সাইফুর রহমান তুহিন
আপডেট: ১৬:৫৩, ১০ জানুয়ারি ২০২৪
ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
নির্বিচারে গোলাবর্ষণ ও বোমাবর্ষণের মাধ্যমে নিরীহ মানুষ হত্যা এবং ঘরবাড়ি ধ্বংসের পাশাপাশি আগ্রাসী ইসরায়েল রাষ্ট্র ক্রমান্বয়ে শেষ করে দিচ্ছে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকেও। কিছুদিন আগেও গাজার শিল্পী সম্প্রদায় ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিলো। অথচ আজ তাদেরকে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করতে হচ্ছে। ইসরায়েলিদের গণহত্যামূলক হামলা গাজা উপত্যকার বিভিন্ন প্রকার শিল্পীদের একটি প্রজন্মকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে।
ফিলিস্তিনের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এমন একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে যে, গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের বর্বর ও নির্বিচার বোমাবর্ষণের ফলে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ২৮ জন ফিলিস্তিনি শিল্পী, বুদ্ধিজীবী ও লেখকের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিবেদনে গাজার সাংস্কৃতিক কাঠামোতে চলমান ইসরায়েলি আক্রমণের গভীর প্রভাবের রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে এবং বর্তমান পরিস্থিতির ভয়াবহতার প্রতি দৃষ্টিপাত করা হয়েছে।
অকাট্য প্রমাণ হিসেবে নিচে ৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত নিহত কিছু সুপরিচিত ফিলিস্তিনি শিল্পী, সাংস্কৃতিক কর্মী ও সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্বের নাম উল্লেখ করা হলো :
হেবা জাকাউত : ৩৯ বছর বয়সী ভিস্যুয়াল আর্টিস্ট ও চারুকলার শিক্ষক হেবা গাজী ইব্রাহিম জাকাউত গত ১৩ অক্টোবর তার এক পুত্রসহ নিহত হন। জাকউত ছিলেন আল-আকসা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারুকলায় স্নাতক। তার অনেক চিত্রকর্ম অ্যাক্রিলিক্সে করা হয়েছে এবং এগুলোতে নারী, ফিলিস্তিনের স্বদেশভূমি ও প্রকৃতিকে চিত্রিত করা হয়েছে। তার চিত্রকর্মগুলোতে ফিলিস্তিনিদের পরিচয় এবং অস্তিত্বের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে উজ্জ্বল ও আনন্দময় ল্যান্ডস্কেপ যেগুলো মূলত : মসজিদ, গির্জা, মিনার ও গম্বুজে ভরা।
হেবা আবু নাদা : ৩২ বছর বয়সী লেখক, কবি ও শিক্ষক হেবা আবু নাদা গত ২০ অক্টোবর খান ইউনিসের ওপর ইসরায়েলি বিমান হামলায় তার ছেলের সাথে নিহত হন। তার উপন্যাস ‘অক্সিজেন মৃতের জন্য নয়’ ২০১৭ সালে আরব সৃজনশীলতার জন্য শারজাহ পুরস্কারে দ্বিতীয় স্থান লাভ করে।
তিনি ৪ অক্টোবর আরবি ভাষায় পোস্ট করা তার শেষ টুইটার (বর্তমানে এক্স) বার্তায় তিনি লিখেছিলেন ‘‘গাজার রাত রকেটের আভা ছাড়া অন্ধকার, বোমার আওয়াজ ছাড়া শান্ত, প্রার্থনার আরাম ছাড়া ভয়ংকর, শহীদদদের আলো ছাড়া কালো। শুভরাত্রি গাজা।’’
ওমর আবু শাবিশ : ৩৬ বছর বয়সী কবি, ঔপন্যাসিক ও সমাজকর্মী ওমর আবু শাবিশ অনেকটা একইভাবে ৭ অক্টোবর গাজার নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে বোমা হামলায় শহীদ হন। সেখানেই তিনি জন্মেছিলেন এবং বসবাস করছিলেন। যুবকদেরকে প্রভাবিত করে এমন সমস্যগুলোর বিষয়ে নিজের উদ্বেগের জন্য সুপরিচিত ছিলেন আবু শাবিশ।
ওমর আবু শাবিশ বেশ কয়েকটি যুব সমিতি গঠনের সাথে তিনি জড়িত ছিলেন এবং এসব ক্ষেত্রে অবদানের জন্য স্থানীয় ওস আন্তর্জাতিক পুরস্কারও অর্জন করেছিলেন। এসব ক্ষেত্রে নিজের প্রভাবদায়ী ভূমিকার কারণে আরব ইয়ুথ কাউন্সিল ফর ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট (যা আবার লিগ অব আরব স্টেটসের সাথে অধিভুক্ত) ২০১৩ সালে তাকে ‘ডিস্টিংগুইশড আরব ইয়ুথ ইন দ্য ফিল্ড অব মিডিয়া, জার্নালিজম অ্যান্ড কালচার’ পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করে। আবু শাবিশের সাহিত্যিবিষয়ক অবদান সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।
২০১৬ সালে তিনি ‘আলা কায়েদ আল-মাওত’ শিরোনামের বেশ কয়েকটি কবিতা সংকলন এবং একটি উপন্যাস প্রকাশ করেছিলেন।
ইনাস সাক্কা : ইনাস সাক্কা একজন সুপরিচিত অভিনেত্রী, নাট্যকার ও শিক্ষক যিনি শিশু থিয়েটারে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। অক্টোবরের শেষভাগে ইসরায়েলি বিমান হামলায় সাক্কার সাথে তার তিন সন্তান সারা, লিন ও ইব্রাহিমও নিহত হয়। তিনি ছিলেন গাজার থিয়েটার দৃশ্যের অন্যতম প্রভাবশালী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব এবং গাজা উপত্যকার শিশুদের জন্য সৃষ্টিশীল কলার একজন অগ্রদূত। তরুণদের জন্য অনেক গ্রীস্মকালীন থিয়েটার কর্মশালা আয়োজন করেছেন তিনি।
অভিনয়েও যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন ইনাস সাক্কা। চলচ্চিত্রে তার অবদান লক্ষ্য করা যায় ২০১৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সারা’ ও ‘দ্য হোমল্যান্ড’স স্প্যারো’ সিনেমা দুটির মাধ্যমে। ‘সারা’ সিনেমার বক্তব্য ছিলো অনার কিলিং সংক্রান্ত জরুরি সামাজিক সমস্যা এবং ‘দ্য হোমল্যান্ড’স স্প্যারো’-তে আলোকপাত করা হয়েছিলো ১৯৪৮ সালের নাকাবা (বিপর্যয়) এবং ১৯৬৭ সালে ইসরায়েলের পশ্চিম তীর ও গাজা দখলের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীকারের সংগ্রাম।
অভিনয়ের পাশাপাশি সাক্কা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তার অবদান এবং গাজা উপত্যকায় একাধিক থিয়েটার দলের প্রতি সহযোগিতামূলক মনোভাবের জন্য পরিচিত ছিলেন। এর পাশাপাশি তিনি জড়িত ছিলেন ‘দ্য বিয়ার’, ‘উওম্যান অব
গাজা’, ‘আইয়ুব’স প্যাশেন্স’, ‘এভরিথিং ইজ ফাইন’ প্রভৃতি নাটক রচনা ও প্রযোজনার সাথে।
ইউসেফ দাওয়াস : গত বছরের ১৪ অক্টোবর মাত্র ২০ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি সংগীত শিল্পী, লেখক, সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার এবং উচ্চাকাঙ্খী মনোবিশ্লেষক ইউসুফ দাওয়াস উত্তর গাজায় তার পারিবারিক বাড়িতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হন। দাওয়াস আরবি ও ইংরেজি দুই ভাষায়ই খুব সাবলীল ছিলেন, বলতেন ও লিখতেন। এর পাশাপাশি তিনি প্রবন্ধ লিখতেন যেগুলোর বিষয়বস্তু ছিলো বেশ বিস্তৃত।
দাওয়াস সংক্ষিপ্ত ভিডিওচিত্র বানাতে পারতেন যেগুলোতে অনেক বিষয়াদি উঠে আসতো যার মধ্যে ছিলো সারা বিশ্ব পরিভ্রমণ ও আবিষ্কারের উচ্চাকাঙ্খা। যদিও একটি ভিডিও ক্লিপে তিনি গুরুত্বসহকারে বলেছিলেন যে, তুলনামূলকভাবে অনেক দূরের বিদেশি গন্তব্যসমূহের চেয়ে তিনি অন্যান্য ফিলিস্তিনি শহর ও গ্রামগুলো দেখার স্বপ্ন দেখেন। ইসরাইল তাকে এবং তার স্বপ্নগুলোকে হত্যা করার আগে এগুলোই ছিলো তার চিন্তাভাবনা।
মোহাম্মদ কারাইকা : মাত্র ২৪ বছর বয়সী উদ্ভাবনী কার্টুনিস্ট, শিল্পী, ফটোগ্রাফার ও স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ সামি কারাইকা নিহত হন গত বছরের ১৭ অক্টোবর। তিনি ছিলেন প্রায় ৫০০ হতভাগ্যোর একজন যারা আল-আহলি আরব হাসপাতালে বোমা হামলায় নিহত হয়েছিলেন। হাজারখানেক সাধারণ মানুষ প্রাণ বাঁচানোর জন্য জায়গাটিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
জীবনের শেষ দিনগুলোতেও কারাইকা তার শৈল্পিক দক্ষতা ও প্রভাবদায়ী দক্ষতা ব্যবহার করে হাসপাতাল কম্পাউন্ডে আশ্রয় নেওয়া লোকজনকে এবং কোমলমতি শিশুদেরকে যথাসম্ভব ভয়, আতংক ও উদ্বেগ থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করেছিলেন। কারাইকা তার এই উদ্যোগকে শিশু ও বিভিন্ন পরিবারকে প্রাথমিক মানসিক চিকিৎসা
প্রদানের একটি প্রচেষ্টা হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।
তার চূড়ান্ত ইনস্টাগ্রাম পোস্টগুলোর একটিতে এক ভিডিও ক্লিপে তাকে আল-আহলি হাসপাতালের আঙিনায় শিশুদের একটি বৃত্তের কেন্দ্রে দেখা যায় যার মাধ্যমে বুঝা যায় যে, তিনি তাদেরকে উদ্বেগজনিত মানসিক অস্থিরতা থেকে দূরে রাখার জন্য বিনোদন দিচ্ছেন।
নুরলদীন হাজ্জাজ : গত ২ ডিসেম্বর ২৭ বছর বয়সী তরুণ লেখক নুরলদীন হাজ্জাজ শুজাইয়া পাড়ায় তার বাড়িতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হন। তিনি ২০২১ সালে উপন্যাস ‘উইংস দ্যাট ডু নট ফ্লাই’ এবং ২০২২ সালে নাটক ‘দ্য গ্রেট ওনস’ রচনা করেছিলেন। তিনি কর্ডোবা এসোসিয়েশন এবং এবং ডেইস অব থিয়েটার ফাউন্ডেশনের মতো উদ্যোগেও সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ছিলেন।
বহির্বিশ্বের প্রতি নুরলদীনের শেষ বার্তা ছিলো ‘‘আমার নাম নুরলদীন হাজ্জাজ, আমি একজন ফিলিস্তিনি লেখক, আমার বয়স সাতাশ বছর এবং আমার অনেক স্বপ্ন আছে। আমি কোনো সংখ্যা নই এবং এবং আমার মৃত্যুর খবর অনুমোদন করাতে সম্মত নই। এটিও বলুন যে, আমি জীবনকে ভালোবাসি এর পাশাপাশি ভালবাসি সুখ, স্বাধীনতা, শিশুদের হাসি, সমুদ্র, কফি, লেখালেখি, ফাইরুজ এবং আনন্দদায়ক সবকিছু যদিও সবকিছুই এক মুহূর্তের মধ্যে হারিয়ে যাবে।’’
- সূত্র : দ্য নিউ আরব
লেখক : সাইফুর রহমান তুহিন, সাংবাদিক ও ফিচার লেখক
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ