেরিকান প্রশাসনের কূটনৈতিক নৈতিকতা এবং স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। তাঁরা রাশিয়া যখন ইউক্রেনে হামলা করছে তখন ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ মারা যাচ্ছে, এটা মানবতাবিরোধী। ইউক্রেনে আক্রমণের পর রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে এখনো লুকোচুরি করে সফর করতে হচ্ছে। অথচ, একই দৃশ্য যখন ফিলিস্তিনে দেখা যাচ্ছে। যখন ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বর হামলায় ২৪ ঘণ্টায় সাড়ে সাতশো মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, ইসরায়েলি বাহিনীর নিষ্ঠুরতায় যখন মাত্র ১৫ দিনে ২ হাজারের বেশি শিশুর মৃ ত্যু হচ্ছে তখন তাঁরা এটাকে ইসরায়েলি বাহিনীর ন্যায্য অভিযান বলে দায় এড়াচ্ছে! বিষয়টা এমন, আমেরিকার বন্ধু ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলায় কেউ মারা গেলে সেটা যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ। কিন্তু, আমেরিকার কোনো বন্ধু (ইসরায়েল) যদি একই অপরাধ করে তখন তাঁরা সেটাকে ন্যায্য দাবি বলে বক্তব্য দিচ্ছেন! এখানেই আমেরিকার ভণ্ডামির চিত্রটি ধরা পড়ে। গণতন্ত্র চর্চার ভেতরে আমেরিকার অন্দরে যে আসলে নীতি, নৈতিকতা, মানবতাবোধের সিকিভাগও নেই তা এই যুদ্ধে সামনে চলে আসে খুব সহজেই।
বাইডেন প্রশাসন এতোদিন চেয়েছিল ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদির সমঝোতা চুক্তির মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে। যেই সাফল্যের পিঠে চড়ে বাইডেন সাহেব সহজেই আসন্ন আমেরিকার জাতীয় নির্বাচনে পাস করা স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধ লেগে যাবার পর সেটা অনেকটাই কষ্টসাধ্য হয়ে উঠলো। এক পর্যায়ে গাজায় হামলার জের ধরে সৌদি প্রিন্স ইসরায়েলের সঙ্গে হতে যাওয়া চুক্তিটি বাতিল করে দিয়েছেন। গাজা-হামাস যুদ্ধ শুরুর পর বাইডেন চেয়েছিলেন ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট আব্বাসসহ সৌদি, মিসরের প্রেসিডেন্টদের সঙ্গে বসে যুদ্ধকে শান্তিপূর্ণভাবে মিটমাট করে নিতে। কিন্তু প্রায় সকল আরব নেতাই এখন বাইডেনের সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাত বাতিল করেছেন। এর কারণ, আমেরিকার একপেশে ইসরায়েলকে সমর্থন। অপরাধ করা সত্ত্বেও আমেরিকা যখন ইসরায়েলকে নিষ্পাপ বলে গলা হাঁকাচ্ছেন তখন এসব নেতারা তাঁর সাথে বৈঠক বাতিল করা শ্রেয় মনে করেন।
ইসরায়েল বর্তমানে গোঁয়ারের মতো আচরণ করছে। যেন এতোদিন তাঁরা এমন একটি উসিলার অপেক্ষাতেই ছিলো ফিলিস্তিনে স্বার্বিক হামলা চালানোর জন্য। তাঁরা জাতিসংঘসহ সকল বিশ্ব সম্প্রদায়ের আহ্বানকে বুড়ি আঙ্গুল দেখিয়ে গাজায় বর্বর হামলা চালানো অব্যাহত রেখেছে। গাজার পক্ষ নিয়ে কথা বলায় ইসরায়েল জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের পদত্যাগ দাবি করেছে। তাঁদের সঙ্গে আছে আমেরিকা। আমেরিকার সঙ্গে আছে ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো। তাই তাঁরা আর কাউকে হিসেবে ধরার দরকার মনে করছে না। বাস্তবতাও তাই।
কিন্তু এতে করে বিপাকে পড়েছে আমেরিকা। তাঁর ইমেক সঙ্কট দেখা গিয়েছে। মানুষ জেনে যাচ্ছে, আমেরিকা নিজের মদদ দেয়া দেশগুলোর অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়। বিপরীতে অন্য দেশের ন্যায্য দাবি হলেও তা প্রত্যাখ্যান করে। আমেরিকার কূটনীতিতে এই দ্বিচারিতা বহুদিনের চর্চিত বিষয়। বিশ্ববাসী, এগুলো এতোদিন অনেকটা জেনে, অনেকটা না জেনে ছিলেন। কিন্তু গাজা-ইসরায়েল, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর আমেরিকার এই সমস্ত ভণ্ডামি বিশ্বের কাছে প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে।
-
গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধে যেভাবে লাভ রাশিয়ার, লোকসান আমেরিকার
-
ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত, আরব বিশ্বের ফাটল ভাঙবে কি?
গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরুর পর আমেরিকা ইউক্রেনীয় বাহিনীকে সহায়তা দেয়া কমিয়ে ফেলেছে। যে ইউক্রেনকে তাঁরা তাঁদের ফন্দিতে যুদ্ধের ময়দানে নামিয়েছে একদিন, আজ সেই সেনাদের যুদ্ধ ক্ষেত্রে রুশ সৈন্যদের সামনে রেখে আমেরিকা ইসরায়েলিদের হয়ে যুদ্ধ লড়তে যাচ্ছে। অসহায় ইউক্রেনীয় প্রধানমন্ত্রী সেদিন বলেছেন- আমেরিকার সহায়তা ছাড়া আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে টিকতে পারবো না। হচ্ছেও তাই। গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধ লাগার পর থেকে ইউক্রেনে বেড়েছে রাশিয়া হামলা। চীনা নিষেধাজ্ঞার কারণে ড্রোন সঙ্কটে পড়েছে ইউক্রেন। এদিকে, ইসরায়েলি বাহিনীকে সাহায্য করায় এই মুহুর্তে ইউক্রেনকে প্রতিশ্রুত সাহায্য করতে পারছে না আমেরিকা। ফলে, আমেরিকান প্রশাসনের এই স্বাভাব নিয়ে ইউক্রেনের মানুষদের মনে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কেননা, আমেরিকা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে যুদ্ধে লিপ্ত করে আজ তাঁদের অবহেলা করে ইসরায়েলিদের জন্য হন্তদন্ত হয়ে লড়ছে।
আমেরিকার কূটনীতির এই সঙ্কটের চিত্রটিই এখন পত্রিকা খুললে চোখে পড়ে সবার সামনে। তাঁরা এতোদিন ইউক্রেনে সাধারণ মানুষ, নারী, শিশুর মৃত্যু দেখে মিথ্যা কান্না দেখিয়েছে। কিন্তু যখন তাঁদের মদদ দেয়া বাহিনী ফিলিস্তিনের হাজার হাজার শিশুকে নির্মমভাবে হ ত্যা করছে তখন তাঁরা হেসে হেসে এটাকে ন্যায্য দাবি বলছে! গণতন্ত্রের ধারক বাহক দেশটি যেন নিজেদের ভেতরে কতোটা শয়তানি নীতি নিয়ে ঘুরে সেটা এখন দুনিয়া জেনে যাচ্ছে।
লেখক- শ্যামলাল গোসাঁই, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী, ইমেইল- [email protected]
- খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ